‘সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদ বিবরণী দেয়ার বাধ্যবাধকতা বাতিল হলে দুর্নীতি উৎসাহিত হবে’

|

সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯ এর সংশোধন করে সম্পদের বিবরণী জমা দেয়ার বাধ্যবাধকতা সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ উদ্যোগের কঠোর সমালোচনা করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সরকারের এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে দেশের প্রায় ১৫ লাখ সরকারি কর্মচারীকে জবাবদিহি থেকে দায়মুক্তি দেয়া হবে। পাশাপাশি দুর্নীতি সুরক্ষিত ও উৎসাহিত হবে এমন আশঙ্কা করে এ উদ্যোগ বাতিলের আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।

মঙ্গলবার (১৯ মার্চ) এক বিবৃতিতে এ উদ্বেগ জানায় টিআইবি। সংস্থাটি জানায়, গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী সরকারি কর্মচারীদের সম্পদ বিবরণী জমা দেয়ার বিধান রহিত করে সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের খসড়া সংশোধনী যাচাইয়ের পর এটি এখন প্রশাসনিক উন্নয়নবিষয়ক কমিটিতে পাঠানো হবে।

সম্পদ বিবরণী জমা দেয়ার বিধি বাতিলের ফলে অসাধু সরকারি কর্মকর্তাদের আরও বেশি করে দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হবে উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারি চাকরিজীবী (আচরণ) বিধিমালার প্রস্তাবিত সংশোধনী সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার ও শীর্ষ পর্যায়ের দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা ঘোষণার ঠিক উল্টো।

তিনি আরও বলেন, প্রথমে প্রতিবছর সম্পদ বিবরণী জমা দেয়ার বিধান থাকলেও সরকারি কর্মচারীদের অনীহার মুখে পরবর্তীতে শিথিল করে তা পাঁচ বছর পর পর দেয়ার বিধান করা হয়। সেই বিধানও সঠিকভাবে পালনে অনাগ্রহ ছিল। চাকরির শুরুতে সম্পদের বিবরণী দিলেও পাঁচ বছর পর পর হিসাব হালনাগাদের বাধ্যবাধকতা গুরুত্বই দেন না সরকারি কর্মচারীরা। এখন এই বাধ্যবাধকতা সরিয়ে দেয়ার অর্থ হলো প্রকারান্তরে সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে উঠতে ব্যাপক উৎসাহ দেয়া। কেননা, সম্পদের বিবরণী জমা দেয়ার মতো কোনো বিধান না থাকলে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে নির্ভয়ে দুর্নীতি, এর মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের সুযোগ বাড়বে তা বলাই বাহুল্য। একই সঙ্গে প্রাপ্য সেবা পেতে সরকারি অফিসে জনগণের ভোগান্তি বাড়বে, অবৈধ অর্থ লেনদেন বহুগুণে বাড়বে এবং সর্বোপরি সুশাসিত সরকার ব্যবস্থা নিশ্চিতের স্বপ্ন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।

বিবৃতিতে বলা হয়, কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদের হিসাব সরাসরি নিয়মিত জমা ও হালনাগাদের পরিবর্তে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে দেয়া বার্ষিক আয়কর রিটার্ন থেকে নেয়ার যে যুক্তি, বাস্তবে তা অর্থহীন। কারণ, আয়কর আইন ২০২৩ অনুযায়ী তা সম্ভব নয়। আইনের ৩০৯ (২) এবং ৩০৯ (৩) ধারা অনুযায়ী, কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো সরকারী কর্মচারীকে এই আইনের অধীনে কোনো ট্যাক্স রিটার্ন, অ্যাকাউন্ট বা নথি উপস্থাপন, সাক্ষ্য বা প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপনের আদেশ দিতে পারে না। অর্থাৎ, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দুর্নীতি বা বৈধ আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদ আহরণের অভিযোগে কোনো ব্যক্তির আয়কর বিবরণী আদালতের নির্দেশ ছাড়া দেখতে পারবে না। ফলে জবাবদিহির মুখোমুখি হওয়ার বদলে এই সংশোধনীর মাধ্যমে দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মচারীরা নতুন সুরক্ষা লাভ করবেন।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ২০০৩ সালে নেয়া জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী সনদে (আনকাক) জনপ্রতিনিধিসহ সব সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব প্রতিবছর দাখিল ও তার বছরভিত্তিক পর্যালোচনার কথা বলা হয়েছে। জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল ২০১২ এর মাধ্যমে এ অঙ্গীকারের পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে।

এ অবস্থায় এই সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের দুর্নীতিবিরোধী অঙ্গীকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আরও এক দফা প্রশ্নের মুখে পড়বে উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, বাংলাদেশ আনকাক সদস্য দেশ। অথচ সরকারি কর্মচারীদের আচরণবিধিতে এমন সংশোধনীর উদ্যোগ নেয়া বৈশ্বিক আদর্শিক চর্চা ও আনকাকের দুর্নীতিবিরোধী মূল নীতির সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। একইভাবে, জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল ২০১২, যা প্রণয়নে সরকারি কর্মকর্তারাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন তাকেও পদদলিত করা হবে। অসাধু কর্মকর্তাদের দুর্নীতির সুরক্ষা ও বিচারহীনতা প্রদানের স্বার্থে এ আত্মঘাতী উদ্যোগ থেকে সরে আসার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানায় টিআইবি।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply