শীর্ষ গণমাধ্যমগুলোর নামে ইউটিউবে ভুয়া খবর ছড়াচ্ছে নকল চ্যানেল

|

বিবিসির নামকরা সাবেক উপস্থাপক হিউ এডওয়ার্ডস বাংলায় খবর পড়ছেন! হট সিটে বসে বলছেন, বিবিসির আন্তর্জাতিক সংবাদে আপনাকে স্বাগতম। শুরুতেই শিরোনাম, পরে বিস্তারিত। কিন্তু না, তিনি এমন কোনো বাংলা ইউটিউব চ্যানেলে যোগ দেননি। বরং তার ছবি ব্যবহার করে সেখানে আরেকজনের কণ্ঠ নকল করে ভিডিও চিত্র তৈরি করছে ‘বিবিসি ওয়ার্ল্ড বাংলা’ নামের একটি ইউটিউব চ্যানেল। যেটি আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা বিবিসির লোগোর আদলে তৈরি করা হয়েছে।

বর্তমানে এরকম আন্তর্জাতিক ও দেশীয় মূলধারার বেশকিছু গণমাধ্যমকে নকল করে বাংলাদেশের দর্শকদের টার্গেট করে ইউটিউবে ভুয়া চ্যানেল গজিয়ে উঠেছে। যেগুলোর মাধ্যমে খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়ছে ভুয়া সংবাদ। বিভ্রান্ত হচ্ছে দর্শক, শ্রোতা ও পাঠক সমাজের অনেকেই। ফলে তাদের একটা বড় অংশ মূলধারার খবরের ওপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে।

ইউটিউবে এসব চ্যানেলগুলোর মধ্যে কেউ কেউ সুপরিচিত সংবাদমাধ্যমের নামের আদলে নিজেদের নাম দিয়েছে। আবার কেউ লোগো নকল করেছে। আবার কেউ কেউ উল্লিখিত ভুয়া সংবাদমাধ্যমের মতো সুপরিচিত কোনো উপস্থাপকের ছবি ব্যবহার করে ভিডিও ছাড়ছে।

‘ডিসমিসল্যাব’ নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক ও দেশীয় চ্যানলগুলোকে নকল করে গজিয়ে ওঠা এরকম ৫৮টি ভুয়া ইউটিউব চ্যানেল খুঁজে বের করেছে। যারা বিবিসি, সিএনএন ও আল জাজিরার মতো গণমাধ্যমকে নকল করে বাংলায় শতাধিক সংবাদ প্রচার করেছে। যেগুলোর মধ্যে কিছু কিছু চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা মিলিয়নেরও উপরে।

এসব ভুয়া চ্যানলের মধ্যে কিছু চ্যানেল আবার ‘ভেরিফাইড’ ব্যাজও ব্যবহার করছে। এতে ধোঁকায় পড়ছে সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে, বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এসব ভিডিও দিয়ে ইউটিউব থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে এসব চ্যানেলের নির্মাতারা।

‘ডিসমিসল্যাবে’র এই সমীক্ষায় সবথেকে বেশি নকলের শিকার হয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা বিবিসি। যাদেরকে নকল করে অন্তত ৩৭টি ভুয়া চ্যানেল রয়েছে ইউটিউবে। যাদের গড় সাবস্ক্রাইবার অর্ধলাখেরও বেশি।

এদের মধ্যে সব থেকে বড় নামধারী চ্যানেল হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক সংবাদ’। যাদের সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা ১ মিলিয়নের ওপরে। এছাড়া, আরও এমন ছয়টি চ্যানেল রয়েছে, যা বিবিসিকে হুবহু নকল করে।

এসব চ্যানেলে দেখা গেছে, বিবিসির উপস্থাপক এডওয়ার্ডস হুবহু বাংলায় কথা বলছে। পাশাপাশি বিবিসির স্টুডিও ও গ্রাফিক্সও হুবহু নকল করে সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে। এমন চ্যানেলগুলো হচ্ছে- বিবিসি ওয়ার্ল্ড লাইভ, বিবিসি নিউজ 24, বিবিসি ওয়ার্ল্ড টিভি, বিবিসি ওয়ার্ল্ড ডেস্ক এবং বিবিসি নিউজ বাংলা।

একইভাবে কাতার ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা, যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক এবিসি এবং যুক্তরাজ্য ভিত্তিক রয়টার্সের নামের আগে ‘বাংলা’ শব্দটি লাগিয়েও ভুয়া খবর প্রচারের তথ্য মিলেছে। তবে এসব চ্যানেলে বিবিসির থেকে তুলনামূলক কম সাবস্ক্রাইবার দেখা গেছে। উল্লেখ্য, ডিসমিসল্যাবের অনুসন্ধানে বেড়িয়ে আসা ৫৮টি চ্যানেলের মধ্যে ৩৭টিই বিবিসিকে নকল করেছে।

অনুসন্ধানে বাংলাদেশি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল যমুনা টিভি, সময় টিভি ও একাত্তর টিভিকে নকল করেও ইউটিউবে সংবাদ প্রচার করার তথ্য পেয়েছে ডিসমিসল্যাব। এদের মধ্যে একটির সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা লাখের কাছাকাছি।

যদিও ইউটিউবের নীতিমালায় এ ধরনের ভুয়া কনটেন্ট তৈরির বিষয়ে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। তাদের নীতিমালা অনুযায়ী, যদি কোনো চ্যানেল অন্য কোনো চ্যানেলের কনটেন্ট, বিষয়বস্তু বা সেগুলোর উৎস নকল করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে, তাহলে সেটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না। এছাড়া, বিভিন্ন সময়ে প্রতারণার উদ্দেশ্যে অন্যের প্রোফাইল, পটভূমি বা সামগ্রিক বিষয়ও নকল করা হয়, যা অবৈধ বলে ঘোষণা দিয়ে রেখেছে ইউটিউব।

বিশেষ করে নিউজ চ্যানেলগুলোর বিষয়ে বলা হয়েছে, মূলধারার গণমাধ্যমকে নকল করা যাবে না। এই নীতি লঙ্ঘন করলে স্থায়ীভাবে সেই ভুয়া চ্যানেল বন্ধ হতে পারে। যমুনা টেলিভিশন, বিবিসি, সিএনএন এবং আল জাজিরাকে নকল করা সেসব ভুয়া চ্যানেলগুলো দিনের আলোর মতোই স্পষ্টভাবে ইউটিউবের নীতিমালা লঙ্ঘন করেছে। তবুও ইউটিউব কর্তৃপক্ষ তাদেরকে শনাক্ত করতে বা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে।

শুধু মিথ্যা সংবাদ ছড়িয়েই থেমে নেই এসব চ্যানেল। কনটেন্টের থাম্বনেইলেও এরা মিথ্যা ছড়িয়ে ইউটিউবের নীতিমালা ভঙ্গ করছে নিয়মিত। ইউটিউবের নীতিতে রয়েছে, এমন কোনো থাম্বনেইল ব্যবহার করা যাবে না, যার ফলে দর্শকরা বিভ্রান্ত হয়। অর্থাৎ ভিডিওতে নেই এমন কিছু থাম্বনেইলে তুলে ধরা যাবে না।

এই গবেষণায় বিবিসিকে নকল করা ১৪টি সক্রিয় চ্যানেলের (১০০০+ সাবস্ক্রাইবার) ১২টি সাম্প্রতিক ভিডিও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। যেখানে দেখা গেছে, এই ১৬৮টি ভিডিওর প্রতিটিতেই থাম্বনেইলে উপস্থাপন করা হয়েছে মিথ্যা তথ্য। যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ভিডিওর বিষয়বস্তুর কোনো ধরনের মিল নেই।

এই ভুয়া চ্যানেলগুলো এমন সব বিষয় নকল করে ভিডিও বানাচ্ছে যার বেশিরভাগই আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী। যেগুলো মূলত ধর্মীয় অনুভূতি অথবা যুদ্ধের উপর নির্ভর করে বানানো হচ্ছে।

উদাহরণ স্বরূপ, ‘আন্তর্জাতিক খবর’ নামের চ্যানেলটিতে ১ মিলিয়নেরও বেশি সাবস্ক্রাইবার রয়েছে। গত ৪ মার্চ তারা একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে। যার থাম্বনেইলে দাবি করা হয়েছে, ‘ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়াচ্ছে ফিনল্যান্ড’। তবে ভিডিওটির মধ্যে এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। 

এছাড়াও এরকম বিভ্রান্তিকর থাম্বনেইলের পাশাপাশি এসব কনটেন্টের শিরোনামও উদ্ভট। যেমন, ‘ভারত ও চীনের মধ্যে পুরোদমে শুরু হয়েছে যুদ্ধ’, ‘ধ্বংস হয়ে গেল ইসরায়েলের রাজধানী’ অথবা  ‘এক রাতেই ৯০ টন পারমাণবিক হামলা’।

এসব থাম্বনেইলগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয় যেখানে দেখা যায় দুই পাশেই বিশ্বনেতাদের ছবি। যেমন, একপাশে জো বাইডেন আরেক পাশে পুতিন। আবার নেতানিয়াহু কিংবা নরেন্দ্র মোদি। বিশ্বনেতাদের মাঝে দেখানো হয় যুদ্ধবিমান উড়ছে, ক্ষেপণাস্ত্র ছুটছে অথবা বোমা বিস্ফোরিত হচ্ছে।

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় ইসরাইয়েলি হামলা শুরুর পর থেকে গত পাঁচ মাসে এসব ভুয়া চ্যানেলগুলোতে যেসব ভিডিও আপলোড করা হয়েছে তার প্রায় প্রতিটিতেই বিভ্রান্তিকর থাম্বনেইল রয়েছে। যেমন, ‘৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ইসরায়েলকে ধ্বংস করা হবে’, ‘ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে ইহুদি সেনাবাহিনীরা’, ‘মারা গেছেন নেতানিয়াহু’, ‘বন্দী করে হত্যা করা হচ্ছে ইসরায়েলি সেনাদের’ অথবা ‘হত্যা করা হল ৬ মিলিয়ন ইহুদি’। এসব থাম্বনেইল মিথ্যা খবর প্রচারের পাশাপাশি সমাজে বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিচ্ছে।

ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের যুদ্ধ নিয়ে মানুষের আগ্রহ যে শীর্ষে তা প্রমাণ করেছে ‘বিবিসি ওয়ার্ল্ড টিভি’ নামক একটি ভুয়া চ্যানেল। দেখা গেছে, তারা এখন পর্যন্ত ১৬৫টি ভিডিও আপলোড করেছে। যারমধ্যে প্রতিটির শিরোনামেই রয়েছে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ সম্বলিত থাম্বনেইল। যেখানে ইসরায়েলের পরাজয়ের বিভিন্ন মিথ্যা খবর রয়েছে। লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে, চালু হওয়ার মাত্র ২ মাসের মধ্যে ১০ হাজারেরও বেশি সাবস্ক্রাইবার পেয়ে গেছে চ্যানেলটি।

নকল করা ১৪টি সক্রিয় চ্যানেলের ভিডিওগুলোর বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এগুলোর প্রতিটিতেই রয়েছে হাজারের বেশি সাবস্ক্রাইবার। এদের মধ্যে আবার ১৩টি চ্যানেলের প্রতিটি ভিডিওতেই একই শিরোনাম ব্যবহার করা হয়। শুধু তারিখ থাকে আলাদা।

যেহেতু তারা প্রতিটি শিরোনামে একই শিরোনামের পাশাপাশি তারিখ উল্লেখ করছে তাই দেখা গেছে, শুধু ‘আন্তর্জাতিক সংবাদ’ শব্দ দুটি লিখে ইউটিউবে সার্চ দেয়া হলে দেখা গেছে, সার্চের মাধ্যমে আসা শীর্ষ দশটি চ্যানেলের মধ্যে অর্ধেকই ভুয়া।

বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এসব ভিডিও থেকেও আয় হচ্ছে প্রচুর অর্থ। যেমন, বিবিসিকে নকল করা সেই ১৪টি চ্যানেলের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এরা ধারাবাহিকভাবে ভিডিও আপলোড করছে। আর এদেরমধ্যে ১২টি চ্যানেলের ভিডিওতে নিয়মিত বিজ্ঞাপন প্রচার হচ্ছে। ফলে, এসব ভিডিওতে মনিটাইজেশন যেমন অন হয়েছে তেমনি ইউটিউবও এসব প্লাটফর্ম থেকে লাভবান হচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের (২০২৩) প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ১৫ বছরের বেশি বয়সের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশিই ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। এছাড়া, ডেটা রিপোর্টাল নামের একটি ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী চলতি বছরের শুরু থেকে বাংলাদেশে ইউটিউব ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন কোটি। তাই, খুব দ্রুত দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে এসব ভুয়া খবর বন্ধে তৎপর হওয়া উচিত।

ইউটিউবের মালিকানা প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালফাবেট ইনকরপোরেশনের নীতিমালায় স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, নকল করা ও প্রতিলিপি তৈরি করা নিষিদ্ধ। এক্ষেত্রে চ্যানেল বন্ধ করে দেওয়া হবে। একইভাবে, দেশের ট্রেডমার্ক আইন (২০০৯) অনুযায়ী, কোনো ট্রেডমার্ক নকল করার সর্বোচ্চ শাস্তি রাখা হয়েছে অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ড। সাইবার নিরাপত্তা আইনে ডিজিটাল জগতে মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে দুই বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধানও রাখা হয়েছে। তবুও কেন ঠেকানো যাচ্ছে না এমন অপতৎপরতা?

/এমএইচ


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply