মুরশিদুজ্জামান হিমু ⚫
৫০ বা ৬০’র দশকে গিটার বাজিয়ে গান গাওয়া যায়, অন্তত এই বাংলায় তা হয়ত ভাবতেন না অনেকেই। তবলা-হারমনি তখন কলকাতার মানুষের হৃদয়ে। গিটার তো তখন অনেকটা ভিনদেশি সংস্কৃতির বাদ্য। অনেকে ছুঁয়েও দেখতেন না। ভাবতেন, হয়ত দেশি সংস্কৃতি খেয়ে ফেলবে ছয় তারের এই যন্ত্র। তেমন বৈরী পরিবেশও গিটারের প্ল্যাকিং দিয়ে জয় করলেন অরুনেন্দু নামের এক যুবক।
নাম তেমন জানতেন না কেউ। নাম অবশ্য জানাতেও চাইতেন না। কিন্তু যার ভেতরে সুরের আগুন আছে, সেই শিখাকে দমিয়ে রাখতেই বা কে পারে। তা সম্ভবও হয়নি অবশ্য। অরুনেন্দুর সুর আর গানে ভেসেছেন অসংখ্য বাঙালি। মজেছেন বাংলা গানের এক ব্যতিক্রমী ধারায়। ধীরে ধীরে তার গান ছড়ালো, সুর ছড়ালো। অরুনেন্দু কলকাতায় হয়ে উঠলেন এক অন্য ভাবধারার মানুষ। হয়ে উঠলেন অনেকের অরুন দা।
পুরো নাম অরুনেন্দু দাস। খুব দীর্ঘকায় ছিলেন না। কথাতেও ছিলেন মৃদুভাষী। তবে যা বলতেন, ভেবে বলতেন, বিশ্বাস করে বলতেন। প্রখর স্মৃতিশক্তি সম্পন্ন অরুনেন্দু অনেক ছোটবেলার কথাও গড় গড় করে বলে ফেলতে পারতেন।
অরুনেন্দু দাসের ছেলেবেলা :
তার জন্ম-বেড়ে ওঠাও যেন আরেক গল্পের রসদ। পুরো জার্নি দিয়ে লিখে ফেলা যায় একটি মহাকাব্য। অরুনেন্দু জন্মেছেন মিয়ানমারের রেঙ্গুনে, ১৯৩৮ সালে। সেখানে ছিলেন কিছুটা সময়। তার বাবার নাম যধুলাল দাস। পেশায় তিনি ছিলেন চিকিৎসক। আর মা অমিয়বালা দাস ছিলেন গৃহিণী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন শুরু হল, তখন তার বাবা পরিবার নিয়ে চলে আসেন বাংলাদেশে। বসবাস শুরু করে করেন বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে। সেখানে কেটেছে তার অনেকটা সময়। তারা ছিলেন চার বোন ও দুই ভাই।
এক সাক্ষাতকারে বজ্রযোগিনী গ্রামের বর্ণনা দেন অরুনেন্দু। বলেন, মনে হতো একটা দ্বীপে বাস করছি আমরা। চারদিকে পানি, মাঝখানে ভেসে ওঠা চর। তাদের বাড়ি ছিল টিনের তৈরি। গ্রামটা বড় ছিল। নিজস্ব পোস্ট অফিসও ছিল। তখনও অরুনেন্দুর স্কুলে যাবার বয়স হয়নি। তবে, তার বড় ভাই পড়তেন। আর বোনেরা স্কুলে যেতেন না, কারণ মেয়েদের কোনো স্কুলই ছিল না।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অরুনেন্দু বলেন, একেবারে প্রত্যন্ত গ্রাম যাকে বলে। পাশাপাশি ঘরে থাকতেন তার অন্য চাচারা। কিন্তু রান্নাঘর ছিল একটাই। যেটির প্রধান ছিলেন আবার অরুনেন্দুর দাদী। এরপর বাবার চাকরিসূত্রে কখনও ঢাকায়, কখনও ভারতের রাজস্থানে থাকেন অরুনেন্দু। লেখাপড়া চলে, সাথে মাথায় চলে গানের চিন্তা।
শেষ পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন স্থাপত্য বিষয়ে। এর ফাঁকেই চলেছে গান রচনা। শুরুতে প্যারোডি গান রচনা করতে ভালোবাসতেন। তার বন্ধুরাও সেই প্যারোডি গেয়ে মজা পেতেন।
কিছুটা নিভৃতচারী এই মানুষটি কখনও গানকে পেশা হিসেবে নেবেন, তা ভাবেন নি। তবে সে সময় হেমন্ত-সতীনাথ-মানবেন্দ্ররা তাকে চরমভাবে আন্দোলিত করেছিল।
অরুনেন্দুর বিদেশযাত্রা ও গানের ভাবনায় পরিবর্তন:
ষাটের দশকে অরুনেন্দু চলে যান বিলেতে। সেখানে তিনি ইংরেজি গান দ্বারা অত্যন্ত প্রভাবিত হন। তার চিন্তাধারায় ব্যাপক পরিবর্তন আনে নতুন শোনো সব গান। অক্সফোর্ডশায়ারের স্থপতি হিসেবে ছিলেন। তিনি একটি ফোক ক্লাবে যোগ দেন। সেখান থেকে গিটারের অনেক কিছু আয়ত্ব করেন অরুনেন্দু।
পাশ্চাত্য মিউজিক তখন শুনতেন, কিন্তু সবসময় মন-মননে ছিল বাংলা সঙ্গীত। চেষ্টাও করতেন প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মিশেল ঘটানো যায় কীভাবে। সেই চিন্তাই পরবর্তীতে অনেক কিছু দেয় বাংলা সঙ্গীতকে। বলা যায়, একটা বিরাট পরিবর্তন আসে অরুনেন্দু দাসের হাত ধরেই।
মহীনের ঘোড়াগুলি ও অরুনেন্দু:
অরুনেন্দু নীরবে-নিভৃতে গান করে গেছেন। কিন্তু জহুরির চোখ অরুনেন্দুকে ঠিকই খুঁজে নিয়েছে। বলছি, মহীনের ঘোড়াগুলির গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের কথা। ব্যান্ডেরই এক সদস্য বুলার (প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়) মাধ্যমে অরুনেন্দুর সঙ্গে সাক্ষাত গৌতমের।
এর পরেরটা ইতিহাস। মহীনের ঘোড়াগুলির সম্পাদিত চারটি অ্যালবামে প্রকাশ পায় অরুনেন্দুর গান। অনেকে ভাবতেন অরুনেন্দু হয়ত মহীনের ঘোড়াগুলির ঘোড়া। কিন্তু তিনি কখনই ওই ব্যান্ডে নাম লেখাননি।
‘আবার বছর কুড়ি পরে’ অ্যালবামে ‘গঙ্গা’ নামে একটা গান লেখেন অরুনেন্দু। ‘ঝরা সময়ে গান’ এ মেলে এক মাস্টারপিস। অরুনেন্দু লিখে ফেলেন,
‘’যাস কোথা তুই কিসের এত তাড়া
কেন নিস না কানে বলছি একটু দাঁড়া
চৈত্রবেলার কৃষ্ণচূড়া ফুল
ফাগুন খেলায় মেতেছে আকুল
মাতাল কোকিল বসন্ত কুহু তানে
পাগল হাওয়ায় কোন্ সে দোলা আনে
প্রাণে কি তোর পাস্ না কিছুর সাড়া
কেন নিস্ না কানে বলছি একটু দাঁড়া।।‘’
‘কিসের এত তাড়া’ গানটি সে সময় নাড়া দেয় অনেক সঙ্গীতপিপাসুর মন।
পরবর্তীতে গান ছিল ‘মায়া’ এবং ‘ক্ষ্যাপার গান’এও। সেখানে ‘তাই জানাই গানে’ তো রীতিমত সুপারহিট গান। এখনও বৈঠকী আসরে এই গান অনেকের পছন্দের তালিকার শীর্ষে।
এছাড়াও ‘কী লাভ কেঁদে’, ‘দিশেহারা যে মোর মন’ ‘কেটে গেছে কত না বছর’, ‘মনে কী পড়ে’, কেনো কাঁদি’র মতো অনেক গান এসেছে অরুনেন্দু দাসের কাছ থেকে।
মূলত হাওয়াইন গিটার বাদক হিসেবে বেশি পরিচিত ছিলেন সকলের প্রিয় অরুন দা। অনেকে বলেন, মডার্ন মিউজিক যে কয়েকজনের হাত ধরে বাংলায় এসেছে, তার একজন তিনি। সঙ্গীতপাগল এই মানুষটি পৃথিবীর মায়া ছেড়ে যান ২০১৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি।
এই লোকটিকে নিয়ে কখনই তেমন মাতামাতি ছিল না। কোনো বাহ্যিক আলোয় আলোকিতও হননি। তার অবশ্য দরকার ছিল না। যে আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন অরুনেন্দু, বাংলা মিউজিকই তো তাতে জ্বল জ্বল করছে।
/এমএমএইচ
Leave a reply