মনে আছে সাকিবের ‘ব্রিলিয়ান্ট বিরানব্বই’-এর কথা?

|

আল মাহফুজ

বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ইনিংস কোনটি, তা নিয়ে বোধহয় অনেকেরই সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক আকরাম খান ১৯৯৭-এর আইসিসির আসরে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে অপরাজিত ৬৮ রানের এক দৃঢ়চেতা ইনিংস খেলেছিলেন। সেটা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস। কিন্তু সেটি স্বীকৃত কোনো ওয়ানডে ম্যাচ ছিল না। যদি প্রশ্ন করা হয়, বাংলাদেশের হয়ে খেলা ওয়ানডে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ইনিংস কোনটা? তাহলে?

পারসেপশন ভেদে একেক জনের কাছে একেক রকম ইনিংস সেরার মর্যাদা পাবে, এটা মোটেই অস্বীকার করা যাবে না। তবে আমি যদি আমার ক্রিকেটীয় পারস্পেক্টিভ থেকে অর্থাৎ কন্ডিশন, দলের সামর্থ্য, প্রেশার, পরিস্থিতি, প্রতিপক্ষের শক্তিমত্তা, রান তাড়া, ম্যাচ জয়ে ভূমিকা ইত্যাদি বিবেচনায় সেরা ইনিংস বাছাই করতে যাই– তবে সবার শীর্ষে থাকবে সাকিব আল হাসানের নাম। হ্যা, আমার মতে বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ওয়ানডে ইনিংস হলো শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সাকিবের সেই অপরাজিত বিরানব্বই!

২০০৯ সাল। আমাদের বাসায় ‘বোকাবাক্স’ নেই। খেলার খবর পেতে হলে তাই বন্ধু বা আত্মীয়দের বাসায় যেতে হয়, নাহয় রেডিওতে কান পাততে হয়। তখন জিম্বাবুয়ে ও শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে বাংলাদেশে ত্রিদেশীয় সিরিজের আয়োজন। ভেন্যু মিরপুর। তৃতীয় ম্যাচে প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কা। রুবেল হোসেনের ডেব্যু ম্যাচ। আকরাম খানের ঐতিহাসিক সেই ম্যাচের মতো এই ম্যাচের সাথেও বৃষ্টি জড়িত। বৃষ্টিতে খেলা শুরু হতে বিঘ্ন ঘটে। কার্টেল ওভারে ম্যাচ নির্ধারিত হয় ৩১ ওভারে। শুরুতে মাশরাফী আর ডেথে রুবেলের দুর্দান্ত বোলিংয়ে লঙ্কানদের ইনিংস গুটিয়ে যায় মাত্র ১৪৭ রানে।

বাংলাদেশের খেলা পারতপক্ষে মিস করি না। তাই ছুটে যাই ফুফুবাড়িতে। ইনিংস বিরতিতে নিজের বাসায় ফিরে আসি। আবার ফুফুবাড়ি পাড়ি দিতে গেলে বাংলাদেশের ইনিংসের শুরুটা মিস হয়ে যেতে পারে– এই ভেবে বেপরোয়া গতিতে ভরদুপুরে প্রতিবেশীর বাসাতেই হানা দেই। প্রতিটা বল দেখা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা যাবে না।

আমাদের জানা ছিল, এই ম্যাচ হারলেই সিরিজ থেকে বাদ পড়বে বাংলাদেশ। নতুন করে জানলাম— শুধু জিতলেই চলবে না, ফাইনাল খেলতে হলে জিততে হবে বোনাস পয়েন্টসহ। ২৫ ওভারের আগে জিতলে বোনাস পয়েন্ট পাওয়া যাবে। টিভির সামনে আয়েশ করে বসতেই ১১ রানে ৩ উইকেট উধাও! টপ অর্ডারের করুণ হাল! মনে রাখতে হবে, তখন ‘আইসিএল’ পরবর্তী যুগ। দল থেকে শাহরিয়ার নাফিস, আফতাব আহমেদ, অলক কাপালিরা সাময়িক বহিষ্কৃত।

সুতরাং সেই জামানায় এমন ম্যাচ জিততে গেলে তামিম ইকবালের ‘ফ্লাইং স্টার্ট’ বাঞ্ছনীয় ছিল। কিন্তু ততোক্ষণে তামিম, জুনায়েদ, মুশফিক প্যাভিলিয়নে ফিরে গেছেন। ইনিংসের এই দুর্বিষহ অবস্থায় বোনাস পয়েন্ট পাওয়া তো দূরের মিনার, টাইগাররা ম্যাচ জিততে পারবে কিনা, সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। পাঁচে নামলেন সাকিব আল হাসান। মোহাম্মদ আশরাফুল ইনিংসের হাল ধরে আছেন। অন্যদিকে, সাকিব এসেই শুরু করলেন বৈঠা বাওয়া অর্থাৎ পাল্টা আক্রমণ!

সাকিব-আশরাফুলের জুটিতে ওঠে ৯১ রান।

ফেভারিট কাট শট, পুল, ফ্লিক, সুইপ, ইনসাইড আউট এরকম বাহারি ও কার্যকরী শট কি নির্ভয়ে খেলে যাচ্ছেন তিনি! তখনকার প্রচলিত ‘পাওয়ার প্লে’ কাজে লাগিয়ে মুহুর্মুহু বল উড়িয়ে মারছেন, গ্যাপ গলে বাউন্ডারি হাঁকাচ্ছেন।

মুরালিধরন, মালিঙ্গা, মেন্ডিজদের নিয়ে গড়া সেই সময়ের ভয়ানক বোলিং অ্যাটাক তছনছ করে দিচ্ছেন কি অবলীলায়! প্রতিপক্ষের বোলারদের লাইন লেন্থের একেবারে বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছেন সাকিব একাই। মনে হচ্ছে, ক্রিকেট খেলা কতোই না সহজ! অন্যদিকে, লঙ্কান কাপ্তান জয়াবর্ধনের কপালে ক্রমশ পড়ছে চিন্তার ভাঁজ।

আশরাফুলকে সঙ্গে নিয়ে সাকিব জুটি গড়লেন প্রয়োজনীয় ৯১ রানের। তবুও আমাদের মনে পরাজয়ের শঙ্কা। ‘ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়’। কেননা, তখন বড় কোনো দলের বিপক্ষে ম্যাচ জিততে হলে ‘আশার ফুল’কে লম্বা ইনিংস খেলতেই হতো। আশরাফুল মাঝপথে সাজঘরে। এখন কী হবে! সাকিব পারবেন? দর্শকের সব আশঙ্কাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে যেন ম্যাচ জেতানোর দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন এই অলরাউন্ডার। রান তাড়ায় অসামান্য দক্ষতা দেখিয়ে একক নৈপুণ্যে দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দিলেন তিনি। হ্যাঁ, সাকিব পেরেছিলেন।

শেষ পর্যন্ত ৬৯ বলে অপরাজিত ৯২ রানের মহাকাব্যিক ইনিংস খেলে দলকে জেতালেন এই ব্যাটার। তিনি যখন মাঠ ছাড়েন, বোনাস পয়েন্ট পেয়ে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো কোনো টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠে গেছে। পাঁচ উইকেটের এই জয় ছিল তখন আমাদের কাছে অভূতপূর্ব, অবিশ্বাস্য এক কীর্তি! আর সাকিব তার এই মহামূল্যবান ইনিংস দ্বারা বাংলাদেশকে কেবল ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালেই তোলেননি, বরং আমাদের মনে এই বিশ্বাসের বীজও বুনে দেন— সাকিব মাঠে থাকলে সবকিছুই সম্ভব!

জয়ের পর সতীর্থের সঙ্গে আলিঙ্গনরত সাকিব।

একুশ বছর বয়সী এক তরুণ, যিনি প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করে বিশ্বমঞ্চে নিজেকে জানান দিয়েছিলেন সেই প্রথম। সেই প্রথম সাকিব সম্ভবত নিজের শক্তিমত্তাও জেনেছিলেন। নিজের প্রতি হয়তো বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল। এরপর থেকে এই অলরাউন্ডারের এমন নৈপুণ্য আমাদের কাছে রোজনামচার মতো হয়ে যায়। তবে এই ম্যাচ থেকেই বাংলাদেশের ক্রিকেটের একপ্রকার বাঁকবদলের আভাস মেলে। পরবর্তীতে, সেই আভাস পদ্মের মতো ভাঁজ খোলে। সেই ভাঁজের অগ্রভাগে থাকে ‘সেভেনটি ফাইভ’।

সাকিব কেবলমাত্র আমাদের সেরা অলরাউন্ডারই হয়ে থাকেন না, তার কয়েক মাস বাদে তিনি পরিণত হন ‘বিশ্বসেরা’ অলরাউন্ডারে। আসীন হন এমন এক শীর্ষচূড়ায়, যে চূড়া থেকে দীর্ঘ দেড় দশক তাকে ‘স্থায়ীভাবে’ নামানো যায়নি। সাকিব হয়ে যান বাংলাদেশের ‘পোস্টারবয়’। আর বাংলাদেশের ক্রিকেট ওয়ানডেতে যে এতোখানি এগিয়েছে বা এগোচ্ছে, তার সূচনাটা হয়েছিল সেদিনের সেই ‘সাকিবীয়’ ম্যাচ থেকে।

আজ ২৪ মার্চ। সাকিব আল হাসানের জন্মদিন। যমুনা নিউজের পক্ষ থেকে তাকে জানাই জন্মদিনের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply