কমিউনিস্ট চেকোস্লোভাকিয়ায় সর্বাত্মকবাদের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ স্বর উচ্চারণের কারণে দেশ থেকে নির্বাসিত হওয়া স্যাটায়ারিস্ট, ‘দ্য আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িং’, ‘ইমর্টালিটি’র মতো অমর সাহিত্যের রচয়িতা কথাসাহিত্যিক মিলান কুন্ডেরা মারা গেছেন। অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ ও উপন্যাসে সত্তা ও প্রতারণার কথা উন্মোচন করা বিশ্ব বিখ্যাত এই সাহিত্যিক ৯৪ বছর বয়সে প্যারিসে মৃত্যুবরণ করেছেন।
আজ (১২ জুলাই) মিলান কুন্ডেরা লাইব্রেরির মুখপাত্রের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স এই তথ্য নিশ্চিত করেছে। মুখপাত্র এএফপিকে বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমি নিশ্চিত করছি যে, দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর মিলান কুন্ডেরা গতকাল (মঙ্গলবার) মারা গেছেন।
মিলান কুন্ডেরার প্রথম উপন্যাসের নাম ‘দ্য জোক’। ১৯৬৭ সালে এটি প্রকাশিত হলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। ওই লেখায় তিনি কমিউনিস্ট শাসনের নিষ্ঠুর চিত্র তুলে ধরেন। এ উপন্যাসকেই তার নির্বাসিত হওয়ার প্রথম ধাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৬৮ সালে প্রাগে সোভিয়েত আগ্রাসন শুরুর পরই নিষিদ্ধ হয় ‘দ্য জোক’।
কমিউনিস্ট বিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য জন্মভূমি চেকোস্লোভাকিয়া থেকে ১৯৭৫ সালে নির্বাসিত হন মিলান। ১৯৭৯ সালে চেক নাগরিকত্ব হারান তিনি। এরপর তিনি বসবাস শুরু করেন প্যারিসে, কাটান প্রায় ৪০ বছর। সেখানেই তিনি লেখেন তার সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাস ‘দ্য আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িং’। প্রেম এবং নির্বাসন, রাজনীতি এবং গভীরভাবে ব্যক্তিগত কুন্ডেরার উপন্যাসটি সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করে। পশ্চিমাদের মাঝেও তিনি লাভ করেন জনপ্রিয়তা, যারা কুন্ডেরার লেখায় সোভিয়েত-বিরোধী বক্তব্য এবং রতি ভাব- উভয়ই গ্রহণ করেছিল।
১৯৮০ সালে নিউইয়র্ক টাইমসে ফিলিপ রথকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মিলান কুন্ডেরা বলেছিলেন, কেউ যদি আমাকে একদম শিশু মনে করে বলে, একদিন দুনিয়া থেকে গায়েব হয়ে যাবে আমার দেশ; তবে কথাটিকে আমি পাত্তা দিতাম না। ভাবতাম, ভাট বকছে। এটা এমন একটা ব্যাপার যা আমি কল্পনাতেও আনতে পারি না। মানুষ ভাবে সে নশ্বর। কিন্তু তার দেশ যেন ধারণ করে আছে কোনো অবিনাশী সত্তা।
১৯৭৬ সালে ফরাসি দৈনিক লে মন্ডেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মিলান কুন্ডেরা বলেছিলেন, রাজনৈতিকভাবে চিহ্নিত করে তার লেখার ভার কমিয়ে দেয়া হচ্ছে। এতে প্রকৃত তাৎপর্য অস্পষ্ট হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
২০১৩ সালে ১৩ বছর বিরতির পর নতুন এক উপন্যাস প্রকাশ করেন কুন্ডেরা। ‘দ্য ফেস্টিভাল অব ইনসিগনিফিক্যান্স’ বইটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া অর্জন করে।
কুন্ডেরা ক্যামেরার সামনে আসতে পছন্দ করতেন না। লেখায় কোনো টীকা ব্যবহারেও ছিল তার অনীহা। নিজের লেখার ডিজিটাল কপি তৈরি করতে চাইতেন না তিনি। ২০১২ সালে ফ্রেঞ্চ ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে এক সাক্ষাৎকারে সাহিত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন মিলান কুন্ডেরা। তিনি বলেন, আমার কাছে মনে হয়, সময়ের নির্মম পথচলায় বিপন্ন হচ্ছে বই। এই শঙ্কার কারণেই বেশ কয়েক বছর ধরে আমি আমার সমস্ত চুক্তিতে একটি ধারা রেখেছি যে, বইগুলোকে কেবল বইয়ের ঐতিহ্যগত আকারেই প্রকাশ করতে হবে। সেগুলো কেবল কাগজেই পড়া যাবে, পর্দায় নয়।
তিনি বলেন, মানুষ রাস্তায় হাঁটে। আশপাশের মানুষের সাথে কথা বলার প্রয়োজন বা তাগিদ কিছুই বোধ করে না। যে বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছে সেগুলোও দেখে না। তাদের কান থেকে তার ঝুলে থাকে। তারা কারও দিকে তাকায় না এবং কেউ তাদের দিকেও তাকায় না। আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করি, তারা কি আদৌ বই পড়ে! এভাবে হয়তো সম্ভব। কিন্তু আর কতদিন?
সাত খণ্ডে সমাপ্ত উপন্যাস ‘ইমর্টালিটি’ বা অমরত্বের গল্পে অ্যাগনেস, তার স্বামী পল, বোন লরার সাথে চলে আসে ঐতিহাসিক বেশ কয়েকটি চরিত্র। মহাকবি গ্যেটে, তার মৃত্যুর পর আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সাথে বন্ধুত্বও ছিল এই অমর উপন্যাসে। এখানে অ্যাগনেস চরিত্রটি সম্পর্কে কুন্ডেরা বলেন, আমি এই নামে কাউকে চিনতাম না। কিন্তু এই চরিত্রটি ধীরে ধীরে আমার মাঝে ঢুকে যাচ্ছে। আমার জায়গা সে নিয়ে নিচ্ছে।
উপন্যাসটির এক অংশে অ্যাগনেস চরিত্রটি বলে, উপন্যাস কখনও ঘোড়দৌড়ের মতো হওয়া উচিত নয়। বরং, অনেক পদের খাবার আছে এমন কোনো ভোজের সাথেই উপন্যাসকে উপমিত করতে চাইবো আমি। কোনো এক অংশে হুট করে একটি চরিত্র ঢুকে পড়তে পারে। তার শেষে সে বিদায়ও নেবে, কোনো চিহ্নমাত্র না রেখে। সে কিছু করবে না। তার প্রস্থানেও হবে না কোনো উনিশ-বিশ। কিন্তু সে যখন প্রবেশ করবে সেটাই হবে উপন্যাসের ভেতর আরেক উপন্যাস। সেটাই হবে আমার লেখা সবচেয়ে বেদনাদায়ক কামোদ্দীপক গল্প।
/এম ই
Leave a reply