এমপি আজাদের ‘অন্যায়’ করতে চাওয়ার শাস্তি কি হবে?

|

নূরনবী সরকার

নাটোর-১ (লালপুর) আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদের বক্তব্য সারাদেশে ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা, জীবনভর আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথেই আছেন। ’১৪ সালের নির্বাচনে নৌকার টিকিটে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হন। ওইবার ভোটগ্রহণের আগেই প্রার্থী না থাকায় জয়ী হওয়া ১৫৩ জন এমপির মধ্যে তিনিও একজন।

দ্বাদশ সংসদেও এমপি নির্বাচিত হয়েছেন আবুল কালাম আজাদ। তবে এবার ভোটে লড়ে। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে নৌকার প্রার্থীকে হারিয়ে আইনপ্রণেতা হয়েছেন।

এই দুই নির্বাচনে ব্যয়ের তিনি যে হিসাব দিয়েছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কমিশনের বেঁধে দেয়া খরচে সম্ভব হয়েছে তার ভোট সম্পন্ন করা। এবার নৌকার বিরুদ্ধে লড়ে জয়ী হয়ে আসতে অন্তত ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা খরচ করেছেন বলে জানিয়েছেন আবুল কালাম আজাদ। ভোটের এই খরচের টাকা তোলার কথা বলেই তিনি আলোচনায় এসেছেন।

গত ২৬ মার্চ লালপুর উপজেলা প্রশাসন আয়োজিত স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ সংসদ সদস্য বলেন, ‘নির্বাচনে এক কোটি ২৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এটা আমি তুলব, যেভাবেই হোক। এটুক অন্যায় আমি করবোই। আর করবো না।’

সংসদ নির্বাচনে একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা খরচ করতে পারেন। তিনি এর চেয়ে বেশি করেছেন বলে নিজেই স্পষ্ট করেছেন। যদিও আবুল কালাম আজাদসহ অন্য প্রার্থীদের বাস্তব খরচের সংখ্যা কত, তা নিয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি), দুদক ও এনবিআর বা অন্য সংস্থা খুঁজে দেখেছেন বলে জানা যায়নি।

তবে আমরা নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাবের আনুকূল্য পেতে বেহিসাবি খরচ হয়, এটা শুনি। স্থানীয় থেকে জাতীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক অঙ্গনে কান পাতলে এমন কথা শোনেননি, কেউ হলফ করে বলতে পারবেন না।

এছাড়া, রাজনৈতিক দলগুলো খরচের যে হিসাব ইসিতে জমা দেয়, সেটাও খতিয়ে দেখার কোনো পদ্ধতি আছে বলে মনে হয় না। খুব সম্ভবত এখনকার এই রাজনৈতিক বাস্তবতা জনগণ এক অর্থে মেনে নিয়েছে। কারণ, জনগণ বা মূল নেতাদের অধীনস্ত নেতারাও কথা বলেন না বদলের জন্য।

এবার একটু বিশ্লেষণ করে দেখা যাক, সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ নিজ মুখে যা বলেছেন, তাতে প্রচলিত আইন কতটুকু লঙ্ঘন হয়েছে।

গত ১৫ নভেম্বর ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ৪৪ (খ) অনুযায়ী, দলীয় অনুদানসহ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর নির্বাচনী খরচ ২৫ লাখ টাকার বেশি হবে না। ভোটার প্রতি যার হার ১০ টাকা। তাহলে এই আইনের লঙ্ঘন হয়েছে আবুল কালাম আজাদের বক্তব্যে।

দশম জাতীয় সংসদের এমপি হিসেবে বেতন-ভাতা বাবদ প্রাপ্ত সঞ্চিত অর্থ ২০২৪ সালের ভোটে খরচ করেছেন আবুল কালাম আজাদ। খরচ হওয়া অর্থ এবার তিনি অনিয়মের মাধ্যমে অর্জন করবেন। এটা আসলে প্রচলিত আইনে বিচার্য হবে না। কারণ হিসেবে আপাতত এই ব্যাখ্যা জাহির করছি…

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতির কারণে গত ২ ফেব্রুয়ারি বগুড়ায় ১৯ জনকে আটক করা হয়। পরে তাদেরকে ডিবি অফিসে আনা হয়। এদের মধ্যে ১৮ জনের বিরুদ্ধে জালিয়াতির মামলা দায়ের করে আদালতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানে উম্মে হামিদা নামের একজনকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান বগুড়া-৫ (শেরপুর-ধুনট) আসনের আওয়ামী লীগের এমপি মজিবুর রহমান মজনুর স্ত্রী। উম্মে হামিদার বিষয়ে মজিবুর রহমান মজনু জানান, তিনি (উম্মে হামিদা) তার স্ত্রীর আগের ঘরের সন্তান। ৪ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার বগুড়ার স্টাফ রিপোর্টারকে তিনি এ কথা জানান।

ওইদিন এই ঘটনার বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এমপির স্ত্রী স্বাভাবিক আইনী কর্মকাণ্ডকে বাধাগ্রস্ত করেছেন। সুতরাং তিনিও ফৌজদারী অপরাধ করেছেন।

‘সংসদ সদস্য আচরণ আইন’ প্রণয়ণের দাবি জানিয়ে ওই বিজ্ঞপ্তিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান উল্লেখ করেন, ‘সংসদের অভ্যন্তরে সংসদ সদস্যদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে কার্যপ্রণালী বিধিতে সুস্পষ্ট বিধি-বিধান থাকলেও সংসদের বাইরে তাদের সংযত আচরণ নিশ্চিত ও ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে কোনো আইন নেই। ২০১০ সালের ১৪ জানুয়ারি নবম জাতীয় সংসদের সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী (বর্তমান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী) ১৫টি ধারা সম্বলিত একটি বেসরকারি বিল সংসদে উত্থাপন করেছিলেন। সেটি পাশ হয়নি। নাগরিক সমাজ থেকে বারবার আহ্বান জানানো হলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিলটি পাসের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। সংশ্লিষ্ট অংশীজনের পরামর্শ ও পর্যালোচনার মাধ্যমে সংসদ সদস্য আচরণ বিলটি অবিলম্বে জাতীয় সংসদে পুনরায় উত্থাপন ও আইন হিসেবে পাস করার দাবি জানাচ্ছে টিআইবি।’

সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী, কর্মকর্তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধের আইনে বিচার ও দণ্ডের কথা বলা আছে। কিন্তু এমপি-মন্ত্রীদের ক্ষমতার অপব্যবহার করার বিচার করা যাবে, সেটা বলা নেই ওই আইনে।

ভোটে ব্যয় হওয়া টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে তোলার ঘোষণা দিয়েছেন আবুল কালাম আজাদ; দুদকের আইনি কাঠামো অনুযায়ী এর বিচার করা কঠিন। কারণ, অপরাধ সংগঠিত হওয়ার আগে বিচার করার এখতিয়ার দুদকের নেই।

একটি জাতীয় দৈনিকের অনলাইন সংস্করণে ২০১৮ সালের ১৬ মে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দুদক শীর্ষ সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজদের তালিকা তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। কমিশনের গোয়েন্দা ইউনিট এই তালিকা তৈরি করবে। ২০১৮ সালের কৌশলগত কর্মপরিকল্পনার আওতায় কমিশন বিভিন্ন সরকারি বিভাগ, সংস্থা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সবচেয়ে দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করে শীর্ষ সন্দেহভাজন অসাধু ব্যক্তিদের তালিকা প্রস্তুত করবে। সেই তালিকাতে কিন্তু এমপি-মন্ত্রীদের যুক্ত করার কথা বলা হয়নি।

আবুল কালাম আজাদের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে চলতি বছরের ৩০ মার্চ একটি বেসরকারি টেলিভিশনের অনলাইনে তাদের এক প্রতিবেদনে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব শফিক বলেন, ‘সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ওই এমপির বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলনের অভিযোগে ব্যবস্থা নিতে পারেন স্পিকার ৷ তিনি বিষয়টি সংসদেও তুলতে পারেন অভিসংশনের জন্য ৷ আর ২৫ লাখ টাকার বেশি খরচ করার কথা তিনি যেহেতু স্বীকার করছেন, তাই নির্বাচন কমিশন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে৷ দলের পক্ষ থেকেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’

এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘তিনি (এমপি আবুল কালাম) সংবিধান ও আইনের লঙ্ঘন তো করেছেনই, একইসঙ্গে আমাদের রাজনীতির দেউলিয়াত্ব তার কথায় প্রকাশ হয়েছে৷’

ওই প্রতিবেদনেই সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘যেভাবেই হোক ওই এমপি মুখ ফসকে সত্য কথা বলে ফেলেছেন৷ বাস্তব অবস্থা এরচেয়েও খারাপ।’

এমপি পদের শপথ

সংবিধানের তৃতীয় তফশিলের ১৪৮ অনুচ্ছেদের ৫ নম্বর ক্রমিকে উল্লেখ আছে, এমপিদের শপথ গ্রহণের বাক্যগুলো। ‘আমি যে কর্তব্যভার গ্রহণ করিতে যাইতেছি, তাহা আইন অনুযায়ী বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব।’ আরও উল্লেখ আছে, ‘এবং আমি সংসদ সদস্যরূপে আমার কর্তব্য পালনকে ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত হইতে দিব না।’

যমুনা নিউজে গত ২৯ মার্চ সন্ধ্যা ৭টার সংবাদে প্রচারিত এক প্রতিবেদনে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মন্তব্য করেন, আবুল কালাম আজাদ স্পষ্টত সংসদ সদস্যের শপথ লঙ্ঘন করেছেন। স্পিকার চাইলে ব্যবস্থা নিতে পারেন।

একজন সংসদ সদস্য প্রতি মাসে এমপি হিসেবে কত বেতন-ভাতা বাবদ পান

একজন সংসদ সদস্যের মাসিক বেতন ৫৫ হাজার টাকা। সংসদ সদস্য হওয়ার পর তিনি শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি সুবিধা পেয়ে থাকেন।

একজন সংসদ সদস্য তার নির্বাচনী এলাকায় যাওয়া–আসার ভাতা হিসেবে প্রতি মাসে পাবেন ১২ হাজার ৫০০ টাকা। সম্মানী ভাতা বা আপ্যায়ন ভাতা প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা। মাসিক পরিবহন ভাতা পাবেন ৭০ হাজার টাকা, নির্বাচনী এলাকায় অফিস খরচের জন্য প্রতি মাসে ১৫ হাজার টাকা। এছাড়া প্রতি মাসে লন্ড্রি ভাতা দেড় হাজার টাকা, মাসিক ক্রোকারিজ, টয়লেট্রিজ কেনার জন্য ভাতা ৬ হাজার টাকা, মসজিদ ও মন্দির উন্নয়নে বছরে ৫ লাখ টাকা, দেশের অভ্যন্তরে বার্ষিক ভ্রমণ খরচ ১ লাখ ২০ হাজার টাকা, বাসায় টেলিফোন ভাতা বাবদ প্রতি মাসে ৭ হাজার ৮০০ টাকা দেয়া হয়। তার সব ভাতা করমুক্ত। একজন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা যে চিকিৎসা খরচ পান, একজন সংসদ সদস্য ও তার পরিবার সমান সুবিধা পাবেন।

সংসদ ভবন এলাকা ও পুরোনো সংসদ ভবনের পাশে সংসদ সদস্যদের জন্য ন্যাম ফ্ল্যাটের বরাদ্দ থাকে। আজীবনের জন্য প্লট বরাদ্ধের সুবিধাও পেয়ে থাকেন। সবচেয়ে বড় বরাদ্দ, বছরে ৫ কোটি টাকা পান। ৪০ ধরনের প্রকল্পে সরাসরি এমপির হস্তক্ষেপ রয়েছে।

এত এত সুবিধা থাকার পরও আবুল কালাম আজাদ কেন মাত্র ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা তোলার জন্য দুর্নীতির আশ্রয় নিতে চান? এমপি আজাদের অবৈধ আয় নিয়ে এনবিআর বা দুদককের সন্ধান নিয়ে খবরের কাগজে কিছু ছাপা হয়েছে এমন তথ্য খুঁজে পায়নি।

এ সংসদ সদস্য বলেছেন, ২০১৪ সালের এমপি হিসেবে প্রাপ্ত বেতন-ভাতার টাকা সদ্য অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে ব্যয় করেছেন। তিনি কোনো দুর্নীতি করবেন না ব্যয় হওয়া ওই টাকা তোলার পর। সরল বিশ্বাসে তিনি কথাগুলো বলেছেন বলে জানিয়েছেন। তিনি দুর্নীতি করেননি, অতীতে করবেন না সে প্রত্যয়ও জানান।

কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, এত এত সুবিধা, এমপি হয়ে ব্যবসা পরিচালনাতেও কোনো সমস্যা নেই, তিনি ওকালতি করেন, তাতেও কোনো সমস্যা নেই। কোটি কোটি টাকা লুটপাটের দায়মুক্তির বাজারে তিনি এত ছোট অঙ্কের দুর্নীতি করার কথা বললেন। হয়তো বড় দুর্নীতিবাজরা পর্দার অন্তরালে অট্টহাসি হাসছে।

দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কোনো সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ও জেলে গেছেন, এমন নজির বিগত ১৫ বছরে খুব কম। পুরান ঢাকার তৎকালীন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা হাজী সেলিম আপিল বিভাগে দুর্নীতির মামলায় জেলে গিয়ে জামিনে বের হয়েছেন। আবুল কালাম আজাদ দলের প্রার্থীকে হারিয়ে এমপি হয়েছেন। দল তাকে বহিস্কার করেনি। তিনি আওয়ামী লীগের নেতাও। সংসদে স্বতন্ত্র অবস্থান। বিদ্যমান সকল আইন, চর্চিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি দেখে মনে হচ্ছে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে না। বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির অনুশীলন তাই বলছে। এই ইস্যু প্রায় বিস্মৃত। কদিন পর নতুন ইস্যু আসলে এটা পুরোদমে বিস্মৃত হয়ে যাবে। ক্ষমতাসীন বলয়ের দায়মুক্তির কাল চলছে। সংবিধানের সাত অনুচ্ছেদ জনগণ দেখছে, ক্রমশ তারা নীরব থেকে অধিকতর নীরব হচ্ছেন।

লেখক: সিনিয়র করেসপনডেন্ট, যমুনা টেলিভিশন


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply