সরকারি সংস্থা জাতীয় তথ্য বাতায়ন জানাচ্ছে, খুড়িয়াখালী গ্রামের জনসংখ্যা দেড় হাজারের কিছু বেশি। সেই দেড় হাজার মানুষের কাছে আরাধ্য সুপেয় পানি পৌঁছে দিলেন রাসেল আহমেদ। এক মাস মাটি কেটে, শারীরিক শ্রম দিয়ে অসাধ্য সাধন করলেন রাসেল। রাসেলের পানি আনার শ্রমের সুবিধা পাচ্ছেন এখন দেড় হাজার মানুষ।
বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার সাউথখালী ইউনিয়ন। একদিকে বন, সাগরমুখী নদ-নদী। অন্যদিকে, লবণের ক্ষত। ২০০৭ সালে আঘাত হানা শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’-এর দাগ এখনও সেখানে বিদ্যমান। সিডরের পর এসব গ্রামের সুপেয় পানির ব্যবস্থা পুরোপুরি নাই হয়ে যায়। পরে সেখানে পানি বিশুদ্ধ করার পদ্ধতি পন্ড স্যান্ড ফিল্টারেশনের (পিএসএফ) ব্যবস্থা থাকলেও তা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বেশিরভাগ সময় অকেজো হয়ে থাকে।
গ্রামের মানুষ ভোগে সুপেয় পানির চরম সংকটে। রাসেল আহমেদ ও তার পরিবারও এর বাইরে থাকে না। তবে নিজে যেহেতু জলবায়ু বিপর্যয়ে উদ্বাস্তু (সিডরে বাড়ির পুকুর, ভিটেমাটি সব হারায়), তাই রাসেলের মনে কষ্টটা বাসা বাঁধে আরও বেশি।
সেই ঘূর্ণিঝড়ের পর খুড়িয়াখালী গ্রামে প্রকট হতে থাকে সুপেয় পানির অভাব। তখন নৌকায় করে দূরের গ্রাম থেকে পাত্র ভরে পানি আনতে হতো। এ প্রসঙ্গে রাসেল বলেন, আমাদের এলাকার ৯৫ শতাংশ মানুষ বৃষ্টির পানির ওপর নির্ভরশীল। কোনোবার খরা হলে খাওয়ার পানি থাকে না। অগত্যা ২০১৯ সালে শুরু করলাম পাশের গ্রাম চালিতাবুনিয়া থেকে খুড়িয়াখালী পর্যন্ত পানি নিয়ে আসার কাজটা। সবাই বলত, এ অসম্ভব। শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়েছে।
চালিতাবুনিয়ার সেই সুপেয় পানির পুকুর থেকে রাসেলদের গ্রামে পানি আনা হয় পাইপের সাহায্যে। সেই পাইপ টানতে হয়েছে কয়েক কিলোমিটার। কীভাবে? মাটি কেটে। রাসেল তীব্র দাবদাহে মাসব্যাপী দিনরাত এক করে শুধু মাটি কেটেছেন। এই দুই গ্রামের মধ্যখানে আছে আরেকটি লবণাক্ত পানির খাল। সেই খালের তলদেশ দিয়ে পাইপ আনতে হয়েছে। কীভাবে? রাসেল আছেন না!
শুরুতে নিজের কোদাল-ঝাঁকা নিয়ে কাজটি একাই শুরু করেছিলেন তিনি। পরে তার দেখাদেখি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন গ্রামের মানুষজন।
প্রথমে পাইপের সাহায্যে পানি এনে ওঠানো হয় রাসেলদের বাড়ির ছাদে থাকা ট্যাঙ্কে। সেখান থেকে পানি টানা হয় রাস্তার পাশের কলে। তবে বিশুদ্ধ পানির চাহিদা শুধু এই একটি মাধ্যমে পূরণ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। তাই তার বাড়িতে বসানো হয় পিএসএফ ও পানি বিশুদ্ধকরণ প্ল্যান্ট। ভূগর্ভস্থ পানিকে বিশুদ্ধ করে তা পানযোগ্য করার প্রক্রিয়ায় রাসেলের কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা ‘ডু সামথিং ফাউন্ডেশন’সহ আরও দুয়েকটি সংস্থা।
রাসেল আহমেদ বলেন, টানা এক মাস চৈত্রের ওই গরমে রোজ মাটি কাটার কষ্ট সেদিন ভুলে গেছেন, যেদিন ওষুধের একটি ছোট শিশি নিয়ে একটা বাচ্চাকে পানি নিতে আসতে দেখেছেন।
সাউথখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইমরান হোসেন বলেন, আমাদের এখানে নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই থাকে। ঝড়, বন্যা বা জলোচ্ছ্বাস যা-ই হোক, রাসেল ছুটে যায়। মানুষের উপকার করা ওর নেশা। এর মধ্যে সবচেয়ে ভালো কাজ যেটা করছে, সেটা পানি আনার ব্যবস্থাটা।
রাসেল আপাদমস্তক একজন ভালো মনের মানুষ। সম্প্রতি এক প্রতিবেশী নিজের বাড়িতে একটা ঘুঘু পাখি পুষছিলেন। রাসেল তাকে অনুরোধ করেন পাখিটিকে খাঁচা থেকে ছেড়ে দেয়ার। লোকটি এতে কর্ণপাত না করলে রাসেল আহমেদ তখন প্রতিবেশীর ভাঙা ঘরটি ঠিক করে দেয়ার শর্তের বিনিময়ে পাখিটি ছেড়ে দিতে বলেন। ঘুঘুটি ছেড়ে দেয়া হয় আর রাসেল নিজের গতর খাটিয়ে প্রতিবেশীর ভাঙা ঘরটি সারিয়ে তোলেন।
সে ঘটনার স্মরণ করে রাসেল বলেন, খাঁচা খুলে দেয়ার পর পাখিটা উইড়া চইলা যাবে, ভাবছিলাম। সেই ঘুঘু কী করছে, জানেন? এতো মানুষ রাইখা আমার মাথার ওপর আইসা বসল। কেন বসল, জানেন? কৃতজ্ঞতা। একটা পাখি যদি ভালোবাসা বুঝতে পারে, মানুষ পারবে না ক্যান?
/এএম
Leave a reply