আয়তনের হিসাবে বিশ্বের মানচিত্রে অনেকটাই আড়ালে পড়ে থাকে বাংলাদেশ। কিন্তু নানা অর্জনে ঠিকই বিশ্বজুড়ে স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করেছে লাল সবুজের বাংলা। তেমনই আরেকটি অর্জন এলো নাজমুন নাহারের হাত ধরে। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্ব শান্তির বার্তা নিয়ে ১৬৭ দেশ ভ্রমণের বিরল কৃতিত্ব গড়েছেন নাজমুন নাহার। ১৬৭-তম দেশ হিসেবে সেন্ট লুসিয়া ভ্রমণের মাধ্যমে এই কৃতিত্ব অর্জন করেন নাজমুন। দেশটির প্রধানমন্ত্রী ফিলিপ জোসেফ পিয়ের অভিনন্দিত করেছেন নাজমুন নাহারকে; দিয়েছেন ‘সুপার ব্রেভ গার্ল’ আখ্যা।
সেন্ট লুসিয়ার গণমাধ্যম ‘দ্য ভয়েস‘ এ নাজমুনকে নিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে বিশেষ ফিচার। যেখানে উঠে এসেছে তার স্বপ্নের কথা, সংগ্রামের কথা। চলার পথের নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের পতাকা ও সংস্কৃতিকে পৌঁছে দিচ্ছেন নাজমুন।
দীর্ঘ অভিযাত্রার এ পর্বে ২০২৩ এর মে মাস থেকে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ সুরিনাম ও গায়ানা থেকে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশ ত্রিনিদাদ টোবাগো, গ্রেনাডা, সেন্ট ভিন্সেন্ট এন্ড গ্রেনেডিন্স, বার্বাডোস ও সেন্ট লুসিয়া পর্যন্ত ভ্রমণ করেছেন নাজমুন। এখানেই থামতে চান না। বাংলাদেশের পতাকা হাতে যেতে চান বিশ্বের প্রতিটি দেশে।
কীভাবে এই পথচলার শুরু? নাজমুন নাহার জানালেন, ২০০০ সালে ভারতের ভুপালের পাঁচমারিতে ‘ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল এডভেঞ্চার প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে তার বিশ্ব ভ্রমণের সূচনা। এর ১৮ বছর পর স্পর্শ করেন ১০০ তম দেশ ভ্রমণের মাইলফলক। ২০১৮ সালের ১ জুন জাম্বিয়া ও জিম্বাবুয়ের সীমান্তের ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতে নাজমুনের এই অনন্য অর্জন। আফ্রিকা মহাদেশের দেশ সাও টমে অ্যান্ড প্রিন্সিপ ভ্রমণের মধ্য দিয়ে স্পর্শ করেন ১৫০ দেশ ভ্রমণের মাইলফলক।
২৩ বছর ধরে এই ছুটে চলার নেশায় বুঁদ হয়ে আছেন নাজমুন। নানা জনপদে, নানা সংস্কৃতির সাথে মিথস্ত্রিয়ায় আছেন। বার্তা দিচ্ছেন বিশ্ব শান্তির, পরিবেশ রক্ষার। বাল্য বিবাহ বন্ধের মতো সামাজিক বিষয় নিয়েও সচেতনতা বৃদ্ধি করার কাজ করছেন তিনি। তাই তো পতাকার পাশাপাশি তার হাতে থাকে ‘নো ওয়ার, অনলি পিস, সেভ দ্য প্ল্যানেট’ এই ধরনের বার্তা। ভাষণ দিয়েছেন বিভিন্ন দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। শিশু ও তরুণদেরকে মাঝে ইতিবাচক চিন্তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন। নারীদের অণুপ্রাণিত করছেন। আমৃত্যু এই যাত্রা অব্যাহত রাখতে চান তিনি।
এই অভিযাত্রার পুরোটা পথ মসৃণ ছিল না। নাজমুন জানালেন, সড়ক পথে অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন তিনি; যেন যতটা বেশি প্রাণ, প্রকৃতি ও মানুষের কাছাকাছি থাকা যায়। বহুবার ঝুঁকিপূর্ণ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। মৃত্যুমুখেও পতিত হয়েছেন। পকেটে টাকা থাকা সত্ত্বেও খাবারের অভাবে না খেয়ে কাটাতে হয়েছে অনেক রাত। ছোট বিমানে পাড়ি দিয়ে গিয়ে বিরূপ আবহাওয়ার মাঝে পড়েছেন। এমনকি গোলাগুলির মাঝেও পড়তে হয়েছে তাকে। তবে বুকের মধ্যে সাহস ছিল, যাই হোক লাল সবুজের পতাকা যে সাথে আছে তার!
তার এই অনন্য যাত্রার জন্য বিশ্ব গণমাধ্যমের আলোচিত হয়েছেন নাজমুন। বিভিন্ন দেশের মন্ত্রী, রাষ্ট্রপ্রধান, বিখ্যাত ব্যক্তিরা তাকে সংবর্ধিত করেছেন। ‘পিস টর্চ বিয়ারার অ্যাওয়ার্ড’র মতো সম্মাননা পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে। এছাড়াও দেশে-বিদেশে ৫০টিরও বেশি সম্মাননা পেয়েছেন নাজমুন।
নাজমুনের এই পথচলার আগ্রহটা জাগে দাদার কাছে মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণের গল্প শুনে। যখন নিজে ভ্রমণ শুরু করলেন বাবার কাছে পেয়েছেন উৎসাহ। বাবা তার এই বিরল অর্জন দেখে যেতে পারলেন না, এই আফসোস চেপে রাখতে পারেন না নাজমুন নাহার। জানালেন, বাবা সবসময় বলতেন, তুমি একদিন অনেক সম্মানিত হবে। ২০১০ সালে আচমকাই চলে গেলেন তিনি। সে সময় তার পাশে থাকতে পারিনি এ দুঃখবোধ সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।
লক্ষ্মীপুর সদরে জন্ম নেয়া নাজমুন নাহার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক করেন। এরপর সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটি থেকে এশিয়ান স্টাডিজ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়া হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড এশিয়া বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে। তবে সবচেয়ে বড় শিক্ষা হয়তো অর্জন করেছেন পৃথিবীর পথে পথে।
Leave a reply