মাহমুদুল হাসান ইমন:
বিশ্বকাপে নিজেদের পঞ্চম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৩৮২ রানের পাহাড়ের চাপে পড়ে মাত্র ৮১ রান তুলতেই ৬ উইকেট হারিয়ে ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে টাইগাররা। মঙ্গলবার (২৪ অক্টোবর) ওয়াংখেড়েতে বাংলাদেশের হার যখন প্রায় নিশ্চিত, তখন মুম্বাইয়ের গ্যালারিতে এক সমর্থকের প্ল্যাকার্ডে বাংলা টাইগার্স লেখাটির মধ্যে ‘টাইগার্স’ কেটে ‘কিটেনস’ লেখা দেখা গেছে।
আসলেই বাংলাদেশ কি তাদের ‘টাইগার’ নামের প্রতি সুবিচার করতে পারছে বিশ্বকাপে? অথবা বাংলাদেশের ব্যাটাররা? ‘বাংলার বাঘ’ থেকে ‘বাংলার বিড়ালছানা’তে রূপান্তরের পেছনে আসলে কারা দায়ী?
শেষ ম্যাচের কথাই ধরা যাক। দক্ষিণ আফ্রিকার দেয়া ৩৮৩ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে পাওয়ার প্লে শেষ হতে না হতেই ছন্দপতন ঘটে বাংলাদেশের। সপ্তম ওভারে মার্কো জানসেনের শর্ট বলে কট বিহাইন্ড হন তানজিদ তামিম। পরের বলেই গোল্ডেন ডাক মেরে সাজঘরে ফেরেন নাজমুল শান্ত। ব্যর্থ সাকিবও সাজঘরে ফিরে যান ক্রিজে এসেই। মাত্র ১৩ বলের ব্যবধানে পরপর প্যাভিলিয়নে ফেরেন তিন ব্যাটার।
সাকিবের বিষয় দিয়েই শুরু করা যাক। লিজার্ড উইলিয়ামসের অফ স্টাম্পের বাইরে দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া বলে খোঁচা দেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। বাঁ-দিকে ঝাঁপিয়ে নিজের তৃতীয় ক্যাচটি লুফে নেন হেনরিখ ক্লাসেন।
সাকিবের আউটের ধরনে স্বাভাবিকভাবেই বিরক্ত হবেন ক্রিকেটবোদ্ধারা। কারণ, সাকিব লিজার্ড উইলিয়ামসের যে বলে আউট হয়েছেন, বলটিতে বাউন্স ছিল ঠিকই, কিন্তু তাতে উইকেট বিলিয়ে দেয়ার মতো ছিল না কিছুই। বলটিতে সাকিব না করেছেন কাভার ড্রাইভ, না স্কয়ার কাট। ধারাভাষ্যকাররাও তার এমন আউটে বিস্মিত। একজন তো বলেই বসেন, ব্যাট চালানোর দরকার বলেই ব্যাট চালিয়েছেন সাকিব।
বিশ্বকাপে যাকে দেশের ক্রিকেটের ভরসা ভাবা হচ্ছিল, সেই নাজমুল হোসেন শান্তও ফ্লপ। তার আউটের ধরন দেখে ত্যক্ত-বিরক্ত দর্শকরা। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে যে বলে আউট হয়েছেন, তার আগের ম্যাচগুলোতেও প্যাভিলিয়নে ফিরেছেন অনেকটা একইরকম বলে বাজে শট খেলে। এভাবে আউট হবার কী কারণ দেখাবেন তিনি?
দ্রুত তিন উইকেট হারানোর পর ডিপেন্ডেবল খ্যাত অভিজ্ঞ মুশফিকুর রহিমের অন্তত দায়িত্ব ছিল লিটনকে সঙ্গে নিয়ে কোনোমতে তরী তীরে ভেড়ানোর চেষ্টা করা। তবে ব্যাটারদের আসা-যাওয়ার মিছিল থেকে নিজেকে বঞ্চিত করেননি অভিজ্ঞ এই ব্যাটার। জেরাল্ড কোয়েৎজির অফ স্টাম্পের বাইরের বল খেলতে গিয়ে ডিপ থার্ডম্যানে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন ৮ রান করা মুশফিক।
অর্থাৎ দক্ষিণ আফ্রিকার ৩৮২ রান তাড়া করতে নেমে বাংলাদেশের অভিজ্ঞ টপ মিডল অর্ডার (শান্ত, সাকিব, মুশফিক) থেকে রান এসেছে মাত্র ৯, তারা বল খেলেছেন ২২টি।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষের ম্যাচ দিয়ে শুরু ব্যাটিং ব্যর্থতা। সে ম্যাচে শান্তর গোল্ডেন ডাক, সাকিবের ৯ বলে ১ রান এবং মেহেদী হাসান মিরাজের সাত বলে ৮ রান। নিউজিল্যান্ডের ম্যাচে খারাপ না বললেও খুব ভালোও বলা যায় না। মিরাজ, শান্ত ও সাকিব মিলে ১০৫ বল খেলে তুলেছিলেন মোটে ৭০ রান। ভারতের বিপক্ষের ম্যাচে আসা যাক। পুনেতে ভারতের বিপক্ষে ওই ম্যাচে বাংলাদেশের তিন, চার ও পাঁচ নম্বর ব্যাটার রান তুলেছিলেন যথাক্রমে ৮, ৩ ও ১৬। তাহলে ‘বাংলার বাঘ’ থেকে ‘বাংলার বিড়ালছানা’তে রূপান্তরের পেছনে কী আসলে এরাই দায়ী?
আরেকজনকে নিয়ে কিছু বলার নেই। দলের প্রয়োজনে এমন কোনো পজিশন নেই যেখানে তিনি খেলেননি। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। বলছিলাম, মেহেদী হাসান মিরাজের কথা। উইকেটে থিতু হলেও এক ম্যাচ ছাড়া বিশ্বকাপে বড় ইনিংস খেলতে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি।
ব্যাটারদের আসা-যাওয়ার মিছিলে কেবল ব্যতিক্রম ছিলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। ম্যাচ খেলেছেন ৪টি, ইনিংস ৩টি। আর এতেই বাজিমাত সাইলেন্ট কিলারের। স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে তিনি তুলে নিয়েছেন বিশ্বকাপে নিজের তৃতীয় সেঞ্চুরি।
অথচ এই দলটাই বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে কতই না স্বপ্ন দেখেছিল ভক্ত-সমর্থকরা। দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক লিজেন্ড ক্রিকেটার এবি ডি ভিলিয়ার্স তার ব্যক্তিগত ইউটিউব চ্যানেলে বাংলাদেশকে আফগানিস্তান ও নেদাল্যান্ডসের সাথে তুলনা করায় ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল টাইগার সমর্থকরা। অথচ পয়েন্ট টেবিলে আফগানিস্তানেরও পরে বাংলাদেশের অবস্থান। নেদারল্যান্ডসই সাকিবের দলের প্রতিবেশি। সাবেক ক্রিকেটার ও বিশ্লেষক আকাশ চোপড়া বাংলাদেশের পারফরম্যান্সকে ‘বিরক্তিকর’ বলে যে মন্তব্য করেছিলেন, তাতেও অনেকেই এখন সহমত জানাচ্ছেন।
সাবেক কিউই পেসার শেন বন্ডও মন্তব্য করেছেন সাকিবদের নিয়ে। বলেছেন, বাংলাদেশই হয়তো প্রথম দল, যারা ছিটকে যাবে বিশ্বকাপের লড়াই থেকে।
ক্রিকেটবিষয়ক ওয়েবসাইট ইএসপিএন ক্রিকইনফোতে বাংলাদেশ সম্পর্কে চেতেশ্বর পূজারা বলেছেন, নতুন বলে বাংলাদেশের মিডল অর্ডার ভঙ্গুর, যা শেষ চার ম্যাচের পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। ওই আলোচনায় তিনি অনেকটা মজা করেই বলেন, বাংলাদেশ যে ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে, মনে হচ্ছে পরের ম্যাচে মাহমুদুল্লাহকে ওপেনিংয়ে পাঠাবে।
বাংলাদেশের ব্যাটিং আর বিশ্লেষকদের নানা বিদ্রুপ মন্তব্যে শেষ পর্যন্ত একটি কথাই ভক্তদের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে,‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেব কোথা?’
/এমএইচ
Leave a reply