বিদেশ থেকে আমদানি করা কোনো মতবাদে চলবে না বাংলাদেশ: প্রধানমন্ত্রী

|

বিদেশ থেকে আমদানি করা কোনো মতবাদে বাংলাদেশ চলবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নীতি নির্ধারনী বিষয়ক ম্যাগাজিন হোয়াইট বোর্ডে দেয়া সাক্ষাৎকারে এ কথা জানান তিনি।

সরকার ও রাজনীতির বিষয়ে শেখ হাসিনার শৈশবে কেমন ভাবনা ছিল? এমন প্রশ্নের জবাবে উত্তর ছিল, সত্যি কথা বলতে কি, আমি কখনোই ভাবিনি আমি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবো! আমি ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম, কিন্তু সারাদেশের দায়িত্ব নেয়ার বিষয়টি আমার মাথায় আসেনি। কীভাবে একটি দেশের উন্নয়ন করা যায় বা কীভাবে মানুষের জীবন উন্নত করা যায় সেগুলো সম্পর্কে আমি সত্যিই সচেতনভাবে চিন্তা করিনি।

তিনি আরও বলেন, কিন্তু আমি এখন বুঝতে পারি যে আমার বাবার আশেপাশে থাকায় অবচেতনভাবে ছোটবেলা থেকে আমার মনে একটি ব্লুপ্রিন্ট (রাজনীতি ও দেশ নিয়ে) তৈরি হয়েছিল। বাবার জীবনে রাজনীতি একটি সর্বাঙ্গীণ অংশ ছিল এবং এটি এমন কিছু যার মধ্য দিয়ে আমরা বড় হয়েছি। আমরা দিনের সংবাদপত্র নিয়ে তার চারপাশে জড়ো হতাম এবং সারা বিশ্বে ও আমাদের নিজেদের আঙ্গিনায় কী ঘটছে সে সম্পর্কে তার কথা শুনতাম। অনেক প্রশ্ন, অনেক দীর্ঘ আলোচনা! এভাবেই আমাদের দিন শুরু হতো।

দেশে ফেরার সময় প্রধান চ্যালেঞ্জ কী ছিল? সরকার প্রধান বলেন, আমি যখন আওয়ামী লীগের নেতা নির্বাচিত হয়ে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসি, তখন এটা স্পষ্ট যে রাষ্ট্র আর জনগণের সেবা করছে না। রাষ্ট্রযন্ত্র অভিজাতদের দখলে ছিল, একটি ছোট গোষ্ঠীর সুবিধার জন্য নীতি তৈরি করেছিল। জনগণের কাছে কোনো জবাবদিহিতা ছিল না। জনগণেরও কথা বলার জায়গা ছিল না। এসব জিনিস পরিবর্তন করতে হয়েছিল।

শেখ হাসিনার কাছে প্রশ্ন ছিল, আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নেয়ার পর আপনি নিজেকে কীভাবে প্রস্তুত করেছেন? বলেন, ’৮০ এর দশকের গোড়ার দিকে আমি যখন একটি প্রগতিশীল জোটের নেতৃত্ব দিতে শুরু করি, তখন আমি একজন তরুণ রাজনীতিবিদ। বাংলাদেশের ভেতর ও বাহিরের বিষয়ে জানার বেশ আগ্রহ ছিল। নিজের জন্য দেশটি দেখতে চেয়েছিলাম। আমাদের নীতির অগ্রাধিকার নির্ধারণের জন্য আমি আমার দলের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসেছি। মানুষের চাহিদা বোঝার জন্য আমাকে তাদের কাছে যেতে হয়েছে, তাদের সংগ্রাম দেখতে হয়েছে। সর্বোপরি, আমি কীভাবে কল্যাণমূলক নীতিগুলো তৈরি করবো, যদি আমি না জানি যে সেগুলো কাদের জন্য। আমি আরামে বসে বসে সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি।

‘উন্নয়নের রাজনীতি’ শব্দটির সঙ্গে প্রায়শই সংযুক্ত হয় শেখ হাসিনার। এ নিয়ে তার কাছে মন্তব্য জানতে চাইলে বলেন, আমি আপনাকে একটি সহজ উত্তর দিই। ভালো রাজনীতি ছাড়া ভালো নীতি হতে পারে না। ভালো রাজনীতির জন্য পাকা রাজনীতিবিদ প্রয়োজন। তৃণমূল রাজনীতিবিদরা দেশকে অন্যভাবে বোঝেন, তাদের বাস্তবতা সম্পর্কে আরও ভালো ধারণা রয়েছে। নীতির দিক দিয়ে উন্নয়ন প্রায়শই শুধুমাত্র অর্থনৈতিক পরিভাষায় বোঝা যায়। কিন্তু আমরা যারা রাজনীতি করি, আমরা দেশকে নিয়ে ভাবি আরও স্বজ্ঞাতভাবে।

রাজনীতি ব্যক্তিগত লাভ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য হওয়া উচিত নয়, যা আপনি একজন সামরিক স্বৈরশাসক বা বিচ্ছিন্ন অভিজাতদের মধ্যে দেখতে পাবেন। এটি একটি দেশের উন্নয়ন এজেন্ডাকে লাইনচ্যুত করতে পারে। বাংলাদেশে আপনি পার্থক্য দেখতে পাচ্ছেন। কারণ, দেশ উভয় পদ্ধতির সরকারই দেখেছে।

অন্যান্য দেশ থেকে বাংলাদেশ কী শিখতে পারে? প্রধানমন্ত্রীর উত্তর, এটা একটি মজার প্রশ্ন। আপনি বাংলাদেশের ইতিহাস জানলে দেখবেন যে এই দেশের মডেল গড়ে উঠেছে নির্দিষ্ট দেশীয় মূল্যবোধ ও নীতি ধারাবাহিকতার ওপর ভিত্তি করে। দেশের প্রতিষ্ঠাতা মুজিব একবার বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশের শাসন চলবে শুধু আমাদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে।’ অন্য কথায়, বাংলাদেশ অন্য দেশের উন্নয়ন ফর্মুলা আমদানি করতে পারে না।

আমাদের নীতি-নির্ধারকদের আমাদের কৌশলগত অবস্থান, আমাদের ভূপ্রকৃতি, আমাদের জনগণের চাহিদা, আমাদের ইতিহাস, আমাদের পরিবেশ এবং আমাদের সম্পদের মতো বিষয়গুলো বুঝতে হবে। উন্নয়নের জন্য বিদেশি পরামর্শ এখানে কখনোই কাজ করে না। এর মানে এই নয় যে, আমরা সারা বিশ্বের উন্নয়নে চোখ বন্ধ করে রাখি। বিভিন্ন দেশের ভালো চর্চাগুলো আমাদের প্রয়োজনের জন্য শিখতে হবে।

আপনারা কোন বিদেশি নীতি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন, জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে দারুণ সামাজিক কল্যাণ ব্যবস্থা রয়েছে। তারা তাদের জনগণের অর্থনৈতিক অধিকার রক্ষার একটি বড় উদাহরণ। পূর্ব, দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর দুর্দান্ত পরিবহন অবকাঠামো রয়েছে, যা তারা মেধাসম্পন্ন নীতির মাধ্যমে বাস্তবায়ন করেছে।

স্বাস্থ্য খাতের একটি উদাহরণ দিই। আশির দশকে যখন আমি প্রায়শই যুক্তরাজ্যে যেতাম, আমি লক্ষ্য করেছি যে তাদের স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রতিটি পাড়ায় পৌঁছেছে। বাড়ির কাছাকাছি, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে একই ধরনের স্বাস্থ্য নেটওয়ার্ক বিদ্যমান। এই সর্বজনীনভাবে অর্থায়ন করা স্বাস্থ্যব্যবস্থা সর্বোত্তম প্রাথমিক সেবা প্রদান করে। এগুলোর স্থানীয় চাহিদার জন্যও খুব প্রাসঙ্গিক। তাই আমি কমিউনিটি ক্লিনিক নীতি গ্রহণ করে বাংলাদেশের জন্য তাদের সিস্টেমগুলোকে গ্রহণ করেছি। মূল ধারণা ছিল সবার কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়া।

এটিকে টেকসই করার জন্য, স্থানীয়দের মালিকানা প্রদানের মাধ্যমে এই ব্যবস্থাকে একটি পাবলিক-প্রাইভেট অংশীদারিত্ব হিসাবে দাঁড় করানো হয়েছে। স্থানীয়রা জমি দেবে, ফার্মা কোম্পানিগুলি ওষুধ সরবরাহ করবে এবং সরকার পরিষেবাগুলো সহজতর করবে। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলি তৃণমূলে স্বাস্থ্যসেবার একটি নতুন স্তর যুক্ত করেছে, যা সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বোঝা কমিয়েছে।

বিদেশি অংশীদাররা দুটি প্রধান হাতিয়ার ব্যবহার করে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করেছে, সাহায্য ও নীতির ব্যবস্থাপত্র। দেশ কি এই নির্ভরতা কাটিয়ে উঠছে? সরকারের প্রধানের জবাব, বিদেশি নির্ভরতা হ্রাস পেয়েছে এবং এটি আমার প্রশাসনের একটি প্রচেষ্টার কারণেই হয়েছে। এই নির্ভরতার শেকড় অনেক গভীরে ছিল। এই সংস্কৃতি পরিবর্তন করতে আমাদের প্রথমে মানসিকতার পরিবর্তন করতে হয়েছে। এই প্রচেষ্টায় আপনার নিজেকে সমান হিসাবে দেখা শুরু করতে হবে। এই সমস্যাগুলো যথাযথ সমাধান করা প্রয়োজন। রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং অর্থ এখানে একটি বড় ভূমিকা পালন করে।

যখন অন্যান্য সরকার উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বাজেট প্রণয়ন করতো, তখন সিংহভাগই বিদেশি অর্থায়ন থেকে আসতো। তাদের আর্থিক নীতি ছিল মূলত ‘দাতানির্ভর’। সর্বোপরি, জনসাধারণের ব্যয়ের ক্ষমতা ছিল নগণ্য। আমি বিদেশি ধার করা অর্থ প্রত্যাখ্যান করে এই নীতিটি উল্টে দিয়েছি।

আমার প্রশাসন আমাদের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণগ্রহণ ত্বরান্বিত করেছে। অন্তত টাকা আমাদের নিজেদের সীমানার মধ্যে সঞ্চালিত হবে। দীর্ঘমেয়াদী এই নীতির ফল এসেছে। এখন আপনি দেখতে পাবেন যে আমাদের সরকারি ব্যয়ের সিংহভাগ আসে আমাদের নিজস্ব দেশীয় সম্পদ থেকে।

উন্নয়ন সহযোগীদের দ্বারা নির্ধারিত নীতি ও প্রকল্প সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেন, যখন আন্তর্জাতিক পরামর্শদাতারা আমাদের কাছে বড় প্রকল্প নিয়ে আসে, তখন মূলত অর্থই আমরা তাদেরকে দেই। অনেক বাংলাদেশি নীতি নির্ধারক কঠিন প্রশ্ন উত্থাপন না করেই তারা যা বিক্রি করছেন তা দ্রুত কিনতে চায়। কনসালটেন্সি ফি কেমন? প্রকল্পের বিনিয়োগের আয় কী? এতে কার উপকার হবে? এসব বিষয় ভাবতে হবে।

আমাদের বেপরোয়াভাবে ধার করা এবং করের বোঝা বাড়ানো উচিত নয়। তবে কিছু বিদেশি আমাদের এটি করতে বলেছে। বড় বড় প্রকল্প প্রত্যাখ্যান করার জন্য আমি সুপরিচিত! উপযুক্ত মনে করলে নীতি-নির্ধারকদের অর্থ ব্যবহার করা উচিত। আপনার প্রয়োজন না হলে ঋণ নেবেন না। আপনি যদি অলাভজনক প্রকল্পের জন্য অর্থ নেন তবে এটি কেবল ঋণের বোঝা তৈরি করবে।

আমাদের এখন নীতি-নির্ধারকরা আর সহজে বিদেশিদের প্রণীত প্রকল্পে প্রভাবিত হন না। এই আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে সময় এবং প্রচেষ্টা লাগে। এখন বাংলাদেশিরা বিশেষ করে সরকারি সহায়তায়, সারা বিশ্ব থেকে সেরা প্রশিক্ষণ পাচ্ছে। অনেকেই সেরা জায়গা থেকে পিএইচডি করছেন। এটি বাংলাদেশের মধ্যে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য আমাদের সুচিন্তিত নীতির প্রভাব।

আমরা আমাদের দেশের মধ্যে একটি দক্ষ জনবল তৈরি করবো। তাহলে নীতি বা প্রকল্প প্রণয়নের জন্য আমাদের আর বিদেশে যেতে হবে না। নীতি প্রণয়ন চিরকাল বিদেশি পরামর্শকদের ওপর নির্ভরশীল হতে পারে না। বাংলাদেশের নিজস্ব নীতি প্রণয়নের ক্ষমতা আছে। এটা আমার সহজ কথা, আমাদের দেশ আমাদের নীতি।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply