সাবজেল থেকে গণভবনে

|

ফাইল ছবি।

মিশুক নজিব ⚫

‘বারান্দায় দাঁড়ালেই দৃষ্টি চলে যায় সবুজ মাঠ পেরিয়ে রাস্তায়… আমি মাঠের এপারে কারাগারে বন্দি। সংসদের একটা বাড়িকে সাবজেল করা হয়েছে। আমি এপারে কারাগার ভবনে আর ওপারেই গণভবন।’

— লিখেছেন শেখ হাসিনা। তার সবুজ মাঠ পেরিয়ে বইয়ে। বর্ণনা করেছেন জেল জীবনের কথা। এক-এগারোয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গ্রেফতার হয়েছিলেন তিনি। বন্দি ছিলেন সংসদ ভবন এলাকার এক ভবনে। যেটিকে তখন সাবজেল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। ৩৩১ দিন বন্দি থাকার পর মুক্তি পেয়েছিলেন ২০০৮ সালের ১১ জুন। এরপর কেটে গেলো ১৬টি বছর। প্রতিবছরই দিনটিকে শেখ হাসিনার কারামুক্তি দিবস হিসেবে পালন করে আওয়ামী লীগ।

এই ১৬ বছরের মধ্যে কেবল ৬ মাস ক্ষমতাহীন ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। টানা চার মেয়াদে সাড়ে ১৫ বছর ধরে ক্ষমতার মসনদে তিনি। অথচ এই পথ সহজ ছিল না মোটেও।

২০০৮ সালের জুনে শেখ হাসিনা যখন জেল থেকে মুক্তি পেলেন, তখনও দেশের রাজনীতির আকাশে মেঘের ঘনঘটা। দেশ শাসন করছে সেনা সমর্থিত ড. ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বছরের শেষ দিকে নির্বাচন দেয়ার কথা বলছিল তারা। কিন্তু তাতে পুরোপুরি ভরসা পাচ্ছিল না বড় দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।

নির্দলীয় এই সরকারের আমলে প্রধান দুই দলেরই সর্বোচ্চ নেতা জেল খেটেছেন। নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের নেতা থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অসংখ্যা নেতা কারাবন্দি হন। কেউ আবার গ্রেফতার এড়াতে পলাতক ছিলেন। ২০০৮ সালের কয়েক মাস পেরুতেই রাজনীতিবিদরা জামিনে মুক্তি পেতে শুরু করলে তাতেই কিছুটা স্বস্তির সুবাতাস পাচ্ছিল দলগুলো। কিন্তু তা মোটেও আস্থা রাখার মতো ছিল না। আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনা তো তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। তাই তো ওই সময়ের কথা বইয়ে লেখার পাশাপাশি এখনও সুযোগ পেলে বলতে ছাড়েন না।

জুনে কারামুক্তি পেয়েই চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যান শেখ হাসিনা। চিকিৎসার পাশাপাশি সেখানে বসে দল গোছানোর কাজটিও সারছিলেন তিনি। দলে যারা মাইনাস ফর্মুলা চেয়েছিলেন, তাদের সামলিয়েছেন বেশ ভালোভাবে। ৬ নভেম্বর দেশে ফিরে ভোটের লড়াইয়ে নামেন শেখ হাসিনা। নির্বাচনের প্রস্তুতিও নেন যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে বসে। দেশটিতে চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই তার অস্থায়ী জামিনের মেয়াদ কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছিল। ঢাকায় ফেরার পর স্থায়ী জামিন দেয়া হয় তাকে।

শেখ হাসিনা যখন দেশে ফেরেন, তার আগেই ঘোষণা করা হয় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল। শেখ হাসিনা এই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন৷ এরপরই ছুটে আসেন দেশে। তার দেশে ফেরা নিয়ে নভেম্বরের শুরুতে আওয়ামী লীগের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ডিসেম্বরের নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে শেখ হাসিনা দেশে ফিরছেন৷

সেইবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ভোটে অংশ নেয়। দেশ চষে বেড়ান শেখ হাসিনা। নানা প্রান্তে নানা সমাবেশে অংশ নিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। সেই ভোটে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসনে জয়লাভ করে দলটি। আর শেখ হাসিনা ফেরেন সবুজ মাঠের পাশে গণভবনে। টানা ১৪ বছরের বেশি সময় সেখানে আছেন বাংলাদেশের সরকারপ্রধান।

কিন্তু এর পাশেই এক-এগারোর সময় যেই ভবনটিকে সাবজেল ঘোষণা করে তাকে বন্দি রাখা হয়েছিল, সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা তো ভুলতে পারেননি শেখ হাসিনা। মহাজোট সরকারে আসার পর ২০১০ সালের ৫ মার্চ গণভবনে ওঠেন তিনি। পরদিন সকালের বর্ণনা সবুজ মাঠ পেরিয়ে দিয়েছেন এভাবে

গণভবন ৬ মার্চ, ২০১০

গণভবনে প্রথম সকাল। গতকাল যমুনা থেকে গণভবনে এসে উঠেছি। এখানে এসেই প্রথমে দক্ষিণের জানালা খুলে দাঁড়ালাম। সংসদ ভবনের যে বাড়িটায় আমাকে বন্দি করে রেখেছিল, সেটা দেখা যায় কি না! গাছের ফাঁক দিয়ে বাড়িটা দেখা যাচ্ছিল।

আল্লাহ সবই পারেন। গণভবনের মাঠ, তারপর রাস্তা, পাশে লেক, তারপরই বিশাল খেলার মাঠ। ওই মাঠের পাশেই বাড়িটায় বন্দি ছিলাম। আর এখন সেই সবুজ মাঠ পেরিয়ে যে গণভবন, সেখানে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উঠেছি।

/এমএন


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply