ড. ইসলাম শফিক ⚫
ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় টেলিভিশনের সংবাদ, অনুষ্ঠান, ফিলার, টকশো, স্ক্রল নিউজ, ব্রেকিং নিউজ অর্থাৎ প্রচার কনটেন্টের তাবৎ চেহারা। গত এক সপ্তাহে বাংলাদেশের টিভিগুলোর পর্দায় চোখ রেখে এটার বাস্তবিক প্রমাণ পাওয়া যায়। স্তাবকতা, অতিমাত্রায় তৈল প্রদানের চিত্র দেখা যাচ্ছে টিভি স্ক্রিনে। খোলস বদলে আরেক নয়া খোলসে প্রবেশ করছে এরা। বাংলাদেশের ষাট বছরের টিভি ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম হিসেবে টেলিভিশন পরিচালনার সম্পাদকীয় নীতিমালার সকল রীতিনীতি বিসর্জন দিয়ে ক্ষমতার কাছে নতজানু হয়েছে টেলিভিশন! ঊনবিংশ শতাব্দীর বিস্ময়কর আবিষ্কার এই ‘টেলিভিশন’ পুরো বিশ্বসমাজকে বদলে দিয়েছিল। টেলিভিশন পৃথিবীব্যাপী গণমানুষের অধিকার আদায়ের কথা বলে, সত্য উচ্চারণ করে, মানুষকে সঠিক তথ্য প্রদান করে, পথ দেখায়, সচেতন করে, প্রদান করে প্রকৃত জ্ঞান-শিক্ষা ও তৈরি করে মার্জিত রুচিবোধ।
বাংলাদেশে টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হয়েছিল পাকিস্তান শাসনামলে ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর ‘ঢাকা টেলিভিশন’ সম্প্রচারের মধ্যদিয়ে। ১৯৬৪ সালে থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত বিটিভি একমাত্র টেলিভিশন চ্যানেল ছিল। ১৯৯৭ সালের ১৫ জুলাই ‘এটিএন বাংলা’ দেশের প্রথম স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল হিসেবে সম্প্রচারে আসে। ‘চ্যানেল আই’ পথচলা শুরু করে ১৯৯৯ সালের ১ অক্টোবর। বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি টেরেস্ট্রিয়াল টেলিভিশন হিসেবে ২০০০ সালের ১৪ এপ্রিল ‘একুশে টেলিভিশন’ সম্প্রচারে আসে। পরবর্তীতে অবশ্য টেরেস্ট্রিয়াল সম্প্রচার অনুমোদন বাতিল করা হয়। প্রখ্যাত সাংবাদিক সাইমন ড্রিংয়ের নেতৃত্বে একুশে টেলিভিশনের এক ঝাঁক তরুণ বাংলাদেশের টেলিভিশনের বাঁকবদল করেন। ২০০৩ সালের ৩ জুলাই সম্প্রচারে আসে ‘এনটিভি’। অল্পদিনেই ‘এনটিভি’ মানুষের মন জয় করে নেয় এবং আস্থা লাভ করে সাধারণ দর্শকের। ‘একুশে টেলিভিশন’ ও ‘এনটিভি’র সংবাদ পরিবেশনা ও অনুষ্ঠানের বৈচিত্রে নতুন চেহারা পায় বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম। এই দুটি টিভি চ্যানেলের অভূতপূর্ব সফলতায় বাংলাদেশে শক্তিশালী গণমাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে টিভি মাধ্যম। শুরু হয় কর্তৃত্ব গ্রহণের লড়াই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক শক্তির নেতা, সাংবাদিক নেতা ও শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীরা টিভি চ্যানেলের মালিকানার জন্য দৌঁড়ঝাঁপ শুরু করেন। এই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে টিভি চ্যানেলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের একটি তালিকা থেকে জানা যায়, এ পর্যন্ত ৪৮টি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের জন্য তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে অনাপত্তিপত্র প্রদান করা হয়েছে। বর্তমানে সম্প্রচারে আছে ৩৬টি। এরমধ্যে নিউজ টিভি রয়েছে এখন ডজন খানেক। বাকী টিভিগুলো সংবাদ ও অনুষ্ঠানের মিশ্র চ্যানেল। এসব টিভি চ্যানেলগুলো কনটেন্টের সম্প্রচার প্রকাশভঙ্গি বিশ্লেষণে দেখা যায়, পেশাদারভাবে বাণিজ্যিক সফলতা এখানে প্রশ্নবিদ্ধ! রাজনৈতিক বিবেচনায় টিভি চ্যানেলের অনাপত্তি জোগাড় করে অনেকে নেমে গেছেন ক্ষমতা দখল ও শক্তির খেলায়! বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলের মালিকানায় যারা আছেন, তারা বেশিরভাগ রাজনীতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত ব্যবসায়ী, সাংবাদিক নেতা অথবা রাজনৈতিক ব্যক্তি।
প্রশ্ন হলো, টেলিভিশনশিল্প গণমাধ্যম হিসেবে বিগত ষাট বছরে কতটুকু গণমানুষের মাধ্যম হতে পেরেছে? নাকি শাসকশ্রেণির স্তাবকতা ও অসাধু ব্যবসায়ীর ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে? বিষয়টি খোলাসা করার জন্য ফ্ল্যাশব্যাকে টেলিভিশনের সাদা-কালো ও সদ্য রঙিন যুগের ইতিহাসের পাতা দেখা আসা যাক।
১৯৬৪ সালে পাকিস্তান শাসনামলে ঢাকা টিভি ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের সামরিক সরকারকে বৈধতা দেবার পক্ষে জনমানুষের মনে স্থান করে নেবার জন্য ঢাকায় ও লাহোরে টিভি স্টেশন চালু করা হয়। ২৫ মার্চ ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খান ক্ষমতা হস্তান্তরের পূর্ব পর্যন্ত টিভিকে নিজের প্রচারযন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সরকার টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধ করে দেয়। ১৯৬৭ সালের ২৩ জুন পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রসংগীত প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণ করে একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। প্রচারের পূর্বে সংবাদ ও অনুষ্ঠানের স্ক্রিপ্ট লাহোরে পাঠিয়ে পাশ করিয়ে নিতে হতো।
১৯৭১ সালের ১৬ জিসেম্বর মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর টেলিভিশনের নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ টেলিভিশন। নতুন দেশ, নতুন পরিবেশে দেশ গড়ার প্রত্যয়ে জামিল চৌধুরীর নেতৃত্বে শুরু হয় বিটিভির পথচলা। কিন্তু শুরু থেকেই বিটিভি সরকারের মুখপাত্র হিসেবে সরকারি খবর প্রচার করতে থাকে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়রি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় ফিরে আসার পর সরকারপ্রধান হলেন। শুরু হলো তাকে নিয়ে টেলিভিশনের মাতামাতি। অতি উৎসাহীদের আগ্রহে সংবাদে-অনুষ্ঠানে-ফিলারে সর্বত্র শেখ মুজিব। বাংলাদেশ টেলিভিশনকে আক্ষরিক অর্থেই বোঝানো হত বঙ্গবন্ধু টিভি। বঙ্গবন্ধু ও তার সরকার কখন কোথায় কী করতেন, সেই খবর প্রচারই ছিল তখন বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রধান এজেন্ডা। ১৯৭৩ সালে প্রতিদিন ফিলার প্রচারের জন্য ‘বজ্রকণ্ঠ’ শিরোনামে একটি অনুষ্ঠানের প্রস্তাবনা আসে। টিভি স্ক্রিনের শুরু হয় অরাজকতা! অপেশাদার এই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করেন শ্রদ্ধেয় জামিল চৌধুরী। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে তিনি বলেন, এই ‘বজ্রকণ্ঠ’ অনুষ্ঠান প্রতিদিন বারবার টিভিতে প্রচারিত হলে সাধারণ মানুষ বিরক্ত হবে, আপনার ইমেজ ক্ষুণ্ন হবে, আপনার গ্রহণযোগ্যতা কমে যাবে। প্রকারান্তরে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হবে। বঙ্গবন্ধু জামিল চৌধুরীর কথাগুলো গভীর মনোযোগ সহকারে শুনে ‘বজ্রকণ্ঠ’ অনুষ্ঠান বন্ধ করার নির্দেশ দেন। তদুপরি ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ টেলিভিশনকে আক্ষরিক অর্থেই বোঝানো হত বঙ্গবন্ধু টিভি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর বিটিভি ফিরে যায় পাকিস্তান সামরিক শাসন কাঠামোর ন্যায় পূর্বতন চেহারায়। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশ টেলিভিশনও রাতারাতি রূপ পাল্টে হয়ে গেল মোশতাক টিভি। তাই জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের পর ‘বিটিভি’র দিকে তিনি বেশি নজর রাখেন। সংবাদে নিয়মিত কয়েকটি সেগমেন্টে তাকে দেখাতে হতো। খালকাটা কর্মসূচি, দেশে কৃষিবিপ্লব, শিল্পবিপ্লব প্রভৃতি বিষয়ে তাকে নিয়ে নির্মিত ফিলার, গান ও প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হতো। ব্যঙ্গ করে অনেকে বলতেন ‘জিয়া টিভি’। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর ১৯৮১ সালের ৩০ মে পর্যন্ত বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভিডিওতো দূরের কথা নামটি পর্যন্ত উচ্চারণ নিষিদ্ধ ছিল!
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন। বাংলাদেশ টেলিভিশন রাতারাতি চেহারা পাল্টে হয়ে গেলে জেনারেল এরশাদ টিভি। তার উন্নয়ন, বন্যায় পানিতে নেমে ত্রাণ বিতরণ, তার লেখা গান-কবিতা চলতো একটু পরপর। সার্বক্ষণিক সঙ্গে থাকতেন ফার্স্ট লেডি রওশন এরশাদ। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা থেকে বিদায়ের আগ পর্যন্ত সময়কালে বাংলাদেশ টেলিভিশনকে বলা হতো ‘সাহেব-বিবির বাক্স’।
খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালের ২০ মার্চ সরকার গঠন করেন। বিটিভি যথারীতি নিজের চেহারা বদলে ফেলে হয়ে যায় ‘বেগম জিয়া টিভি’। ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ পর্যন্ত বিএনপির প্রচারযন্ত্র হিসেবে কাজ করে বিটিভি। খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রচারের পাশাপাশি যোগ হয় জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক আদর্শ, বক্তব্য ও নানা কর্মসূচির ভিডিওচিত্র।
১৯৯৬ সালের ২৩ জুন, শেখ হাসিনা প্রথমবার সরকার গঠন করেন। বিটিভি কালবিলম্ব না করে ফিরে যায় বঙ্গবন্ধুর আমলে, শুরু হয় শেখ হাসিনা ও বঙ্গবন্ধু বন্দনা। মুছে ফেলা হয় এরশাদ-জিয়া-খালেদার ফুটেজ। সারাক্ষণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকারের খবরাখবর প্রচার করতে থাকে। নতুন নামকরণ হয়ে যায় ‘আওয়ামী টিভি’। ২০০১ সালের ১৫ জুলাই পর্যন্ত বিটিভি ‘আওয়ামী টিভি’ হিসেবে ‘নিষ্ঠার’ সাথে দায়িত্ব পালন করে। বিটিভি সর্বদা সরকারের পালাবদলে নিজের রূপবদল করেছে। কালে কালে নাম হয়েছে— বঙ্গবন্ধু টিভি (বিটিভি), মোশতাক টিভি (এমটিভি), জিয়া টিভি (জিটিভি), সাহেব-বিবির-গোলাম বাক্স, খালেদা টিভি, আওয়ামী টিভি বা বাতাবি লেবুর বাম্পার ফলন!
আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে শেখ হাসিনা সরকার বেসরকারি পর্যায়ে দুটি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল ‘এটিএন বাংলা’ ও ‘চ্যানেল আই’ এবং বেসরকারি পর্যায়ে টেরিস্ট্রিয়াল সম্প্রচার প্রযুক্তিতে ‘একুশে টেলিভিশনকে’ লাইসেন্স প্রদান করে। শুরু হয় বেসরকারি পর্যায়ে ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন!
খালেদা জিয়া ২০০১ সালের ১০ অক্টোবর পুনরায় সরকার গঠন করে। এক মুহূর্ত দেরী না করে বাংলাদেশ টেলিভিশন ‘আওয়ামী টিভি’র খোলস থেকে নিজেকে মুক্ত করে হয়ে যায় জাতীয়তাবাদী টেলিভিশন। বিটিভি তখন পূর্ণদমে বিএনপি’র মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে। তারেক জিয়া ও আরাফাত রহমান কোকোও এবার স্থান পায় বিটিভি’র পর্দায়। এই প্রথা চালু ছিল ২০০৬ সালের ২৯ অক্টোবর সময়কাল খালেদা জিয়া দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা থাকাকাল পর্যন্ত। পক্ষপাতমূলক সংবাদ প্রচার ও অবৈধভাবে টেরিস্ট্রিয়াল ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০২ সালে একুশে টেলিভিশনকে বন্ধ করে দেয়। পাশাপাশি ২০০৪ সালে অনুমোদন দেয়া হয় ‘এনটিভি’কে।
প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন : মর্দনে তেল ভক্ষণে ঘি!
প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন মানেই তৈল দিয়া তৈল বাহির করা! প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ ও সংবাদ সম্মেলন একযোগে সম্প্রচারের জন্য সকল টিভি চ্যানেলে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করে বাধ্যতামূলক চিঠি দেয়া হতো। দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচিত হয়ে আগত বেশিরভাগ সাংবাদিক এতো বেশিমাত্রায় তেলযুক্ত প্রশ্ন করতেন, সেটা আর শেষ পর্যন্ত সংবাদ সম্মেলন না হয়ে ‘সঙ সম্মেলন’য়ে পরিণত হয়েছিল। ১৪ জুলাই ২০২৪, রোববার প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর পরবর্তী গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে কোটা আন্দোলন প্রসঙ্গে প্রশ্ন করেন সাংবাদিক ফারজানা রূপা ও প্রভাষ আমিন। এই সংবাদ সম্মেলনে পূর্বেও প্রমাণিত হয়েছে দলবাজি, তেলবাজির নগ্নসংস্কৃতি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে মন্তব্য করেছেন, ‘সাংবাদিক মোজাম্মেল বাবু, সাংবাদিক ফারজানা রূপা ও সাংবাদিক প্রভাষ আমিন-এর দেয়া অতিমাত্রার তেলে ডুবে গেলেন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা।’ এই প্রসঙ্গে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী’র ‘তৈল’ প্রবন্ধের কথা অবশ্যই সামনে আনতে হয়—‘বাস্তবিকই তৈল সর্বশক্তিমান; যাহা বলের অসাধ্য, যাহা বিদ্যার অসাধ্য, যাহা ধনের অসাধ্য, যাহা কৌশলের অসাধ্য, তাহা কেবল একমাত্র তৈল দ্ধারা সিদ্ধ হইতে পারে।’
অনেকে বলেন তেলের বাজারের মূল্য বৃদ্ধিতে এই সংবাদ সম্মেলনই দায়ী! আবার অনেককে উইট করে বলতে শুনেছি— প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন চলাকালে টিভি সেটের নিচে বিশাল আকারের খালি পাত্র রেখে দিয়েছেন, বৃষ্টির পানি ধরার মতো টিভি সেট থেকে উছলে বেয়ে পড়া তেলের ঝর্ণাধারা ধরার জন্য! আদতে এই সংবাদ সম্মেলন পরিণত হয়েছিল একটি চরম পরিহাসমূলক বিনোদন ও সাংবাদিকগণের পিকনিক অনুষ্ঠানে। সংবাদ সম্মেলন শেষে ঘোষণা আসতো সকলের জন্য আপ্যায়নের ব্যবস্থা রয়েছে অর্থাৎ ‘মর্দনে তেল ভক্ষণে ঘি’ এই নীতি তারা অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালন করে থাকতেন!
টকশোতে তেলের তেলেসমাতি
কনটেন্ট প্রচারের দিক থেকে টিভি হলো ভীষণ ক্ষুধার্ত একটি মাধ্যম। প্রতিদিন প্রয়োজন হয় অনেকগুলো শ্লটের জন্য স্বতন্ত্র অনুষ্ঠান। টেলিভিশনের এসব অনুষ্ঠান নির্মাণ ব্যয়বহুল এবং অনেক সৃজনশীল চিন্তাভাবনার একটি বিষয়। এসবের বিপরীতে সহজ উপায় হলো কম খরচে দুই-তিনজনকে আমন্ত্রণ জানিয়ে লাইভ টকশো করা। এসব টকশো বেশিরভাগ সমসাময়িক বিষয় বা রাজনৈতিক আলাপ বিশ্লেষণ নির্ভর! পর্যায়ক্রমে রাতে শুরু হওয়া এই টকশোগুলো দেখলে মনে হয়, এগুলো টিভি অনুষ্ঠান নয়, রাজনৈতিক মাঠের যুদ্ধক্ষেত্র! বিরুদ্ধ মতের কাউকে আনা যাবে না! নিষেধাজ্ঞা থাকে বহুবিদ, প্রদেয় তালিকা থেকে আসা টকারগণ টিভিতে এসেই শুরু করেন নির্লজ্জ তৈলবর্ষণের কথাজুড়ি!
চলছে আগস্ট মাস, আজ কোনো টিভিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কোনো কিছু নেই! নেই শোক ডঙ্গল, নেই শেখ হাসিনা, নেই আওয়ামী লীগ। একসঙ্গে একসাথে সব পরিবর্তন! বিগত তিনটি দিন প্রায় সব টিভিতে দিনরাত খুব করে চললো লন্ডন থেকে প্রেরিত ভিডিও বক্তব্য। আর লাইভ দেখানো হলো পল্টনের সমাবেশ! আবার বদল ঘটেছে টিভিগুলোর রাজনৈতিক সম্পাদনা কৌশল! মুক্তভাবে লেজুড়বৃত্তি না করে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ও অনুষ্ঠান দেখতে চায় সাধারণ দর্শক। টিভি মাধ্যমগুলোর নির্লজ্জ দলীয়করণের কারণে দর্শক টিভি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন! এর দায় টিভিমাধ্যমের নয়, এর দায় টিভি পরিচালনার নেপথ্য ব্যক্তিগণের!
সমকালীন টিভি দর্শক এখন ভীষণ সচেতন। জেনারেশন জেড, জেনারেশন আলফা— এরা ট্রেডিশনাল মিডিয়ার লিনিয়ার সম্প্রচার পদ্ধতির টিভি দেখে না। তাদের হাতে আছে নিউ মিডিয়া, হাতে আছে অন ডিমান্ড মিডিয়া ও ওটিটি। বিশ্বজগত এখন তাদের হাতের মুঠোয়। জেন জেড বা আলফা জেনারেশনের উপযোগী করে টিভি কনটেন্ট তৈরির জন্য সর্বাগ্রে টিভি পরিচালনার সম্পাদকীয় নীতি-কৌশলের পরিবর্তন প্রয়োজন! অবাধ, নিরপেক্ষ, সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্য প্রচারমাধ্যম হোক টিভি মিডিয়া। সত্যিকার অর্থে গণমানুষের পক্ষের মাধ্যম হোক শক্তিশালী এই আধুনিক গণযোগাযোগের প্রচার মাধ্যমটি। আর যদি টেলিভিশন সমকালীন তরুণ প্রজন্মের ভাষা না বুঝে, যদি তরুণদের চিন্তাচেতনাকে ধারণ না করে পূর্বতন রূপে সাহেব-বিবি-গোলাম বাক্স অতঃপর একটি বাতাবি লেবুর বাম্পার ফলনের গল্প বলে, তবে অচিরেই জাদুঘরে যেতে হবে এই বোকাবাক্সকে!
লেখক: শিক্ষক, গবেষক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব
Leave a reply