উনাশির ভোট: বিএনপির জয়, বিভক্ত আওয়ামী লীগ ও ইসলামী দলের উত্থান

|

মিশুক নজিব

পহেলা সেপ্টেম্বর ১৯৭৮, আত্মপ্রকাশ ঘটে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি)। ছয় মাস না পেরুতেই দলটি উনাশির সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। এই নির্বাচন দিয়ে ভোটের রাজনীতিতে জিয়াউর রহমানের দলের উত্থান ঘটে। তেমনি স্বাধীনতার পর ইসলামী দলগুলোও উঠে আসে এই ভোটের মাধ্যমে। বিপরীতে বিভক্ত আওয়ামী লীগ ভোটযুদ্ধে ছিল।

সংসদে প্রথম নারী সদস্য:

সৈয়দা রাজিয়া ফয়েজ। খুলনা থেকে ভোটে জিতে প্রথম নারী হিসেবে সংসদে আসেন। দ্বিতীয় জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন তিনি। তবে সরাসরি নির্বাচনে নয়, উপ-নির্বাচনে জয়ী হন। উনাশির এই ভোটে একাধিক আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন মুসলিম লীগের খান-এ সবুর। তার ছেড়ে দেয়া আসন খুলনা-১৪ থেকে উপনির্বাচনে একই দল থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন সৈয়দা রাজিয়া ফয়েজ।

সৈয়দা রাজিয়া ফয়েজ। ছবি: সংগৃহীত।

মুক্তিযুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকার জন্যও আলোচিত ছিলেন এই নারী। রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনে আশির দশকে এরশাদের জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে মন্ত্রীও হয়েছিলেন সৈয়দা রাজিয়া ফয়েজ। পরবর্তীতে ভিড়েন বিএনপিতে।

দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন ১৩ জন নারী। তাদের মধ্যে তিন প্রার্থী উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভোট পেয়েছিলেন, তবে কেউ জিততে পারেননি। আর ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরাসরি ভোটে লড়েছিলেন মাত্র দু’জন নারী। তা-ও প্রধান দল আওয়ামী লীগ থেকে নয়। ওই ভোটে নৌকার জয়জয়কারে তারা পরাজিত হয়েছিলেন।

উনাশির ভোট ও ফলাফল:

১৯৭৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ভোটার ছিল ৩ কোটি ৮৩ লাখ ৬৩ হাজার ৮৫৮ জন। এরমধ্যে ১ কোটি ৯৬ লাখ ৭৬ হাজার ১২৪ জন ভোট দেন। যা মোট ভোটের ৫১ দশমিক ১২ শতাংশ।যার মধ্যে প্রায় ২ দশমিক ভোট অবৈধ হিসেবে গণ্য হয়।

এই ভোটে ৩০টি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে। এরমধ্যে বিএনপি ২০৭টি আসনে জয়লাভ করে৷ আর সংসদে নেতৃত্ব দেয় দলটি। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান সে সময় রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্বে ছিলেন।

এই সংসদে ১৬ জন সদস্য ছিলেন, যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন। বিএনপির বাইরে বিভিন্ন দল থেকে জয় পান ৭৭ জন। তার মধ্যে আওয়ামী লীগ (মালেক) ৩৯টি, আওয়ামী লীগ (মিজান) দুটি, জাসদ আটটি, জাতীয় লীগ দুটি, মুসলিম ও ডেমোক্রেটিক লীগ ২০টি, ন্যাপ একটি, বাংলাদেশ গণফ্রন্ট দুটি, বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল একটি, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দল একটি ও জাতীয় একতা পার্টি একটি আসন পায়।

এই সংসদও মেয়াদ পূরণ করতে পারেনি। দ্বিতীয় জাতীয় সংসদের মেয়াদকাল ছিল ৭৯ এর ২ এপ্রিল থেকে ২৪ মার্চ ১৯৮২ পর্যন্ত। আগের সংসদ অর্থাৎ প্রথম জাতীয় সংসদের মেয়াদ ছিল প্রায় আড়াই বছর মতো। রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসন ব্যবস্থায় এই সংসদের নেতা হয়েছিলেন শাহ আজিজুর রহমান। আর স্পিকার ছিলেন মির্জা গোলাম হাফিজ। বিরোধীদলীয় নেতা হন আসাদুজ্জামান খান।

দলপ্রাপ্ত ভোটভোটের হারআসন
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল৭৯,৩৪,২৩৬৪১.১৭২০৭
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (মালেক)৪৭,৩৪,২৭৭২৪.৫৬৩৯
ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ১৯,৪১,৩৯৪১০.০৭২০
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল৯,৩১,৮৫১৪.৮৩
আওয়ামী লীগ (মিজান)৫,৩৫,৪২৬২.৭৮
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মুজাফফর)৪,৩২,৫১৪২.২৪
ইউনাইটেড পিপলস পার্টি১,৭০,৯৫৫০.৮৯
বাংলাদেশ গণফ্রন্ট১,১৫,৬২২০.৬
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (নুরুর-জাহিদ)৮৮,৩৮৫০.৪৬
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি৭৫,৪৫৫০.৩৯
বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) (বড়ুয়া)৭৪,৭৭১০.৩৯
বাংলাদেশ জাতীয় লীগ৬৯,৩১৯০.৩৬
জাতীয় একতা পার্টি৪৪,৪৫৯০.২৩
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আন্দোলন৩৪,২৫৯০.১৮
জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল২৭,২৫৯০.১৪
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (নাসের)২৫,৩৩৬০.১৩
বাংলাদেশ জনতা দল১৮,৭৪৮০.১
ন্যাশনাল রিপাবলিকান পার্টি ফর প্যারিটি১৪,৪২৯০.০৭
জাতীয় জনতা পার্টি১০,৯৩২০.০৬
বাংলাদেশ লেবার পার্টি৭,৭৩৮০.০৪
পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি৫,৭০৩০.০৩
শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল৪,৯৫৪০.০৩
বাংলাদেশ ডেমোক্রেটিক পার্টি৩,৫৬৪০.০২
বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি পার্টি৩,৩৬৩০.০২
বাংলাদেশ তাঁতি সমিতি১,৮৩৪০.০১
বাংলাদেশ নেজাম-ই-ইসলাম পার্টি১,৫৭৫০.০১
গণ আজাদী লীগ১,৩৭৮০.০১
ইউনাইটেড রিপাবলিকান পার্টি৩৮৯
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক চাষী দল১৩০
স্বতন্ত্র১৯,৬৩,৩৪৫১০.১৯১৬

উনাশির ভোটের প্রেক্ষাপট ও বিতর্ক:

’৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আওয়ামী লীগ দিগভ্রান্ত ও অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। এরপর দেশের ইতিহাস ও রাজনীতিতে ঘটে যায় নানা ঘটনা। এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে দেশের রাজনীতিতে মূখ্য ভূমিকায় চলে আসেন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন তিনি। পরে একই বছরের ৩০ মে আয়োজন করা হয় বাংলাদেশের প্রথম গণভোট।

এই গণভোটে ভোটারদের কাছে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনি কি রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রতি এবং তার দ্বারা গৃহীত নীতি ও কার্যক্রমের প্রতি আস্থাশীল? এই প্রশ্নে ‘হ্যাঁ’ এর পক্ষে ভোটের ফলাফল ছিল ৯৮ দশমিক ৯ শতাংশ। ৮৮ দশমিক ১ শতাংশ ভোটগ্রহণ দেখানো হয়েছিল এই গণভোটে। এ নিয়ে কম বিতর্ক নেই। যা এখনও রাজনীতিবিদদের বক্তব্যে উঠে আসে।

বাঁয়ে হ্যাঁ/না ভোটের ব্যালট, ডানে জিয়াউর রহমান

গণভোটের মাধ্যমে জিয়ার ক্ষমতা বৈধতা পায়। পরের বছরের পহেলা সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করে। প্রতিষ্ঠার এক বছরের কম সময়েরও ব্যবধানে দলটি ক্ষমতার স্বাদ পায়। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়ার আমলে ১৯৭৯ সালের নির্বাচন নিয়ে মূল অভিযোগ হচ্ছে এতে সরকারি দল বিএনপির প্রার্থীদের ব্যাপকভাবে প্রশাসনিক ও আর্থিক সহায়তা প্রদান।

১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে প্রয়াত রাজনীতিবিদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী তার রাজনীতির তিনকাল বইয়ের ১৯০ পৃষ্ঠায় বলেছেন, নির্বাচনী ফল নিয়ে সে সময় দেশে তুমুল সমালোচনা শুরু হয়। নীলনকশা অনুযায়ী এমন নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন একটা সদ্যগঠিত রাজনৈতিক দলের পক্ষে সম্ভব হয়েছে একটি মাত্র কারণে, সেটা হলো দলটির প্রধান দেশের রাষ্ট্রপতি নিজে এবং ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করা।

আব্দুল মালেক উকিল। ছবি: সংগৃহীত।

বিএনপির বিপরীতে আওয়ামী লীগ ছিল বিভক্ত। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা, এরপর ৭৭-এ দলের কাউন্সিলকে ঘিরে বিভক্ত হয় দুই গ্রুপ। ১৯৭৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধন পাওয়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছিলেন আব্দুল মালেক উকিল। আর মিজানুর রহমান চৌধুরী বেরিয়ে পড়ে শুধু ‘আওয়ামী লীগ’ নামে আরেকটি রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন নেন। মোজাফফর হোসেন পল্টুর নেতৃত্বে আরেকটি ভগ্নাংশ বেরিয়ে যায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে। তবে ভোটের মাঠে সুবিধা করতে পেরেছিল আওয়ামী লীগের মূলধারাই। মালেকের নেতৃত্বাধীন এই অংশ ২৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ ভোট পায় ওইবার।

এই নির্বাচনে ইসলামিক দলগুলোর উত্থান লক্ষ্য করা যায়। পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা আমির মাওলানা আব্দুর রহিম ও ছিদ্দিক আহমদ ১৯৭৬ সালে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (আইডিএল) নামে একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলেন। জামায়াত ছাড়াও এই প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হয় ডেমোক্রেটিক পার্টি, নেজামে ইসলাম পার্টি ও খেলাফতে রব্বানী পার্টি। বিএনপি, আওয়ামী লীগের পর আইডিএল থেকেই এই ভোটে জয়ী হয় ২০ জন সংসদ সদস্য। এর মধ্যে ৬ জন ছিলেন জামায়াতের।

এই ভোটের দায়িত্বে ছিলেন একেএম নূরুল ইসলাম কমিশন। জিয়ার আমলে ১৯৭৭ সালের ৮ জুলাই দেশের দ্বিতীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) হিসেবে দায়িত্ব নেন বিচারপতি একেএম নূরুল ইসলাম। তিনি প্রায় আট বছর সিইসি ছিলেন। ১৯৮৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব ছাড়েন। এরপর রাজনীতিতে যুক্ত হন। এরশাদের আমলে আইন, শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর উপ-রাষ্ট্রপতিও হয়েছিলেন একেএম নূরুল ইসলাম।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply