শাকিল হাসান:
পুরান ঢাকার জনপ্রিয় ইফতারগুলোর অন্যতম ‘বড় বাপের পোলায় খায়’। গালভরা নাম আর প্রচারণায় খ্যাতির তুঙ্গে রয়েছে এটি। অথচ এর সাথে ঢাকাই খাবারের ইতিহাসের যোগসূত্র নেই। এমনকি ঢাকার আদি বাসিন্দাদের পাতেও এটি ছিল না কখনও। এর বর্তমান কারিগররাও ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দা নন। রমজানের এক মাস এটি বিক্রি করলেও অন্য সময় তারা ফল আর প্লাস্টিকের ব্যবসা করেন।
হরেক রকমের মশলা আর পদের মিশ্রণে তৈরি হয় বড় বাপের পোলায় খায়। এর মূল কারিগর দুই ভাই মোহাম্মদ হোসেন ও মোহাম্মদ রাজু। দোকানে আরও যারা কাজ করেন, তারা সবাই পরিবারের সদস্য।
বড় বাপের পোলায় খায়’র স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ হোসেন বলেন, এটি ঢাকার নবাবি খাবার। এই খাবারের স্বাদ না থাকলে মানুষ ৮০০ টাকা দিয়ে কিনতো না।
অপর স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ রাজু বলেন, এই খাবারের ঐতিহ্য আছে বলেই এটিকে এখনও ধরে রেখেছি। এই খাবারের নামটি আমার দাদা রেখেছে।
মূলত, আঠারো শতকের শেষ থেকেই শাহী মসজিদের সামনে ইফতার বাজার দৃশ্যমান হয়। শুরুতে কাবাব, পনির, জিলাপির মতো প্রয়োজনীয় খাবারই শুধু মিলতো। সময়ের বিবর্তনে পদ বাড়তে থাকে। বড় হতে থাকে চকবাজারের পরিসর।
চকের পাশেই ছোট কাটরা। এখানে গবেষক ও লেখক সাদ উর রহমানদের বসত কয়েক পুরুষ ধরে। সেখানে দেখা তার সঙ্গে। সাদ ঢাকার খাবার নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন। লিখেছেন বই। বড় বাপের পোলার উৎপত্তির সন্ধান দেন তিনি।
সাদ উর রহমান বলেন, নবাব বাড়ির ইফতারের আয়োজনে অনেক রকম পদ থাকতো। সব পদের খাবার সবাই খেতো না। পরে অবশিষ্ট খাবারগুলো বাবুর্চির ঘরে চলে যেত। তখন তারা সব পদের খাবারকে মিশিয়ে কিছু মশলা দিয়ে এটি তৈরি করে। তখন সেটি ওই পর্যন্তই সীমিত ছিল।
তিনি আরও বলেন, পরবর্তীতে ব্রিটিশ আমলের প্রথম দিকে শেখ সুবা নামের একজন চকবাজারের ছোট মিনারের সামনে এটি বিক্রি করা শুরু করেন। বর্তমানে যারা বড় বাপের পোলা বিক্রি করেন, তারা কেউই ঢাকার নয়।
এবার ব্যবসা শুরুর কথা জানতে চাই বড় বাপের পোলায় খায় এর কারিগর দুই ভাইয়ের কাছে। মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকেই বড় বাপের পোলায় খায় বিক্রি হতো। সে সময় থেকেই আমার পূর্বপুরুষেরা এটির সাথে জড়িত। এটি আমাদের খানদানের ব্যবসা।
অপর স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ রাজু বলেন, ৭৮ বছর আগে থেকেই বড় বাপের পোলায় খায় বিক্রি হচ্ছে। তখন আমাদের পূর্ব পুরুষেরা এটি বিক্রি করেছে।
দুই ভাইয়ের দুই রকম তথ্যে বিভ্রান্ত হয়ে বড় বাপের পোলা নামে ব্যবসা শুরুর ইতিহাস নিশ্চিত হতে দেখা করি ফরাশগঞ্জের বিখ্যাত সরদার পরিবারের আজিম বখশের সঙ্গে। ৭৬ বছরের আজিম বখশ স্মৃতি হাতড়ে বলেন সেইসব দিনের কথা।
ইতিহাস সংগ্রাহক আজিম বখশ্ বলেন, পাকিস্তান আমলে এই খাবারের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। বাংলাদেশ হওয়ার পর বাহিরের লোকজন আসা শুরু করলে এর নামটি মানুষকে আকর্ষণ করে। সবাই এটি একবারই খায়, দ্বিতীয়বার খায় না।
পুরো চকে শুধু এদের দোকানেই মেলে এই খাবারটি এবং তা শুধু রমজানেই পাওয়া যায়। প্রশ্ন করা হলো বাকি সময় কী করেন তারা?
মোহাম্মদ হোসেন বলেন, রমজান ছাড়া বাকি সময় আমি ফলমূল বিক্রি করে থাকি। মোহাম্মদ রাজু বললেন, বাকি সময় আমি প্লাস্টিকের ব্যবসা করে থাকি।
বলা যায়, আধুনিক মার্কেটিংয়ের অনন্য উদাহরণ চকবাজারের এই ইফতার বাজার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমের বদৌলতে এখানের জনপ্রিয় ইফতারসামগ্রী বড় বাপের পোলায় খায়’র নাম এখন বিশ্বজুড়ে। চকের এই জনকীর্ণ ইফতারের বাজার ঢাকাবাসীর রসনাই মেটায় না। জড়িয়ে রাখে আবেগেও। তাই তো বিশ্বব্যাপী ঐতিহ্যের নামে যা ছড়ালো, তাতে শঙ্কিতও তারা।
/আরএইচ/এমএন
Leave a reply