সাজ্জাদ হুসাইনের পরিভ্রমণ অনেকটাই বিচিত্র। পরজন্মে যিনি হাঁস অথবা পাখি হতে পারেন। জন্মাতে পারেন সাজ্জাদ হুসাইন বেশেও। লেখার জন্য নিয়তির নিঠুর ভেলায় চড়তে রাজি যিনি। তাই কখনও ঢুকে পড়েন মেঘ-কুয়াশা অথবা অন্তরাত্মার খোঁজে। রচনা করেন ‘অঞ্জনযাত্রা’, ‘কবীরা’ কিংবা ‘সৌমিত্রাক্ষর’। রূপালি জগত মোহবিষ্ট করে তাকে। মহীনের ঘোড়াগুলির সুলুক সন্ধানে বছর তিনেকের যাত্রা শেষে লেখেন ‘মহীনের ঘোড়াগুলির গান’। তার লেখালেখি, লেখার দর্শন, জীবনকে দেখার অভিজ্ঞতা ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গে কথা হয় বইমেলায় ‘ছাপাখানার ভূত’ প্রকাশনীতে। আড্ডায়-আলোচনায় উঠে আসে তার ভবিষ্যত চিন্তা প্রসঙ্গও। লেখকের সঙ্গে কথা বলেছেন আল মাহফুজ।
যমুনা অনলাইন: এবারের বইমেলায় আপনার কী কী বই বের হচ্ছে?
সাজ্জাদ হুসাইন: দুটি আত্মকথনমূলক গ্রন্থ। ‘মম চিত্রে গীতি নৃত্যে’ (মমতা শঙ্কর) ও ‘পথিকার’ (শাফিন আহমেদ)।
যমুনা অনলাইন: নেক্সট প্রজেক্ট কী?
সাজ্জাদ হুসাইন: এই যে বের হলো দুটো। যা বের হয়নি, তা নেক্সট প্রজেক্ট না। চলমান প্রজেক্ট।
যমুনা অনলাইন: ‘ছাপাখানার ভূত’ চার বছর ধরে বইমেলা করছে। এখানে আপনাদের রেসপন্স কেমন?
সাজ্জাদ হুসাইন: বইমেলাটাকে একটা মঞ্চের মতো ধরতে পারেন। সরাসরি ইন্টারেকশন হয় এখানে। আমরা আমাদের পাঠক দেখেছি কলকাতায় বা ঢাকায়। একটু আগে একজন এসে বললো, দু’তিন দিন পর এসে আমাদের কিছু বই কালেক্ট করবে। আমাদের প্রকাশনার সাথে পরিচিত যে পাঠক, তারা আসলে বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে বই কিনে নেয়। আর মেলাতেও ভালো দেখা হয় সেটা। তো আপনার প্রশ্ন যেটা ছিল– রেসপন্স মাসব্যাপী একটা উৎসবের মতো হয়। সেখানে কিছু মানুষের পরিকল্পনা থাকে। মেলায় এসে বইটা কিনবে। সেই জায়গা থেকে একটা যোগাযোগ হয় পাঠকের সঙ্গে।
যমুনা অনলাইন: দেখা যায় যে, বইয়ের প্রচারণার জন্য অনেকেই বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেন কিংবা বিজ্ঞাপন দেন। সেই অর্থে আমরা ছাপাখানার ভূতের কোনো ক্যাম্পেইন দেখি না কেন?
সাজ্জাদ হুসাইন: এটা খুব ভালো প্রশ্ন করেছেন। এখন উত্তর দিতে ইচ্ছা করছে। অনেকেই ভুলভাল প্রশ্ন করে, উত্তর দিতে ইচ্ছা করে না। এটা (ক্যাম্পেইন) নিয়ে আসলে আমার কোনো আগ্রহ নেই। তো যেটা হচ্ছে, পৃথিবীটাই হয়তো উল্টো হয়ে গেছে। আমি জানি না, কেউ মৃত্যু থেকে আবার জন্মাবে কিনা মানে মৃত্যুটা আগে হবে, জন্মটা পরে হবে কিনা। এরকম হতে পারে হয়তো।
যমুনা অনলাইন: ‘দ্য কিউরিয়াস কেইস অব বেঞ্জামিন বাটন’ নামে এমন একটা সিনেমা দেখেছিলাম (স্কট ফিৎজেরাল্ডের ছোটগল্প অবলম্বনে সিনেমাটা নির্মাণ করেন ডেভিড ফিঞ্চার)।
সাজ্জাদ হুসাইন: সিনেমাটা আমি দেখিনি। কিন্তু আমার মনে হয় ঘটনাটা এখন এরকম– পাঠক জানে না, লেখক কে। লেখক জানে না, পাঠক কে। মানে সর্বত্র একটা অন্ধত্ব চলছে। অপমানজনক একটা অবস্থা চলছে আর কি। তো সেই জায়গা থেকে আমি.. হয়তো আমাদের বইয়ের দাম নিয়ে কথা হয়। প্রোডাকশনটা ভালো করতে গেলে দামটা ভালো রাখতে হয়। আর শুধু কি বইয়ের মূল্য? একটা বইয়ের জন্য তিন-চার বছর ধরে কষ্ট করা, একটা ক্রিয়েটিভ ক্রাইসিসের মধ্য দিয়ে যায়। তো সেই জায়গা থেকে আমি যেটা চাই বা ভবিষ্যতেও চাইবো– লোকে এই মোটা বইগুলো দাম দিয়ে কিনে পড়ুক। উপলব্ধি করুক, সে ঠকলো নাকি তার সাথে আমার একটা যোগাযোগ হলো।
আপনি যদি কারও সাথে সম্পর্কে জড়াতে চান, সেটা কিন্তু হতে হবে আদান-প্রদানের মাধ্যমে। তো হঠাৎ করে কেউ যদি বন্ধুর মাধ্যমে নাম শুনে কোনো বই কিনে বাড়িতে ফেলে রাখে, তাতে আদান-প্রদান কি হলো? কন্টেন্টের সাথে দাম একটা সম্পূরক যাত্রায় প্রবাহিত হয়। এই জায়গা থেকে কেউ কিন্তু ভুল করে পনেরশ টাকা দিয়ে বই কিনবে না। সে বুঝুক, এটা তার দরকার। কেন দরকার, সেই এনালাইসিসটা করুক। প্রশ্ন করুক নিজেকে, বইটা আমি কেন পড়তে চাই? বইটা আমাকে কী দিচ্ছে? এই প্রশ্ন সম্ভবত আমাদের অধিকাংশের মধ্যে জাগে না। ‘চেহারা দেখলাম, অটোগ্রাফ নেয়ার সারি দেখলাম, সেখানে ঢুকে পড়লাম সিনেমা হলের লাইনের মতো।’
১৪-১৫ ঘন্টার একটা ইন্টারভিউ ট্রান্সক্রিপ্ট করা, কলমে তোলা এবং দাঁড়ি কমাসহ এটা করা ভীষণ দুরূহ কাজ। আমি সেই অমানুষিক যাত্রায় নেমেছি। অনেককেই দেখেছি, এটাতে ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। তবে আমি বিশ্বাস করি, কেউ না কেউ হয়তো আসবে। আমি একা তো সব কাজ করব না। তো সেই জায়গা থেকে আপনি যেটা বললেন, সেটার উত্তর হলো– প্রথমত আমি চাই, পাঠক আমার লেখা পড়ুক এবং অবশ্যই কিনে পড়ুক।
খুব পরিচিত মানুষও যদি আশা করে আমার বই উপহার হিসেবে পেতে, আমি সবিনয়ে তাদের বুঝিয়ে দেই– আমার বই পড়তে হলে দাম দিয়ে পড়তে হবে। এক পৃষ্ঠাও যদি পড়তে হয়, সেটার একটা দাম আছে। আমি মনে করি, প্রত্যেকটা রাইটারের এটা করা উচিত। ফেসবুক বা নানা জায়গায় দেখি, লেখক বই উপহার দিচ্ছেন; এটা আমার কাছে একটু প্রশ্নবিদ্ধ মনে হয়। এটার কারণে আমাদের এখানে পেশাদারিত্বটা তৈরি হচ্ছে না। পাঠক না পড়লে আমি প্রয়োজনে বাসার তাকে বই সাজিয়ে রেখে দেব। কিন্তু কেউ যদি প্রয়োজন অনুভব করে বইটা পড়তে চায়, তাহলে যথাযথ দাম দিয়েই বইটা কিনতে হবে। আর যদি না কেনে, তাহলে ছুঁড়ে ফেলবে। কাল বা মহাকালে আমার কোনো চিহ্ন থাকবে না। ফলে সেটা মেনে নেয়াই ভালো।
আমাদের ছয় বছরের যাত্রা। সবচেয়ে এক্সাইটিং লাগে, যখন পাঠক বইটা কেনে অথচ আমাকে চেনে না। জিজ্ঞেস করে, সাজ্জাদ হুসাইন কে? এটা কলকাতাতে হয়, এখানেও হয়।
আল মাহফুজ: আমিও এ প্রসঙ্গেই আসছিলাম।
সাজ্জাদ হুসাইন: পাঠক যখন জানে, তার আবেগের কথা বলে। কেউ আমার দুটো বই পড়েছে, কেউ চারটা পড়েছে। বইমেলায় এসে সমস্ত বই কিনে নিয়ে গেলো। আমি কিন্তু অবাক হয়েছি। সত্যিকার অর্থে আমার মনে হয়, এখনও সেই সময়টা আছে পৃথিবীতে। সময়টা বদলে যায় না আসলে। আমরা সবসময় ফাঁকির অজুহাত খুঁজি, শর্টকাটে কীভাবে তারকা হওয়া যায়। মানে একজন লেখক তো শাহরুখ খান নয়। লেখকের উইন্ডোটা আলাদা আর একজন চিত্রনায়কের পটভূমিটা আলাদা। সুতরাং লেখকের একটু আস্তে ধীরে হাঁটতে হবে।
জীবনানন্দ দাশ হেঁটে হেঁটে স্বীকৃতি না পেয়ে চলে গেছে। তাতে জীবনানন্দ দাশের কিছু যায় আসে না। কিন্তু জীবনানন্দ জানে, পাঁচ হাজার বছর পৃথিবী যদি টিকে থাকে, তাহলে ৫০০ বছর পরের জন্য সে লিখছে। সেই প্রস্তুতিটা, এই নির্মমতা জীবনানন্দকে ট্রামের মধ্য দিয়ে একটা মৃত্যুর পথে নিয়ে গেছে। লেখকের এই নির্মমতার জায়গাটা থাকতে হয়। যেটা হয়তো তার সন্তান কখনও বোঝে না। লেখকের প্রধান সম্পদ হচ্ছে তার পাঠক। তার স্ত্রী-সন্তান-প্রেমিকা তার কোনো অস্তিত্ব নেই। লেখককে ‘বার্ডস আই’ অর্থাৎ ওপর থেকে পাখির চোখ দিয়ে দেখতে হবে। ছোট ব্যাঙের চোখ দিয়ে দেখলে সেটা আসলে বই, কাগজ ও কিছু নামকরণের শ্রাদ্ধ হয়ে থাকবে।
আসলে বড় পথে হাঁটতে হলে প্রসেস এটাই। আমি যে বড় পথ হাঁটছি, সেটা নয়। কিন্তু আমি ফিল করছি, আমি এইভাবে যাব। তাতে যা পেয়েছি, আমার কাছে অনেক। আমাকে কেউ ওইভাবে চেনে না। আমি ওইভাবে থাকতে পছন্দ করি। না হলে আমি এফোর্ট করতে পারব না। এখানে যদি একটা লম্বা সিরিয়াল থাকে, ওইভাবে আমি বই বেচতে পারবো না। আমার পাবলিশিং নিয়ে আমি যেমন ভাবি, ফেসটাকে যদি সামনে নিয়ে আসি, তাহলে সেটার কিছু বিড়ম্বনা ও ক্ষয়ক্ষতি আছে। সেটি সামাল দিতে গিয়ে আমার বইগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফলে আমি আমার একটা পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছি। সেটা লোকে পড়ছে, সেকেন্ড-থার্ড এডিশন হয়ে গেছে। অধিকাংশ বই দ্বিতীয় মুদ্রণের দিকে চলে গেছে। তো এটা অনেক বড় আমার জন্য।
যমুনা অনলাইন: এখন ‘এটেনশান ইকোনমি’ বলে একটা টার্মের উদ্ভব হয়েছে। মানুষের পাঠের অভ্যাস হ্রাস পাচ্ছে। মনোযোগ বা অ্যাটেনশন দেয়ার ক্ষমতা কমে গেছে। মানুষ খুব অস্থির হয়ে যাচ্ছে। তো এখান থেকে দেখা যাচ্ছে যে ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়া মানুষের এই মনোযোগ তাদের দিকে টানার চেষ্টা করছে। তাতে পাঠের মনোযোগ আরও বেশি সরে যাচ্ছে। সেখানে ইন ডিটেইলে আপনার এই ঢাউস আকৃতির বই লেখা কি একটু সংগ্রাম করে যাওয়ার মত হয় কিনা?
সাজ্জাদ হুসাইন: সংগ্রাম মানে…
যমুনা অনলাইন: মানে একটু উল্টো পথে হাঁটা?
সাজ্জাদ হুসাইন: আমি একটু আগে বলছিলাম, যে সত্যিকারের পাঠক, সে বইটা কিনবে। এখন ফেসবুকে যেটা হচ্ছে…। দেখেন, নতুন একটা মিডিয়াম আসবে, সেটাকে নিয়ে নানা রকম গবেষণা হবে। এটাকে কেউ কেউ অপব্যবহার করবে, কেউ কেউ সেটার ভালো দিকগুলো কাজে লাগাবে। এই যে ‘ছাপাখানার ভূত’ ফ্রন্টলাইনে এসেছে, সেটা একটা ফেসবুক পেইজের মাধ্যমে। সেটা তো একটা পজিটিভ দিক। কিন্তু আমরা সবসময় যেটা এনকারেজ করতে চাই, সেটা হচ্ছে– বই একজন মানুষের জীবনের অধিকাংশ পরিভ্রমণ। সেই জীবনগুলো যাতে অনুপ্রেরণা হয়ে আসে। আমরা তো এক লাইনেই…
আমি ১৮ বছর টেলিভিশনে কাজ করেছি। টেলিভিশনের সীমাবদ্ধতা আমি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানি। আপনি যৌনতা বা এরকম অনেক কিছু নিয়ে প্রশ্ন করতে পারবেন না। ‘আমার আমি’ নামে একটা প্রোগ্রাম করেছি আমি। ২০১১ থেকে ১৩ বছর এটা আমি করেছি। সেখানে আপনি প্রেম নিয়ে প্রশ্ন করলে খুব অ্যাবস্ট্রাক্ট উত্তর পাবেন। অ্যাকসেপ্ট করার সেই চর্চাটার মধ্য দিয়ে আমাদের সমাজ এখনও যায়নি। ফলে টেলিভিশনে আমি যেটা প্রকাশ করতে পারিনি, যেটা আমার অনেক বড় অনুসন্ধানের জায়গা– আমি আপনার সম্বন্ধে জানতে চাই।
এখন আপনি যদি বলেন যে, এই জিনিসগুলো আমি বলতে চাই। এর বাইরের কিছু বলবো না। তাহলে আপনার জীবন সম্বন্ধে আমার জানার কোনো আগ্রহ নেই। বাউল বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল, এটাই কি তার জীবনের একমাত্র অংশ? তার স্ত্রী থাকতে পারে, সন্তান থাকতে পারে। তারও তার জন্য একটা কান্না থাকতে পারে। আধ্যাত্মবাদ তার সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে পারে, অলৌকিকতা থাকতে পারে। তার পরজন্ম নিয়ে পরলৌকিকতা নিয়ে নতুন ধরনের কোনো ব্যাখ্যা থাকতে পারে। তাকে জানতে হলে সেই পথ দিয়ে লালনকে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। অনুসন্ধানটা ওই জায়গায় নিতে হয় আমাকে। এখন আমি শুধু দেখলাম তাকে, তার বড় বড় লম্বা চুল আছে, সে হয়তো দাড়ি রেখেছে, একটা গেরুয়া কৌপিন পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঐটা তার বহির্বাস, আসল বাউল না। অন্তরের বাসটা গুরুত্বপূর্ণ। এটা খুব কমন কথা।
আমি অঞ্জন দত্তের কাছে গেছি। কবির সুমন বা শাফিন আহমেদ, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, মহীনের ঘোড়াগুলির কাছে গেছি। আমার উদ্দেশ্য থাকে, অন্তত ৮০ ভাগ থেকে ৯০ ভাগ আমি নিংড়ে বের করব। এর কম হলে এর মধ্যে ঢুকবো না। আমি যদি বুঝি, সে ৮০ ভাগের কম আমাকে ধরা দেবে, তাহলে আমি এর মধ্যে ঢুকব না। সে জীবন যতই বর্ণাঢ্য হোক, আমি ঢুকব না। কারণ, মানুষের একটা ইনটেন্স জায়গা থাকে, যেটা আবিষ্কার করা যায় না। ‘আপনার’ বলে কিছু থাকে প্রত্যেক মানুষের, সেটা একান্তই আপনার। সেই জায়গায় অন্যের অনুপ্রবেশ নেই, আমি জানি। তাহলে আমার ঈশ্বর হয়ে যেতে হবে হয়তোবা।
আমি জানি না, হয়তো সবকিছু দেখার ক্ষমতা থাকতে হয়। সেটার হয়তো একটা চর্চা থাকতে পারে। কিন্তু একজন শিল্পীকে বাঁচতে হলে তারও ২০ ভাগ দিতে হয়। যেহেতু আমার অধিকাংশ শিল্পীর জীবন, সেই ৮০ ভাগটা আমাকে যারা যারা দিয়েছে, আমি উপলব্ধি করেছি। আমি যে পথে এগোতে চেয়েছি, সেটাও বুঝেছি। এই ধরনের যাত্রাতে (জীবন নির্ভর কাজ) আমার একটু ক্লান্তি চলে এসেছে। আমি অলরেডি অন্য পথ নিয়ে ভাবছি। হয়তো জীবন নির্ভর কাজ আমার এই বছরেই বেরোবে। হয়তো আমি কালে-ভদ্রে করতে পারি। আমার লেখার চক্রটা একটু পূর্ণতার দিকে যাচ্ছে। সেটা আমার নিজস্ব অভিব্যক্তি।
যমুনা অনলাইন: একজন লেখক হিসেবে সাজ্জাদ হুসাইনের ফিলোসোফি নেপথ্যের আড়ালে থাকা। পাদপ্রদীপের আড়ালে থাকতেই পছন্দ করেন সাজ্জাদ হোসাইন। কিন্তু তার লেখার অনুষঙ্গ, লেখার সাবজেক্ট-ম্যাটার হয় তাদের নিয়ে, যারা পাদপ্রদীপের সম্মুখে বা কেন্দ্রে। এটার কারণটা কী?
সাজ্জাদ হুসাইন: এটার কারণটা হচ্ছে, আমার যে খামতিটা আছে..। আরেকটা জিনিস খেয়াল করলে দেখবেন– যাদেরকে নিয়ে আমি কাজ করেছি, প্রত্যেকের নিজস্ব একটা গভীরতার জায়গা আছে। সে হয়তো সিনেমার লোক কিন্তু ব্যক্তিত্বের জায়গা থেকে তার আলাদা একটা জায়গা আছে। এছাড়াও, তার সাথে আমার রিলেটটা করতে হয়। আমি অঞ্জন দত্তের ‘রঞ্জনা আমি আর আসব না’, ‘দত্ত ভার্সেস দত্ত’ দেখেছি। আমি কিন্তু তার ‘বেলা বোস’ শুনে ইন্সপায়ার্ড হইনি। ইন্সপায়ার্ড হয়েছি তার সিনেমা দেখে।
যমুনা অনলাইন: সিনেমা বলতে? মৃণাল সেনের সিনেমা?
সাজ্জাদ হুসাইন: সবকিছু। অনেক সিনেমা দেখেছি অঞ্জনদার। গান তো শুনেছিই। গান আলাদা করে কষ্ট করে খুব একটা শুনতে হয় না। সিনেমা দেখার জন্য হয়তো সেটা কালেক্ট করতে হয়। তো সিনেমা দেখে এক্সপার্ট হয়েছি। ন্যাচারালি অঞ্জন দত্তকে আমি খুঁজতে গিয়েছি। ওইটা দ্বিতীয় কারণ। সে আমাকে কতটা ইন্সপায়ার্ড করতে পারছে, এটাই প্রথম। আমার যদি মনে হয়, জনি ডেপ বা শাহরুখ খান আমাকে ইন্সপায়ার্ড করছে, আমি চলে যাব তাদের কাছে। যদি আমার কাছে মনে হয় আর কি। সেই মানুষটা এমন একটা জগতে থাকতে পারে, যে জগৎটা হয়তো ফ্রন্ট লাইনের, হয়তো পর্দার লোক বা গানের লোক; কিন্তু এই লোকটাকে নিয়ে যখন আমি কাজ করি, তখন আড়ালে থাকতে সুবিধা হয়। ওই সুবিধাটা আমি আসলে নিই।
আমার ফিকশন করার যে প্রস্তুতি, সেটারই মহড়া হচ্ছে আমার এই কাজ। কারণ, ফিকশনে চরিত্রগুলোকে নতুন নতুন রঙ দেয়া যায়। এখানে (আত্মকথনমূলক কাজে) আমি শুধু সংযোগ স্থাপন করতে পারি। সে তার কথাটা শেষ করলো, আমি আরেকটা সেতু দিয়ে তার পরের কথার রাস্তা তৈরি করে দিতে পারি। এখানে আমার সত্যকে পাল্টে দেয়ার কোনো ক্ষমতা নেই। কিন্তু ফিকশনে আমি সেটা করতে পারব। ওইটাই আমি করতে চাই। লেখা নিয়ে যেটা আমি বললাম– আমার অন্যদের মতো অটোগ্রাফ দেয়ার, পাঠকের লম্বা লাইন তৈরি করার ম্যাজিকটা নেই। আমি অ্যাফোর্ড করতে পারবো না। আমার এই রাস্তাটা মাঝেমধ্যে মনে হয় ভীষণ কঠিন। কঠিন মানে যখন কাজ চলতে থাকে, ফাইনাল স্টেজে যখন বইটা থাকে।
‘অঞ্জনযাত্রা’ আমাদের প্রথম বই কিন্তু বিক্রির দিক থেকে সবচেয়ে ওপরের দিকে। তখন ওই কষ্টটা আসলে কষ্ট হিসেবে আমার কাছে পরিগণিত হয় না। তখন মনে হয়, যা করছি, ঠিকঠাক আছে। একটু কান্না পাবে, বন্ধুর পথ হাঁটতে গিয়ে একটু তো কষ্ট হবেই। পা হয়তো কেটে যাবে, মচকেও যেতে পারে। পরজনম আদৌ আছে কিনা, আমি জানি না। আমি হয়তো সেই জনমে হাঁস হবো অথবা পাখি হবো। নাকি সাজ্জাদটাই হবো? যেহেতু এই সুযোগটা আমি পেয়েছি, সেই সুযোগটাকে আমি সর্বোচ্চ এক্সপ্লয়েট করতে চাই। ‘এক্সপ্লয়েট’ আমি পজিটিভ অর্থে বললাম।
যমুনা অনলাইন: আপনার জীবন নির্ভর লেখাগুলোতে দেখা যায়, প্রায় সবাই শোবিজ জগতের মানুষ। কিন্তু শোবিজের বাইরে যেমন ধরেন বাউলিয়ানা, দর্শন বা সাহিত্য; এগুলো নিয়ে আপনার কাজ করার ইচ্ছা আছে কিনা?
সাজ্জাদ হুসাইন: আমি পূর্ণদাস বাউলকে নিয়ে কাজ করেছি বাউলকে জানার জন্য। ‘পূর্ণচন্দ্র ধাম’ বইটা এখানে আছে। আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে, ষাটের দশকে বব দিলান বা রোলিং স্টোনের সাথে তার জার্নি আছে (বব ডিলান যে অনেক বড়, সেটা আমি বলছি না)। একজন বাউল মাধুকরি থেকে সহজ বাংলায় বললে গান গাইতে গাইতে ভিক্ষা করতো। লোকজন চাল দিতো। কোন টাকাও নেই। বাড়ির যারা গৃহিণী, তারা হয়তো একটা কলা দিলো বা আধা কেজি চাল দিলো। সেটা দিয়েই এক ভিন্ন রকম জীবনে পদার্পণ করলো। এই মানুষটা পৃথিবীর প্রায় সমস্ত (১৬৫টার মতো) দেশে গান নিয়ে ঘুরেছে। তো এটা জানতে গিয়ে আমি ইনস্পিরেশন পাই। আপনি যেটা বলছেন, শুধু বাউল দর্শন; সেটার মধ্যে ঢোকার মত সক্ষমতা আমার এখনও হয়নি। আমার নিজের প্রস্তুতি আছে। আমি হয়তো পুকুরে সাঁতরাতে পারি। হঠাৎ করে সমুদ্রে ঝাঁপ দেয়ার আগে নিজেকে বাঁচানোর জন্য একটা চারপাশ তৈরি করতে হয়। ‘ওপর-ওপর’ কাজ আমি করতে চাই না। তবে ‘ভেতর-ভেতর’ যে খুব করতে পারবো, সেটাও বলছি না। আমি যদি ডুবে মরেও যাই, অন্তত যেন জেনে যাই, এই মৃত্যুটা আমার জন্য প্রয়োজন ছিল।
যমুনা অনলাইন: সাহিত্য বা সাহিত্যিক কারো জীবন আপনাকে টানে কিনা? টেনেছে কিনা?
সাজ্জাদ হুসাইন: নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতা ইন্সপায়ার করে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, তারাশঙ্করের উপন্যাস। তারাশঙ্করের উপন্যাস পড়লে মনে হয় আমি চরিত্রটা হয়ে যাই। ফিল্মমেকার হিসেবে সত্যজিৎ রায়কে অনেক বড় ধরা হয়, তার ‘ফটিকচাঁদ’ উপন্যাস পড়ে দ্বিতীয়বার আমি আর পড়ার সাহস পাচ্ছিলাম না। কারণ, ওই ‘বাবলু’ চরিত্রটা আমি হয়ে যাই আর কি। ‘কল্লোল যুগ’টা আমাকে ভীষণ ইন্সপায়ার করে। প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, নজরুল ও আরও অনেকে। তাদের থাকার জায়গা নেই, স্বপ্ন নিয়ে কাজ করছে। হয়তো খেতেই পারছে না। বেঁচে থাকার জন্য যে টাকার দরকার, সেটা পাচ্ছে না। এদের প্রত্যেকের নাম শুনলে আমি অবাক হয়ে যাই, এরা কারা? আমি তাদের এই অবস্থাকে স্ট্রাগল বলবো না, এটা জীবনকে দেখা। কেউ যদি ৪ কোটি টাকা দামের গাড়ির স্বপ্ন দেখে, তাহলে সে তো মানুষের কাছে যেতে পারবে না। আর মানুষের কাছে যেতে আপনাকে হবেই। মানুষের পায়ের কাছে বসতে হবে, মানুষের গল্প বলতে গেলে।
যমুনা অনলাইন: এক্ষেত্রে অপজিটও তো রয়েছে। সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমরা ‘কাউন্টার কালচার’-এর কথা বলতে পারি। দেখা যাচ্ছে যে, মেনস্ট্রিম সাহিত্য বা ফিল্মের ধরন থেকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে তারা অন্য কিছু দাঁড় করানোর চেষ্টা করে। আপনি অবশ্যই জানেন ‘বিট মুভমেন্ট’, ‘হাংরি মুভমেন্ট’ ইত্যাদি। এ ব্যাপারে সাজ্জাদ হুসাইনের ভাবনা কী?
সাজ্জাদ হুসাইন: এটা আমি রিলেট করতে পারি। কারণ, ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ নিয়ে যখন কাজ করি, তখন গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের নকশাল আন্দোলন, জেলে যাওয়া, কৃষকদের সাথে মিশে কৃষিকাজ ইত্যাদি রিলেট করতে পাড়া যায়। আসলে কোন মাছটা জলের নিচ দিয়ে গেলে কীরকম প্রবাহ তৈরি হয় জলের, সেটা একজন জেলে যেভাবে বলতে পারবে আমরা কিন্তু সেভাবে বলতে পারব না। একটা ধান কোন প্রসেসের মাধ্যমে চাল হয়, এটা আমার চেয়ে (আমি পিএইচডি হোল্ডার হলেও) ভালো বলতে পারবে মাঠের কৃষক। ফলে এই জিনিসগুলো আমি করতে চাই। দেখেন, আমরা হয়তো একটা ট্রান্সজেন্ডারকে নিয়ে কাজ করলাম। কিন্তু আমার তো তার সাথে সংবেদনশীল হয়ে হাঁটতে হবে। আমরা দূর থেকে সেই মানুষটাকে দেখি। ট্রান্সজেন্ডারের সাথে কাজ করার ইচ্ছে থাকলে ওর বন্ধু হওয়ার জন্য আমার যা যা প্রয়োজন, আমি তাই করব। প্রত্যেকেই যেটা দেখে, সেটা যদি আমিও দেখি, তাহলে বিশেষ কী করা হলো? ‘কবি’র নিতাই চরিত্রটা যখন তৈরি হয়, তখন তারাশঙ্কর হাতিবাগানের ওই থিয়েটার পাড়াতে দুবছর ছিলেন।
যমুনা অনলাইন: অনেকে চরিত্রের গন্তব্যে না গিয়েও তো ফিকশন তৈরি করতে পারেন।
সাজ্জাদ হুসাইন: ওই ফিকশন আমি রিলেট করতে পারি না। যে কারণে তারাশঙ্করের জীবন আমাকে ইন্সপায়ার করে। পূর্ণদাস বাউলের বাবা হচ্ছেন নবনীদাস বাউল। রবীন্দ্রনাথের সাথে যার সুসম্পর্ক ছিল। ‘রাই কমল’ উপন্যাসটা লেখার জন্য নবনীদাস বাউলের পেছনে পেছনে পড়ে ছিলেন তারাশঙ্কর। ধরুন, এক কয়েদির আগামীকাল ফাঁসি হবে। তার মনস্তত্ত্ব বা মানসিক অবস্থা দূর থেকে ৫০ বার দেখলেও আমি বুঝব না, বোঝা সম্ভব না। তার সাথে আমার একটা রাত কাটাতে হবে। তারপর বাদবাকি গল্প।
আমাদের মধ্যে কিছু গিমিক আছে। যেমন প্রস্টিটিউশন বা কমন জেন্ডার ইস্যু। আমি একজন কমন জেন্ডারের সঙ্গে কথা বলছিলাম। বলতে বলতে দেখছিলাম, তার কান্নাটা কীরকম? তার কান্নাটা কিন্তু আপনার আমার মতো। সে প্রতিদিন একটা স্টেজে পারফর্ম করে। সেও কিন্তু মানুষ। সেই শেষের মানুষটাকে আমি সন্ধান করি প্রতিনিয়ত। আপনি কীসে পরিণত হন। মানে আপনি তো অনেক বড়। সেই বড়টা ক্ষুদ্র হতে হতে হতে কীভাবে একটা বিন্দু হয়ে যায়।
যমুনা অনলাইন: বিন্দু থেকে সেটা শূন্যে বিলিনও হয় কিনা?
