লিপস্টিকের একাল-সেকাল

|

মাহমুদুল হাসান ইমন:

মেয়েদের লিপস্টিকের প্রতি প্রেম চিরন্তন। মেকআপ করতে খুব একটা পছন্দ করেন না, এমন মেয়েরাও বিশেষ অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে কিছু না হোক অন্তত ঠোঁটে একটু লিপস্টিক লাগিয়ে নেন। বহুকাল ধরেই নারীরা তাদের সাজিয়ে তোলার অন্যতম অনুসঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করছেন এই প্রসাধনী।

চলুন লিপস্টিকের একাল-সেকাল ও হালচাল সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।

প্রাগৈতিহাসিক যুগের ঊষালগ্ন থেকে আজ অব্দি, অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদা করার প্রয়োজন সব মানুষই অনুভব করে। জামাকাপড় থেকে শুরু করে জুতা-গয়নায় যেমন মানুষের আগ্রহ; তেমনি আগ্রহ প্রসাধনীর দিকেও।

আদিম শিকারীরা তাদের আশেপাশের পরিবেশের সাথে আরও ভালোভাবে মিশে যাওয়ার জন্য তাদের ত্বকে আঁকিবুঁকি করতো। পুরোহিত ও অ্যাকোলাইটরাও তাদের দেবতা ও বিশ্বাসকে সম্মান দেয়ার জন্য নিজেদের সজ্জিত করতো এবং তরুণরা তাদের বিপরীত লিঙ্গের কাছে নিজেকে আরও সুন্দর ও উপস্থাপনযোগ্য করে তোলার জন্য কল্পনাযোগ্য বিভিন্ন উপায় ব্যবহার করতো।

যাইহোক, দীর্ঘ প্রাগৈতিহাসিক যুগে লিপস্টিকগুলি শুধুমাত্র সহজলভ্য প্রাকৃতিক উৎস থেকে তৈরি করা হতো। যেমন- ফল ও উদ্ভিদের রস। মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা ও ভারতে প্রাথমিক সভ্যতার আবির্ভাব শুরু হওয়ার সাথে সাথে, উন্নত উৎপাদন প্রক্রিয়া মানবজাতিকে নতুন ধরণের লিপস্টিক উৎপাদনে উৎসাহিত করে।

মেসোপটেমিয়ার মহিলারা প্রথমে তাদের মূল্যবান রত্ন পিষে সেগুলোর ধূলিকণা ব্যবহার করে ঠোঁটকে অপরূপ ঝলকানিতে সাজাতেন। সিন্ধু সভ্যতার মহিলারাও নিয়মিত লিপস্টিক ব্যবহার করতেন। তবে এক্ষেত্রে এগিয়ে ছিল মিশর। লিপস্টিক তৈরিতে তারা ছিল অগ্রগণ্য। সে সময়ের রাজকীয় সদস্য, ধর্মযাজক এবং উচ্চশ্রেণীর লোকেরা বিভিন্ন ধরণের লিপস্টিক ব্যবহার করতো। তবে সেগুলোর মধ্যে কিছু বিষাক্ত উপাদান থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে পরবর্তীতে।

কারমাইন কালার, যে রঙটি এখনও জনপ্রিয়

তখনকার সময়ে কারমাইন রঙ ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়। যা কোচিনিয়াল পোকামাকড়ের দেহ থেকে বের করা হতো। এই কৌশল আজও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন জায়গায়। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন রীতিনীতি ও পর্যবেক্ষণের গ্যাঁড়াকলে বর্তমানে ব্যবহৃত প্রসাধনী পণ্যগুলোতে সেই রঙটির উপস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে।

ইতিহাসের সেই লিপস্টিক আজ আধুনিক ফ্যাশনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা নিয়ে নিয়েছে। উৎপাদন প্রক্রিয়ার গত কয়েক শতাব্দিতে ব্যাপক উন্নয়ন হলেও মূল সূত্রটি একই রয়ে গেছে। সমগ্র ইউরোপজুড়ে মিশরের উদ্ভাবন ছড়িয়ে পড়লে প্রাথমিকভাবে গ্রিক ও রোমান সাম্রাজ্যের অভিনেতারা এর ব্যবহার শুরু করে। তবে, ধর্মের গ্যাঁড়াকলে তখন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল লিপস্টিকের ব্যবহার।

১৬ শতকে আবারও লিপস্টিকের পুনরুত্থান হয় রাণী এলিজাবেথের হাত ধরে। তার সাদা মুখ এবং লিপস্টিকের উজ্জ্বল রঙে আঁকা ঠোঁটের ফ্যাশন স্টাইল ব্যাপক জনপ্রিয় হয়। কিন্তু তার পরেই লিপস্টিকটি সমাজের নির্দিষ্ট একটি জায়গায় আটকে যায়। ব্যবহার করতে শুরু করে মূলত পতিতারা।

১৯ শতকের শেষের দিকের শিল্প বিপ্লব, জনপ্রিয় ফ্যাশন হিসেবে লিপস্টিক ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়। উৎপাদনের সহজতা, কম দাম, ফটোগ্রাফির উত্থান এবং অনেক বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেত্রীদের কারণে অবশেষে ২০ শতকে এসে সাধারণভাবে ব্যবহার শুরু হয় লিপস্টিকের।

ততোদিনে উদ্ভাবকরা এর আধুনিক সুইভেল-আপ টিউব তৈরি করে ফেলে। রসায়নবিদগণ তৈরি করে ফেলে লিপস্টিকের চকচকে রেসিপি। জনপ্রিয় রঙগুলোর ব্যবহারও বাড়তে থাকে।

হ্যাজেল বিশপ একজন বায়োকেমিস্ট; যিনি তার নিজের অ্যাপার্টমেন্ট ল্যাবে গবেষণার সময় ‘দীর্ঘস্থায়ী লিপস্টিকের’ সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন। শুধু ধন্যবাদ তার জন্য যথেষ্ট?

আজকের দিনের আধুনিক সমাজে লিপস্টিককে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাশন আইটেম হিসাবেই দেখা হয়। তবে তা ব্যবহারে অবশ্যই সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা আবশ্যক।

বর্তমান সময়ে অগণিত লিপস্টিক ব্র্যান্ড বিশ্বব্যাপী আধিপত্যের জন্য লড়াই করছে এবং নতুন নতুন রেসিপি ও শৈলীর উদ্ভাবন করছে। লিপস্টিকের অবিশ্বাস্য এই উদ্ভাবন আমাদের এমন জায়গায় নিয়ে গেছে যে, উত্তর আমেরিকার ৮০ শতাংশ’রও বেশি নারী নিয়মিত এই প্রসাধনী ব্যবহার করেন।

পিছিয়ে নেই আমরাও! আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও বলা যায়, প্রায় প্রত্যেকের ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে দুই বা একটা শেডের লিপস্টিক পাওয়া যাবেই।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply