নীলে ছায়া আসমান, লালে লাল দুনিয়া। ফেসবুক যেন ফাগুনের কৃষ্ণচূড়া। যেদিকে তাকাই, কৃষ্ণচূড়ার রক্তিম রঙ। গোলাকার অথবা বর্গাকার, লাল রঙ হয়ে উঠেছে যেন নবীন প্রভাতের নবারুণ।
সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুক আজ সয়লাব লাল বর্ণে। প্রোফাইল পিকচার অথবা কাভার ফটোতে লাল রঙ। স্টোরি কিংবা ফটোকার্ডে লাল রঙ। কেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ফেসবুকে এই রঙ বেছে নিয়েছে?
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে সহিংসতায় নিহতদের স্মরণে আজ পালিত হচ্ছে শোক। কিন্তু সরকার ঘোষিত এই শোক প্রত্যাখ্যান করে এটিকে প্রহসন উল্লেখ করে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি অংশ। এর বদলে আজ লাল কাপড় চোখে-মুখে বেঁধে ছবি তোলা এবং অনলাইনে প্রচার কর্মসূচি ঘোষণা করেছে আন্দোলনকারীরা।
ফলে সোমবার রাত থেকেই ফেসবুকে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রোফাইল পিকচার ও কাভার ফটো হিসেবে লাল রং বেছে নেন। অনেকে কর্মসূচির অংশ হিসেবে মুখে ও চোখে লাল কাপড় বাঁধা একক বা দলীয় ছবিও নিজের দেয়ালে পোস্ট করেন।
তবে ফেসবুক ঘুরলেই টের পাওয়া যাচ্ছে– এটি আর শুধু শিক্ষার্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ফেসবুকে শিক্ষার্থীদের নতুন এই ট্রেন্ডে যোগ দেন দেশের বিভিন্ন স্তরের পেশাজীবী মানষেরাও। অন্যদিকে, সরকারের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণার কারণে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের কালো রঙের প্রোফাইল শেয়ার করতে দেখা যাচ্ছে।
লাল শক্তি, যুদ্ধ বা বিদ্রোহের প্রতীক। লাল রঙ ভালোবাসার প্রতীকও। বিপদ সংকেত হিসেবেও ব্যবহৃত হয় রক্তিম এই বর্ণ। কেউ কেউ ফেসবুক প্রোফাইলের এই লাল রঙকে ফুটবল মাঠের ‘রেড কার্ড’ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। রেড কার্ড দেয়া হয়, যখন মাঠ থেকে একজন খেলোয়াড় বা কোচকে উঠে যেতে বলা হয়।
কেউ কেউ লাল রঙের ফটো পোস্ট করে ক্যাপশনে লিখেছেন– ‘ফুলগুলো সব লাল হলো কেন’? যেমন নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরী তার ফেসবুক প্রোফাইল পিকচারের ক্যাপশনে একই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন। এটি রাজীব আশরাফের লেখা ও অর্ণবের গাওয়া বিখ্যাত গান ‘হোক কলরব’-এর লিরিক অবলম্বনে।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয় ‘হোক কলরব’ আন্দোলন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর শ্লীলতাহানির ঘটনার নিরপেক্ষ বিচারের দাবি নিয়ে ‘হোক কলরব’ স্লোগানে প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। তিন দিন পর হঠাত মধ্যরাতে বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জ নেমে আসে। আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ঢেউ আছড়ে পড়ে দিল্লি, মুম্বাই, বেঙ্গালুরুসহ নানা শহরে। ‘হোক কলরব’ ছড়িয়ে যায় বিশ্বব্যাপী। এই শব্দবন্ধটি বনে যায় ছাত্র আন্দোলনের শাশ্বত স্লোগানে।
ফেসবুককে লাল রঙে রাঙ্গানোর এই মিছিলে সামিল হয়েছেন তারকা বা সেলিব্রেটিরাও। নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী তার ফেসবুক প্রোফাইলে লাল রঙের মাঝে মানচিত্রের একটি ছবি প্রকাশ করেছেন। একই ছবি প্রকাশ করতে দেখা গেছে বরেণ্য সংগীতকার প্রিন্স মাহমুদকেও। নির্মাতা আশফাক নিপুণও ‘ন্যায়বিচার বিলম্বিত হওয়া মানে ন্যায়বিচার অস্বীকার করা’ ক্যাপশনে লাল রঙের একটি ছবি প্রকাশ করেছেন।
এছাড়া এরমধ্যে আছেন নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমন, খিজির হায়াত খান, প্রযোজক সারা আফরীন, রেদওয়ান রনি, নির্মাতা আকরাম খান, মোহম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ, জাকিয়া বারী মম, মোস্তফা মনোয়ার, চিত্রনায়ক নিরব, নায়িকা বিপাশা কবীর, সোহেল রানা, শাহনাজ সুমি, সুনেরাহ বিনতে কামাল প্রমুখ।
দুদিন আগে শহর সেজেছিল গ্রাফিতির মোড়কে। দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছিল মিছিলের গান। রঙমশাল থেকে ঠিকরে বের হওয়া স্লোগানে ঠাঁই মেলে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের কথা। নির্বিচার হত্যার বিচার বা বিক্ষোভের কথা। পরের দিন দেখা যায়, সেসব দেয়াল লিখনের কিছু কিছু স্লোগান কালো কালি দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়।
আর আজ ফেসবুকে পুরো দেশটাই যেন লালময়। এখানে কালো কালি দিয়ে মোছার কোনো যন্ত্র নেই, শক্তি নেই। মানুষ নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় জানান দিচ্ছে– তারা প্রতিটি নির্বিচার হত্যার বিচার চায়।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখিত অসংখ্য জনপ্রিয় কবিতা রয়েছে। তার মধ্যে একটি ‘কুলি-মজুর’। লাল রঙ্গে অনলাইন রাঙ্গানো বহুজন সেই কবিতার দুটি লাইন ক্যাপশনে শেয়ার করেন–
‘আসিতেছে শুভদিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ!’
গ্রন্থনা: আল মাহফুজ
Leave a reply