প্রাণঘাতী নিপাহ ভাইরাসের টিকা প্রথমবারের মতো মানবদেহে পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করেছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। ভ্যাকসিনটির নাম দেয়া হয়েছে চ্যাডঅক্স-ওয়ান নিপাহ’বি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যানডেমিক সায়েন্সেস ইনস্টিটিউট এ টিকা উদ্ভাবন করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে এক বিজ্ঞপ্তিতে তারা টিকা প্রয়োগের বিষয়টি জানিয়েছে।
যেখানে বলা হয়, ১৮ থেকে ৫৫ বছর বয়সী ৫১ জনের শরীরে এই ট্রায়াল চালানো হয়। পরীক্ষা শুরুর কাজের নেতৃত্বে আছে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন গ্রুপ। এই ট্রায়াল আগামী ১৮ মাস ধরে চলবে। বাংলাদেশের মতো নিপাহ-আক্রান্ত দেশগুলোতেও ট্রায়াল চালানো হতে পারে বলে জানায় গবেষক দলটি।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় নিপাহ ভাইরাসের প্রতিষেধক চ্যাডঅক্স-ওয়ান ভ্যাকসিন তৈরিতে ভাইরাল ভেক্টর ব্যবহার করেছে। যেমনটি হয়েছিল অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনা টিকার ক্ষেত্রে।
নিপাহ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সবচেয়ে প্রাধান্যের তালিকায় থাকা একটি রোগ। ক্ষয়ক্ষতির হিসেবে জলাতঙ্কের পরই বেশি ভয়ানক নিপাহ ভাইরাস। এ রোগে আক্রান্ত মানুষের প্রায় ৭৫ ভাগেরই মৃত্যু হয়। তবে জলাতঙ্কের টিকা থাকলেও নিপাহ ভাইরাসের কোনো টিকা বা প্রতিষেধক নেই। তাই এই প্রচেষ্টাকে চিকিৎসক, গবেষক ও জনস্বাস্থ্যবিদরা স্বাস্থ্যক্ষেত্রে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন।
বাংলাদেশ, ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় এই ভাইরাস এক আতঙ্কের নাম। প্রতিবছর বাংলাদেশে এই ভাইরাসে অনেক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ভারতের কেরালায় নিপাহ শনাক্ত হয়। এতে ওই রাজ্যে বেশ কয়েকজন মারা গেলে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা সতর্কতা জারি করে।
নিপাহ ভাইরাস মূলত বাদুড়ের মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকে। তবে ভারতে এটি শূকরের মাধ্যমে ছড়িয়েছে বলে জানায় দেশটি। নিপাহ ভাইরাসে সংক্রমিত প্রাণীর সংস্পর্শে এলে, কিংবা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শের মাধ্যমেও এর সংক্রমণ হতে পারে।
নিপাহ ভাইরাসের টিকার মানবদেহে পরীক্ষার প্রধান এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নাফিল্ড ডিপার্টমেন্ট অব মেডিসিনের অধ্যাপক ব্রায়ান আংগেস বলেন, উচ্চ মৃত্যুহার এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার বৈশিষ্ট্যের জন্য নিপাহ ভাইরাসকে অতিমারি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। টিকার এ পরীক্ষাকে এ সমস্যার সমাধানে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এর ফলে এ রোগের প্রাদুর্ভাব রোধ করা যেতে পারে। বিশ্বকে ভবিষ্যতের অতিমারি থেকে রক্ষা করতে এ টিকা সহায়তা করতে পারে।
তিনি আরও জানান, ২৫ বছর আগে ১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে প্রথম এই ভাইরাস শনাক্ত হয়। কিন্তু এতদিন পর্যন্ত এই মরণঘাতী ব্যাধির অনুমোদিত কোনো টিকা বা প্রতিষেধক ছিল না।
মহামারী প্রস্তুতির উদ্ভাবনের জন্য জোট (সিইপিআই)-এর ভ্যাকসিন রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক ড. ইন-কিউ ইউন বলেন, এ ট্রায়াল স্বাস্থ্যখাতে বিশ্বকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়েছে।
নিপাহ ভয়ংকর বাংলাদেশেও:
বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) নিপাহ ভাইরাসের বিস্তার নিয়ে সার্বক্ষণিক নজরদারি করে। সংস্থাটির তথ্য বলছে, বাংলাদেশে ২০০১ সালে মেহেরপুর জেলায় প্রথম এই ভাইরাস শনাক্ত হয়। এরপর দুই দশকের বেশি সময় ধরে প্রতিবছরই এই ভাইরাসে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে এবং দেশে অসংখ্য প্রাণহানি ঘটছে।
২০০১ সাল থেকে দেশে এ পর্যন্ত ৩৩৯ জন নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে মারা গেছেন ২৪০ জন। অর্থাৎ আক্রান্ত শনাক্ত হওয়াদের মধ্যে ৭০ দশমিক ৮০ শতাংশ মানুষ মারা গেছেন।
আইইডিসিআর বলছে, বাদুড় থেকে ভাইরাসটি ছড়ায়। খেজুরের কাঁচা রসে বাদুড়ের লালা বা মলমূত্র পড়ে এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা চলতি বছর খেজুরের কাঁচা রস পান না করার জন্য আহ্বানও জানিয়েছিল।
/এনকে
Leave a reply