মুরশিদুজ্জামান হিমু
১৯৯১ সালে একটি আসনের নির্বাচনের গল্প বলি। কাগজে-কলমের হিসেবে নেত্রকোণা-২ আসন। সদর আর বারহাট্টা নিয়ে গঠিত সংসদীয় আসনটি। সেবারও টান টান উত্তেজনায় হয় ভোট। ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে বিএনপি’র আবু আব্বাস ৪৭,১৯১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন সংসদ সদস্য। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের ফজলুর রহমান খান নৌকা প্রতীক নিয়ে পেয়েছিলেন ৪০,৬০৪ ভোট। জাতীয় পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টি, জাসদ (রব)ও নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল।
আর দশটা এলাকায় যেমন নির্বাচন হয়, সেখানেও হয়েছে তাই। গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু হয়নি। কারণ, সেখানে বিএনপি-আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছাপিয়ে আলোচনায় ছিলেন এক স্বতন্ত্র প্রার্থী। তিনি কবি নির্মলেন্দু গুণ। কবি মাত্র ১২৪৯ ভোট পেয়ে জামানতও হারিয়েছিলেন। এছাড়াও, কবির নির্বাচনের আরেকটি বিষয় এখনও ওই এলাকার মানুষের মুখে মুখে ফেরে। আর তা হলো– মার্কা। কবি সেবার ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন ‘কুমির’ প্রতীক নিয়ে।
কবির নির্বাচনে কর্মী হিসেবে খুব কাছ থেকে সবকিছু দেখেছেন সে সময়ের তরুণ লেখক নাভেদ আফ্রিদী। তার কাছে সেসময়ের ঘটনা জানতে চাইলে রীতিমত স্মৃতির ঝাপি খুলে বসেন। বলেন, কবির কুমির প্রতীক নিয়ে কম হাসি-ঠাট্টা হয়নি। অনেকে মজার ছলে ‘খাল কেটে কুমির আনা’ হচ্ছে কিনা, সে প্রশ্নও তুলেছিলেন। কিন্তু কবি নির্মলেন্দু গুণ নিজের কুমির প্রতীকে ছিলেন অবিচল। আস্থা রেখেছিলেন এই মনে করে যে, আদতে মার্কাটা হিংস্র প্রাণী হলেও কবির প্রতি মায়া-ভালবাসা থেকেই জনগণ ভোট দেবে তাকে। কিন্তু কবির সে আশা পূরণ হয়নি।
ভোট শেষে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকরা কবিকে প্রশ্ন করেছিলেন, কেন তিনি ফেল করেছেন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘কে বলেছে কবি হেরেছে। হেরেছে জনগণ। যারা কুমির মার্কায় ভোট দেয় নাই, এটা তাদের ব্যর্থতা। আমি নির্বাচন করেছি, আমার দায়িত্ব। জনগণ ভোট না দিয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করে নাই।’
কবির ভোটের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিল ঘটনাবহুল কাল। প্রতিদিন মজার মজার ঘটনা ঘটতো। কেউ তাতে হাসির খোরাক নিতেন। কেউ খুব ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে সেগুলোকে নির্বাচনী ঘটনা বলে মনে করতেন।
কবি নির্মলেন্দু গুণ প্রথমে নৌকা মার্কায় ভোট করতে চেয়েছিলেন। রাজনীতির দৌঁড়ে শেষ পর্যন্ত তিনি পিছিয়ে পড়েন। ভোট করেন কুমির প্রতীক নিয়ে। তবে তার পোস্টারে ছিল বঙ্গবন্ধুর ছবি। জনশ্রুতি আছে, সেসময় পোস্টারে বঙ্গবন্ধুর ছবির বিষয়টি স্থানীয় নেতৃবৃন্দ তো বটেই, আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের অনেকেই ভালোভাবে নেয়নি। প্রতিবাদ এসেছিল বিভিন্ন মহল থেকে। তাতে কবি বিন্দুমাত্র বিচলিত ছিলেন না। বরং তিনি স্পষ্ট ভাষায় বিরোধীতাকারীদের বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু কারও একার সম্পদ বা নেতা নন। তিনি বাঙালি জাতির নেতা। তার ছবি নির্মলেন্দু গুণের পোস্টারে থাকবেই।
পোস্টারে বঙ্গবন্ধুর পরিচিত কোনো ছবিও ব্যবহার করেননি তিনি। নিজের সংগ্রহে থাকা জাতির জনকের ব্যতিক্রমী একটি ছবি ছাপিয়েছিলেন। যা এক দেখাতে নজরও কাড়ত সবার।
কবির অনেক কর্মী সেসময় শরীরে কুমির এঁকে ঘুরতেন। মিছিল-প্রচারে অংশ নিতেন কুমির আঁকানো প্ল্যাকার্ড নিয়ে।
কত যে মজার মজার ঘটনা প্রতিদিন ঘটতো, তার ইয়ত্তা ছিল না। একদিন খবর এলো, সাধু বেশে কয়েকজন রাস্তায় নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তারা কবি নির্মলেন্দু গুণের গণসংযোগ করবেন। স্লোগানও তারা ঠিক করে ফেলেছেন– ‘গাঁজা মুক্তির আন্দোলন, চলছে, চলবে..’। মনস্থির করেছেন, সকলে কলকি হাতে নামবেন রাস্তায়। এরইমধ্যে কেউ কেউ বিষয়টিকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিলেন। বললেন, সাধুরা নির্বাচনে কাজ করবেন, বিষয়টা ইতিবাচক। তাদের ধারার মানুষজনকে ভোটে টানা যাবে। কেউ কেউ আবার বললেন, কলকি হাতে নামলে সর্বনাশ! ভোট পাওয়া তো দূরের কথা, জনসমর্থন আরও কমবে।
অবশেষে সাধুদের শান্ত করা গেলো। সিদ্ধান্ত হলো– কবির জন্য কাজ করবেন তারা কিন্তু বিতর্কিত কোনো জিনিস হাতে নিয়ে রাস্তায় নামবেন না। বিতর্কিত কোনো স্লোগানও দেয়া যাবে না। শেষ পর্যন্ত তারা বিষয়টি বুঝতে পেরে ফিরে গেলেন নিজেদের আস্তানায়।
কবির নারী ভক্তের সংখ্যাও নেহায়েতই কম ছিল না। কম বয়সে সে সংখ্যা ছিল আরও বেশি। ভোটের মাঠের প্রচারে গিয়ে তিনি তা বারবার দেখেছেনও। অনেক নারীই নাকি গুণের সঙ্গীদের জিজ্ঞেস করতেন, আবার কবে গণসংযোগে আসবেন কবি? আবার কবে তার মুখ দর্শন হবে?
কবির নির্বাচন কবির মতোই হয়েছিল। তিনি ইশতেহার দিয়েছিলেন কবিতার মতো করে। তাকে ভোটে সহায়তা করেছেন এলাকার কমবেশি সবাই। তার কর্মীরা যখন অন্য দলের নেতাকর্মীদের কাছে ভোট চাইতে গেছেন, তারা কখনও কটুকথা তো বলেননি, বরং নির্মলেন্দু গুণের সম্মানে সর্বোচ্চ ছাড় দেয়ার কথা বলেছেন। ভোট মানেই বড় খরচের বোঝা। তা জেনে অনেক শুভাকাঙ্খী তার জন্য হাজির হয়েছিলেন টাকাকড়ি নিয়েও।
তার নির্বাচনী প্রচারে এলাকার অনেক কবি-সাহিত্যিক তো ছিলেনই, নানা সময়ে ঢাকা থেকে গণসংযোগে ছুটে গেছেন স্বণামধন্যরাও। ভোটের আগে একদিন এক সভায় গুলতেকিনকে নিয়ে অংশ নিয়েছিলেন নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। ওই সভা থেকে গুলতেকিনের জুতা চুরি হয়ে গিয়েছিল। তা নিয়েও সভা শেষে বেশ হাস্যরস করেন হুমায়ূন আহমেদ। তিনি নাকি সভায় বলেছিলেন, গুণ ভোটে হারলে কারও ক্ষতি নেই। গুণের নিজেরও ক্ষতি নেই। শুধু ক্ষতি আমার (হুমায়ূন আহমেদের নিজের)। কারণ, জামানতের টাকা দিয়েছে গুলতেকিন। এটি আদতে মজার ছলে বলা, নাকি সত্যিই গুলতেকিন জামানতের টাকা দিয়েছিলেন, তা ইতিহাসের বালুপথেই ঢাকা পড়ে গেছে।
হুমায়ূন আহমেদ নিজেও মজার ছলে বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন কবি গুণের নির্বাচনের কথা। উন্মাদে লিখেছিলেন, কবি নাকি নির্বাচন করার জন্য জ্যান্ত কুমির ঢাকা চিড়িয়াখানা থেকে নেত্রকোণায় তার নির্বাচনী এলাকায় নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আর সেটির দায়িত্বও নাকি দেয়া হয়েছিল ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’এর নির্মাতাকে।
আদতেই কি কুমির আনতে বলেছিলেন নির্মলেন্দু গুণ? প্রশ্ন নিয়ে হাজির স্বয়ং কবির কাছেই। তিনি এক বাক্যে উড়িয়ে দেন এ কথা। বলেন, হুমায়ূন গল্প বানিয়ে এসব বলে গেছেন। তা কি আদৌ সম্ভব? কুমির কেন আনার উদ্যোগ নেব?
কবির স্মৃতিতে সে নির্বাচনের অনেক কিছুই আবছা হয়ে গেছে। সেগুলো কষ্ট করে মনে করার পক্ষেও নন তিনি। কয়েক বাক্যে বলে গেলেন, শরীর কিছুদিন আগে বেশ খারাপ ছিল। এখন আগের চেয়ে একটু ভালো বলে কথা বলছি। কিন্তু ওই ভোটের কথা মনে করতে চাই না। পাল্টা প্রশ্ন করেন, কী লাভ মনে করে?
Leave a reply