অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের পরিচয়ের অন্ত নেই। জনপ্রিয় গায়ক, গীতিকার, সুরকার। তিনি ফিল্মমেকার, অভিনয়ও করেন। তবে সেই সাবজেক্টে নিজেকে লেটার মার্কস দেন না। যিনি কখনও ভাবেননি, বাসরঘর আর কলেজ ফেস্ট ছাড়া কোথাও তার গানের যাত্রা হবে বহমান। যে জীবন যাপন করা হয় না আর কারও, সেই নাবালক জীবন বারবার স্পর্শ করেন বোহেমিয়ান ঘুড়ির মতো। দুই বাংলার জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘চন্দ্রবিন্দু’র অন্যতম প্রধান গায়ক ও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য অনিন্দ্য। তার লেখায়ও ঝরে পড়ে ঝরঝরে হিউমার আর বক্র বাস্তবতা।
সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে লেখা বই ‘অনিন্দ্যকাল’। লিখেছেন সাজ্জাদ হুসাইন। সেই বইয়ের প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র অডিটরিয়ামে। সেখানটাতে অংশ নিতে কলকাতা থেকে ঢাকায় উড়ে আসেন ‘অকিঞ্চিত’ লেখক। সামনে গুনমুগ্ধ পাঠক-শ্রোতা পেয়ে যেন খুলে দেন কথার অর্গল।
সঞ্চালক সাজ্জাদ হুসাইন তার কাছে প্রথমে জানতে চান, চন্দ্রবিন্দুর বিখ্যাত গান ‘ভিনদেশী তারা’র উদ্ভাবন বা উদ্বোধন বিষয়ে। গীতিকার অনিন্দ্যর জবাব– অন্য কোথাও এটা জিজ্ঞেস করলে আমি বলি, প্ল্যানেটারিয়াম দেখে বেরিয়ে গানটি লিখেছিলাম (দর্শকের হাসি)। কিন্তু এখানে সেটা বলা যাবে না। ভিনদেশ মানে ভিসা-ইমিগ্রেশন নয়। ভিনদেশ মানে আমি যেখানে বড় হয়েছি, আমার সত্তা বা মন যেখানটাতে থাকে, সেখান থেকে আপরুটেড হয়ে অন্য জায়গায় চলে যাওয়া। আমাদের প্রায় সবার জীবনযাত্রার গতিপ্রকৃতি অনেকটাই এরকম।
অনিন্দ্য কথামালা চলতে থাকে– যতোই আমি সৌরজগত নিয়ে কথা বলি না কেন, ‘ভিনদেশী তারা’ আদতে একটি প্রেমের গান। এটি এমন প্রেমের গান, যার কাছে সহজে পৌঁছানো যাচ্ছে না। তার সত্যিই আকাশছোঁয়া বাড়ি, যে বাড়ির নাগাল আমার করায়ত্ত নয়। হ্যাঁ, শিল্পীরা স্বভাবত মিথ্যুক হয়। তাদের সৃষ্টিতে দশ শতাংশ সত্য থাকে, নব্বই শতাংশ থাকে মিথ্যে। তবে রঙ ছড়িয়ে বলার নামই একপ্রকার শিল্প।
এরপর দর্শকসারি থেকে ‘বন্ধু তোমায় এ গান শোনাবো’ গানটির সৃষ্টির পেছনের গল্প নিয়ে জানতে চাওয়া হয়। ‘চন্দ্রবিন্দু’র নরম গায়ক স্বভাবসুলভ স্বরে বলেন– আমি বন্ধুদের মধ্যে সবার আগে চাকরি পাই। আমি তখন চাকরি করি ‘যুগান্তর’ অফিসে। প্রথম প্রথম পত্রিকার কাজ করে খুব মজা পেতাম। কিন্তু ধীরেধীরে এই আনন্দের রঙ ফিকে হয়ে যেতে লাগে। তখন বোর্ড মিটিংয়ে নানা রকম আলোচনা হতো কিন্তু কেউ কোনো ডিসিশনে পৌঁছতে পারতো না।
কথার ট্রেন ছুটতে থাকে গীতিকারের– সেখানে একটা বড় কাঁচের জানলা ছিল। সেই কাঁচের জানলা দিয়ে বাইরে তাকালে আমি দেখতাম, বিকেলটা নামছে। এটা দেখলেই আমার মনে পড়তো, আমার জবলেস বন্ধুগুলো কোথাও গিয়ে লুকিয়ে তখন সিগারেট খাচ্ছে অথবা ফুর্তি-টুর্তি করছে। এটা ভেবে আমার মনে হতো, ওরা কত সৌভাগ্যবান। আর আমি এই ‘গরুর গোয়াল’-এ ঢুকে গেছি। কবে বেরোব, জানা নেই। ছুটিছাটারও ব্যাপার নেই তখন, আমি সবে ঢুকেছি।
স্মৃতিকাতর আলাপ এগোতে থাকে কামরার পর কামরায়– আমি ওই বিকেলটুকু শুধু মিস করতাম। তার কারণ হচ্ছে, আমার কাছে মনে হতো, চাকরি মানে বোধহয় বিকেল জমা দেয়ার দাসখত। এই ভাবনাটা আমার মাথার মধ্যে অনেক দিন ঘুরপাক খাচ্ছিল। কয়েক মাস এভাবে অতিবাহিত হওয়ার পর একদিন বন্ধুরা তাদের সঙ্গে আউটিংয়ে যেতে অনুরোধ করলো অনিন্দ্যকে। ছুটি পাওয়া যাবে কিনা শঙ্কা প্রকাশ করতেই বন্ধুরা শিখিয়ে দিলো ‘ঢপ’ দিতে। পরদিন অফিসে ছলের আশ্রয় নিয়ে এই গায়ক ছুটে গেলেন বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে।
কৌতূহল নিয়ে তার গল্প শোনে দর্শক আর ভীষণ আনন্দিত মুখে বলে চলেন অনিন্দ্য– সাড়ে চার মাস পর ছুটি পেয়েছি। সুতরাং ঘুরতে গিয়ে বন্ধুদের পেয়ে যা-ই করছি, খুব ভাল্লাগছে। বিকেলবেলায় দেখি, বন্ধুরা ক্রিকেট খেলছে। আমি বসে বসে ওদের খেলা দেখছি। তখনই প্রথমবারের মতো ‘বন্ধু তোমায় এ গান শোনাবো বিকেল বেলায়’ গানের প্রথম দু’লাইন মাথায় আসে। ওটাই ছিল গানের বীজ। তারপর ধীরেধীরে নানা অনুষঙ্গ গানের ভেতরে জমা হয়েছে। তবে এই গানের অমোঘ বাক্যটা আমার কাছে ধরা দেয় ওই দিনই, যেদিন আমি ‘যুগান্তর’ থেকে বাইরে বের হই।
বইয়ের মোড়ক উন্মোচন শেষে দর্শকের সঙ্গে ‘ভিনদেশী তারা’, ‘বন্ধু তোমায় এ গান শোনাবো বিকেল বেলায়’ গান গেয়েও শোনান এই গীতিকার-গায়ক। তার সঙ্গে গলা মেলান বাংলাদেশের গায়ক মাহতিম সাকিব, গলা মেলান দর্শক। গানের ভেলা ভেসে চলে আর বেলা গড়িয়ে যায়। অনিন্দ্য আসেন, সঙ্গে গানও আসে। গল্প বলেন, গল্প বোনেন। শহীদ মিনার দেখেন, প্রভাতফেরিতে হাঁটেন। পথে-ঘাটে আল্পনা আঁকার মিছিলে শামিল হন। অনিন্দ্যকে দেখে আমাদের ভালো লাগে। আমাদেরও হয়তো মনে পড়ে যায় ছেলেবেলার কথা। আমরা হারিয়ে যাই মার্বেল খেলার সেই বিকেলবেলায়। যে বেলার বন্ধুরা এখন হয়তো অধরা..
গ্রন্থনা: আল মাহফুজ
Leave a reply