সাজ্জাদ হুসাইন: জানি না। মানে সেটা আমার অপারগতাগুলোকে ফুলফিল করার চেষ্টা। এটার জন্যই হয়তো চেষ্টা করি। যেগুলা হয়তো কখনও আমার সাধ্যের মধ্যে আনতে পারব না। সম্ভব না আনা।
যমুনা অনলাইন: শেষ প্রশ্ন। লেখক হিসেবে আপনার ফিলোসফি একরকম বা লেখকের যাত্রাটা আপনি একভাবে দেখেন। যদিও অনেক লেখকের ভিন্ন পার্সপেক্টিভ আছে। এক্ষেত্রে ‘ছাপাখানার ভূত’ আপনার জার্নির ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে কিনা? যেটা অন্য অনেক লেখকের ক্ষেত্রে হয় না।
সাজ্জাদ হুসাইন: ১৫০ ভাগ হয়েছে। আমি জানি না, শুনতে কেমন লাগবে। শুধু অঞ্জন দত্তকে নিয়ে আমি দার্জিলিং গেছি, ঘুরে বেড়িয়েছি। দেড় লাখ টাকা শেষ। এই ম্যাডনেস বাংলাদেশের কোনো প্রকাশকের করা উচিত না। আবার অঞ্জন দত্তকে ঢাকায় এনে সেটার প্রোগ্রাম করা, এগুলো তো আমি কিছু ভেবে করিনি। এখন বলছি খুব আনন্দ নিয়ে যে, থার্ড এডিশন বেরিয়েছে। যদি এটা ওয়ার্ক না করতো? পাঠকেরা আপনার বই কিনবে কিনা, তা তো আপনি জানেন না। অঞ্জনদা একসময় আমাকে বলেছে– সাজ্জাদ, তোমার কিন্তু বেশ নাম হয়েছে। কিন্তু আমার উপলব্ধি ছিল যে, আমার বই পড়তেই হবে।
নতুন করে আমি আর ‘অঞ্জনযাত্রা’ পড়ি না। পড়লে হয়তো আবার ইচ্ছে করবে, অঞ্জনদার সাথে দার্জিলিং যেতে। ওইটা তো আমি এফোর্ড করতে পারছি না। আমার স্মৃতিটা তাই স্মৃতিতেই থাক।
যমুনা অনলাইন: ছাপাখানার ভূতে অন্য লেখকের কতটুকু জায়গা?
সাজ্জাদ হুসাইন: আমি তো দিতে চাই। তবে আমার মতো জার্নি করতে হবে। আমার কাজ আমি করে যাব। এখন কেউ যদি আমার কাছে এসে বলে, সাজ্জাদ ভাই, আমি কিন্তু আপনার চেয়ে বেশি এগ্রেসিভ। আমি তাকে বলব, চলো পাগলামি করি।
কিন্তু প্রত্যেক জায়গায় একটা তো কাঠামো থাকে। আপনি একজন চিত্রকর হতে চাইলে কী করতে চান? তার একটা কাঠামো থাকে। আপনি ভ্যান গগও হতে পারেন অথবা অন্য কিছু। আমি যেটা বলতে চাচ্ছি, যদি ৩০ বছর পাই, তাহলে সর্বোচ্চটা দিয়ে আমি বের হব। আমার স্ত্রী-কন্যা ফিনল্যান্ডে এখন। আমি বাংলাদেশে দুমাস ধরে আছি। তিন দিন আগে একটা সিনেমা দেখতে দেখতে আমার মেয়ের জন্য লিটারালি আমি কাঁদছিলাম।
যমুনা অনলাইন: কোন সিনেমা দেখে?
সাজ্জাদ হুসাইন: ‘শঙ্খচিল’ বলে একটা সিনেমা, গৌতম ঘোষের। আমার কাজের জন্যই দেখছিলাম। তো আমার মেয়ের কথা মনে পড়ছিল, আমি হাউমাউ করে কেঁদেছি। কিন্তু তাতে আমি বিচলিত না। আমি আনন্দিত। এই ক্রাইসিস বা ত্যাগগুলো একজন সত্যিকারের মানুষের থাকা উচিত। ত্যাগ না করলে যেভাবে আসবে সবকিছু সেভাবে চলে যাবে। এটা আরোপিত না, অটোমেটিক্যালি আসছে আমার কাছে।
যমুনা অনলাইন: যমুনা অনলাইনকে সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।
সাজ্জাদ হুসাইন: আপনাকেও ধন্যবাদ।
/এএম
Leave a reply