আমাদের একুশের গান

|

একুশে ফেব্রুয়ারি। শহীদ দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। যেভাবে ‘একুশ’ আমাদের হলো, বর্ণমালার রঙ ছড়ালো; তার নজির বোধহয় আর কোনো জাতির নেই। একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে লেখা হয়েছে অজস্র বাণী, রচিত হয়েছে গান। যুগ যুগ ধরে তা মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে, ফিরছে। সেসবের মধ্যে কিছু সৃষ্টি অমর হয়েছে অথবা মানুষের মনের গহীনে পৌঁছে গেছে। তা নিয়ে আজকের এই আয়োজন—

‘আমি কি ভুলিতে পারি’

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভেঙে যখন ছাত্র-জনতা মিছিল নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হোস্টেল প্রাঙ্গণে আসে, তখন ছাত্রদের ওপর গুলি চালায় পুলিশ। শহীদ হন সালাম, বরকত, শফিক, রফিক, জব্বারসহ নাম না জানা অনেক ছাত্র। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তখন ঢাকা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে তিনি দেখতে পান সেখানে পড়ে আছে জগন্নাথ কলেজের ছাত্র ভাষা শহীদ রফিকউদ্দিন আহমদের গুলিবিদ্ধ মরদেহ। সে রাতেই ‘একুশের গান‘ কবিতাটি লিখতে শুরু করেন তিনি।

কবিতাটি সেসময় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ছাত্র-জনতার মাঝে বিলি করে। পরের বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শহীদ দিবস পালনের প্রস্তুতি নেয়া হলে শহীদ দিবসের জন্য এই কবিতাটিই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অনুরোধে প্রথমে সুর দেন আবদুল লতিফ। পরে ১৯৫৪ সালে গানটিতে নতুনভাবে সুরারোপ করেন শহীদ বুদ্ধিজীবী আলতাফ মাহমুদ। এখন তার করা সুরেই গাওয়া হয় ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।’

১৯৬৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত জহির রায়হানের কালজয়ী ‘জীবন থেকে নেওয়া’ চলচ্চিত্রে প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল গানটি। ২০০৬ সালে ‘বিবিসি বাংলা’র শ্রোতা জরিপে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাংলা গানের তালিকায় এই গানটির অবস্থান ছিল তৃতীয়। গানটি গাওয়া হয়েছে ইংরেজি, ফরাসি, জাপানি, হিন্দিসহ মোট ১২টি ভাষায়। এই একটি গান, কেবল এই একটি গানের জন্য গীতিকার আবদুল গাফফার চৌধুরী ও সুরকার আলতাফ মাহমুদ অমর হয়ে থাকবেন।

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু-গড়া এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি’

শহীদ মিনারে একুশের গান গাইছেন শিল্পীরা

‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়’

আবদুল লতিফের কথা ও সুরে একুশের আরেকটি অমর গান ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়’। গানটি লেখা হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের কিছু দিন পূর্বে। তবে গানটি ব্যাপক সমাদৃত হয় বায়ান্নর পর। গানটির কয়েকটি লাইন পরবর্তীতে অবশ্য আবদুল লতিফ পরিবর্তন করেছিলেন। গানের মাধ্যমে অনেক কিছু তুলে আনা যায়, যা হয়তো শিল্পের অন্য কোনো মাধ্যমে আনা সম্ভব হয় না। শিল্প-সাহিত্যের দুনিয়ায় সবচেয়ে কম সময়ে মানুষকে আবেগের তীব্র দুয়ার থেকে ঘুরিয়ে আনা যায় মহান সংগীত দ্বারা। আবদুল লতিফের করা এই গান দিয়ে অনেক না বলা কথা বলা হয়েছে। অবদমিত জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষা ছিনতাইয়ের আশঙ্কা ফুটে উঠেছে। এটি শুধু বাংলা ভাষা নয়, সারা বিশ্বের সকল ভাষার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

ভাষা হলো চলমান নদীর মতো। তাকে তার মতো করে বয়ে যেতে দিতে হবে। আপন ছন্দে বাঁচতে দিতে হবে। তা না হলে সেখানে পলি জমবে, নদীর নাব্যতা হারাবে। কখনও কখনও নদী মরেও যেতে পারে। এই ব্যাপারটা আঞ্চলিক, চলিত, লেখ্য; সকল ভাষার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যে ভাষায় মানুষ কথা বলে, বলতে চায়; সেই ভাষা কেড়ে নেয়ার অধিকার কারও নেই– অমর গানটিতে এটিই মুখ্য হয়ে উঠেছে।

সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘মুকুল ফৌজ’-এর কর্মীদের নিয়ে প্রথম এ গানটি গান আবদুল লতিফ। ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়’ ছাড়াও আরও একাধিক ভাষা আন্দোলনের সময়কার গান লিখেছিলেন স্মরণীয় এই শিল্পী।

‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়
ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়
ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে-পায়ে
ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমাদেরই হাতে-পায়ে..’

২০১৮ সালের বইমেলার একটি ব্যানার

‘সালাম সালাম হাজার সালাম’

‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানটি শুধু বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমৃদ্ধ একটি গান। ফজল-এ-খোদার কথায় গানটি সুর করেন কণ্ঠশিল্পী আব্দুল জব্বার। তিনি নিজেই প্রথম গানটিতে কণ্ঠ দেন। ১৯৭১ সালের ১৪ মার্চ গানটি প্রথম বেতারে প্রচার করা হয়। এই গানটি একাত্তরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সর্বাধিক পরিবেশিত একটি গান।

‘বিবিসি বাংলা’র শ্রোতা জরিপে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাংলা গানের তালিকায় এই গানটির অবস্থান ছিল ১২তম স্থানে। ২০২৩ সালে এর গীতিকার মুক্তিযোদ্ধা ফজল-এ-খোদা শিল্পকলায় (সংগীত) গৌরবজনক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ একুশে পদকে (মরণোত্তর) ভূষিত হন। গানটির বিষয়ে তার স্ত্রী মাহমুদা সুলতানা বলেন, বঙ্গবন্ধুর অনুরোধেই লেখা হয়েছিল ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানটি।

এই গানের ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ পংক্তিতে ভাষা আন্দোলনের সকল শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়েছে। আমরা জানি, ভাষা আন্দোলনের অন্যতম একজন শহীদের নাম ‘সালাম’।

‘সালাম সালাম হাজার সালাম
সকল শহীদ স্মরণে,
আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই
তাদের স্মৃতির চরণে।’

ভাষা আন্দোলনের ঘটনা নিয়ে আঁকা কার্টুন

এছাড়া, ‘ভুলব না, ভুলব না, একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না’ শিরোনামে ভাষা আন্দোলনের প্রথম গান লেখেন ভাষাসংগ্রামী গাজীউল হক। গানটিতে সুরারোপ করেছিলেন তারই অনুজ নিজাম উল হক। অমর একুশের সূচনা পর্বের গান হিসাবে এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। একাধিক ভাষাসংগ্রামী তাদের রচনায় গাজীউল হকের এই গানটিকে ‘একুশের প্রথম গান’ হিসেবে চিহ্নিত করেন।

বিভিন্ন রচয়িতার লেখা একুশের আরও কিছু গানের কথা উল্লেখ করা যায়। যেমন ‘রক্তে আমার প্রলয় দোলা’ (আলতাফ মাহমুদ), ‘ঘুমের দেশে ঘুম ভাঙাতে ঘুমিয়ে গেল যারা’ (বদরুল হাসান), ‘অপমানে তুমি জ্বলে উঠেছিলে’ (আবু হেনা মোস্তফা কামাল), ‘সালাম আমার শহিদ স্মরণে’ (শাহ আবদুল করিম), ‘ভাষার জন্য জীবন হারালি’ (রমেশ শীল), ‘বাংলাদেশের মানুষ, ফেব্রুয়ারি একুশে ভুলিতে পারবে না জীবনে’ (বিজয় সরকার), ‘শোন দেশের ভাই-ভগিনী’ (হেমাঙ্গ বিশ্বাস), আমায় গেঁথে দাওনা মাগো (নজরুল ইসলাম বাবু) ইত্যাদি।

গ্রন্থনা: আল মাহফুজ


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply