ভোলাগ্রাম থেকে গুলশান: ‘ভদ্রপল্লীতে থাকেন ঈশ্বর’

|

শাকিল হাসান:

গুলশান দেশের সবচেয়ে অভিজাত এলাকা। এ নিয়ে কারও কোনো সংশয় নেই। কিন্তু এই গুলশানের পেছনের গল্পটি কি কেউ জানেন? এ বিষয়ে যমুনা নিউজের কথা হয় এমন একজনের সঙ্গে, যিনি ছয় দশক আগে ছিলেন এই এলাকার বাসিন্দা। ষাটের দশকে বীর প্রতীক মোজাম্মেল হকের পরিবারের এখানে ছিল বসত ঘর, কৃষি জমি।

মোজাম্মেল হক বলেন, আগে যখন এটার নাম ভোলাগ্রাম ছিল, তখন এই এলাকা ছিল উন্নত গ্রাম। এই গুলশানের কাঁঠাল বাংলাদেশের সবচেয়ে সুস্বাদু কাঁঠাল ছিল।

সেইসব দিন এই এলাকাটি পেরিয়ে এসেছে বহুদিন আগেই। এখন ভোলাগ্রামে কাঁঠাল গাছ খুঁজে পাওয়াই কঠিন। বীর প্রতীক মোজাম্মেল হক বলেন, এই গুলশান অথবা পুলিশ ক্লাব থেকে টানা ৩২ বিঘা জমি (নদীর ঘাট পর্যন্ত) ছিল আমার দাদার।

১৯৬১ সালে ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের (বর্তমানে রাজউক) প্রধান পাকিস্তানি আমলা জিএ মাদানি আবাসিক এলাকা তৈরির জন্য এই এলাকাটিকে বেছে নিয়েছিলেন। নাম দিয়েছিলেন– গুলশান।

এদেশে নামকরণের প্রবণতা হিসেবে এই এলাকার নাম হওয়ার কথা কাঁঠালবাগান বা কাঁঠালতলা। যেহেতু একসময় এখানে কাঁঠাল হতো। কিন্তু পশ্চিমা আমলারা পাকিস্তানের করাচির অভিজাত এলাকার সঙ্গে মিলিয়ে এই জায়গার নাম রাখেন গুলশান। যার অর্থ ফুলের বাগান। যদিও ছয় দশক পরে এই এলাকায় ফুলের বাগান বা কাঁঠালবাগান কোনোটিরই দেখা মেলে না।

কিন্তু এই জায়গার নাম পাকিস্তানের একটি এলাকার সঙ্গে মিলিয়ে রাখার কারন কী? গবেষক ও ইতিহাসবিদ ড. মেজবাহ কামাল বলেন, পাকিস্তানিদের ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের কনসেপ্ট অনুযায়ী বিভিন্ন স্থানের নামকরণ করে জনগণের চৈতন্যে পরিবর্তন আনতে চেষ্টা করেছে তারা। এভাবে করাচির অভিজাত এলাকার নামের সাথে মিল রেখে ঢাকার ভোলাগ্রামের নামও দেয় তারা ‘গুলশান’। এই নাম পরিবর্তনের মাধ্যমে জনগণের মাঝে একটা বিশেষ মনস্তত্ত্ব তৈরি করার চেষ্টা ছিল।

আবাসিক এলাকা হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর এখানে প্লট বরাদ্দ দিতে শুরু করে ডিআইটি। আমলা ও ব্যবসায়ীরা প্লট বরাদ্দ নিয়ে বসবাসের জন্য বাড়ি তৈরি করতে থাকেন। তখন এলাকাটি ছিল ছিমছাম, ছায়াঘেরা। আবাসিক এলাকা হিসেবে তৈরি হলেও আশির দশক থেকে এখানে তৈরি হয় বহুতল ভবন। রাজধানীর আকাশছোঁয়া ভবনগুলো এখন তৈরি হয়েছে গুলশান অ্যাভিনিউয়ের দুপাশে।

ঝাঁ চকচকে আধুনিক ভবনগুলোর বেশিরভাগই তৈরি হয়েছে গত এক দশকে। বহুজাতিক কোম্পানি আর ব্যাংকগুলোর কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে এসব ভবন। এছাড়া, এখানে আছে পাঁচতারকা হোটেল, শপিং মল। দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যের এই ভবনগুলো এখন পরিণত হয়েছে গুলশানের ল্যান্ডমার্ক হিসেবে। আলিশান গুলশানের চাকচিক্যে ভরা জীবন চোখ ধাঁধিয়ে দেবে যে কারও। এখানে হরহামেশাই চলে বিলাসবহুল ব্র্যান্ডের নতুন মডেলের গাড়ি।

গুলশানে আভিজাত্যের পাশাপাশি জীবন যাপনের লড়াইও চলে। খাওয়ার খরচ কমাতে এখানেও আছে টঙ দোকান। আবাসিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করা হাজারও মানুষ এখানে আসেন শুধুই জীবিকার তাগিদে। সড়কে কোটি টাকার গাড়ির পাশে ফুটপাতে অল্প টাকার পুঁজিতে ব্যবসা করে সংসার সামলানোর সংগ্রাম করে যাচ্ছেন ইউনুসের মতো অনেকে। তিনি বলেন, গুলশান মানেই যে বড়লোকের কারবার, ব্যাপারটা এমন কিছু না। এখানে বিভিন্ন কোয়ালিটির মানুষ যেমন আছে, তেমনি বিভিন্ন পেশাজীবীও আছে। আরেকজন বলেন, গুলশান হচ্ছে অনেকটাই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের মতো– ‘ঈশ্বর থাকেন ওই ভদ্রপল্লীতে’।

দিনের শেষে রাত নামে, আর গুলশানের জৌলুশ বাড়ে। অন্ধকার ভেদ করে আলোর রোশনাই ফোটে। দামি গাড়ির হেডলাইট আর স্কাইস্ক্র্যাপারের আলোক সজ্জা চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। ক্লাব, পার্টি সেন্টারে বাড়ে সমাগম। জেগে ওঠে আরেক গুলশান। যেখানে জীবন শুধুই উদযাপনের।

/এএম


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply