আহনাফ, তোমার মৃত্যু আমাদের অপরাধী করে দেয়..

|

আল মাহফুজ ⚫

‘মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়
অতীতের থেকে উঠে আজকের মানুষের কাছে
প্রথমত চেতনার পরিমাপ নিতে আসে।’

জীবনানন্দ দাশের ‘মানুষের মৃত্যু হলে’ কবিতা। পংক্তিগুলো যেন জয়গান গায় সেই ধ্রুব সত্যের– ‘ব্যক্তি মানুষের মৃত্যু হতে পারে কিন্তু আদর্শ বা চেতনার মৃত্যু নেই’। কবিতাটা জগতের সকল বিপ্লবীদের সম্পর্কে বয়ান না দিলেও আমরা ধরে নিতে পারি– অতীত হয়ে যাওয়া যোদ্ধারাই প্রথমত চেতনার পরিমাপ গুনতে আসে। তারা আসে স্বাধীন সত্তার কাছে। তারা আসে এই আলো বাতাসে বেঁচে থাকা প্রতিটা হৃদয়ের সুলুক সন্ধানে। তাদের কি মনে রাখা হয়েছে?

ইতিহাস বিপ্লবের নতুন পথ রচনা করে, হয় প্রতিবিপ্লব। ইতিহাস অভ্যুত্থানের গল্প বলে, বলে স্বাধীনতার জন্য রক্ত ঝরানোর কথাও। নদীর স্রোতের মতো গণমানুষের আন্দোলনও তাতে উঠে আসে। কখনও কখনও সেটা অনন্য হয়ে ওঠে নেতৃত্বগুণে। বিপ্লবের মহান ব্রত ঢেকে দেয় মৃত্যুর শঙ্কা। তেমনই এক বিপ্লবী চে গুয়েভারা। যার অনাহুত প্রাণহানির বেদনা জর্জরিত করে পৃথিবীব্যাপী অজস্র মানুষকে। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যাকে নিয়ে লিখেছিলেন– ‘চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।’

গিটার হাতে শহীদ আহনাফ

আমরা সেই বাক্যটার অনুরণন তুলতে পারি। আজ বলতে পারি– ‘আহনাফ, তোমার মৃত্যু আমাদের অপরাধী করে দেয়।’ হ্যাঁ, বলছি শহীদ শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফের কথা। রাজধানীর বিএএফ শাহীন কলেজের ছাত্র, যার বয়স হয়েছিল ১৭ বছর। তারুণ্যে পদার্পণ করার স্বর্ণালি সময়টাও যার আস্বাদন করা হয়নি। রাষ্ট্রযন্ত্রের বুলেট ঝাঁঝরা করে দেয় কিশোরের স্বপ্নভরা বুক। বুক তার যেন বাংলাদেশের হৃদয়। যে হৃদয় খুব করে চেয়েছিল বৈষম্যবিহীন এক সমাজের।

গত ৪ আগস্ট রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বরে ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে গুলিতে নিহত হয় আহনাফ। আহনাফের যেদিন মৃত্যু হয়, তার পরদিন বাংলাদেশে এক অভিনব গণঅভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটে। দেশজুড়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ ও দেশত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। কিন্তু অভ্যুত্থানের সফল সমাপ্তি দেখা হয়ে ওঠেনি বুলেটবিদ্ধ আহনাফের। বিজয়ে উদিত সূর্যের কয়েক ঘণ্টা আগে জীবন বাতি নিভে যায় তার।

জুলাইয়ে জোয়ার ওঠা শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন একপর্যায়ে পরিণত হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে। শত শত প্রাণের বিনিময়ে আন্দোলন বিজয়ের বরমাল্য নিয়ে আসে। এবার তবে দেশ গড়ার পালা। ক্লাসরুমে ফেরার পালা। রোববার (১৮ আগস্ট) থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয় সরকার। ক্লাসরুমে পরীক্ষার টেবিলে বিএএফ শাহীন কলেজের শিক্ষার্থীরা ফিরলেও ফেরেনি আহনাফ। যে টেবিলটাতে সে বসতো, সেই টেবিলে কেউ বসেনি। সিট ছিল ফাঁকা। এতো শিক্ষার্থীর মাঝে কোথায় যেন এক বিরান শূন্যতা! আহনাফের স্মরণে তার সিটটাতে ফুল রেখে দেয় বন্ধুরা। ‘তারে স্মরণ করে সবাই সাজায় ফুলের ডালা’।

শহীদ আহনাফের খালি হয়ে যাওয়া আসনটিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। ছবি: ফেসবুক

আহনাফের ছিল আকাশ ছোঁয়ার সপ্ন। তার পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে জানা যায়– আহনাফ বলতো, বড় হয়ে সে এমন কিছু করবে, যার জন্য তাকে নিয়ে গর্ব করবে সবাই। তবে কলেজ পড়ুয়া আহনাফকে অকালে হারিয়ে কি গর্বিত হতে চেয়েছিল তার পরিবার? তাই আহনাফের এমন মৃত্যু আমাদের অপরাধী করে দেয়। যেভাবে অপরাধী করে দেয় বন্দুকের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো আবু সাঈদের মৃত্যু। যেভাবে অপরাধী করে দেয় পানির বোতল বয়ে বেড়ানো মুগ্ধের মৃত্যু। দুনিয়ার তাবৎ শোষকদের বলতে ইচ্ছে হয়– ‘পানি লাগবে পানি?’ আপনারা কি তুমুল তৃষ্ণার্ত? তাহলে রক্ত না, পানি পান করুন।

হীরক রাজারা চিরজীবন সিংহাসনে বসতে পারে না। ইতিহাস বলে, হীরক রাজাদের পতন হয়। ইতিহাসে আরব বসন্তের ফুল ফোটে। সেই ফুলের ইতিবাচক, নেতিবাচক দিকটাও বিশ্লেষিত হয় বিশ্লেষকদের বয়ানে। ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। স্বৈরাচারের পতনের ইতিবৃত্তও লেখা হয়। ‘উলঙ্গ রাজা’ নামে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর একটা কবিতা রয়েছে। সেই কবিতায় কবি একজন শিশুকে খুঁজতে থাকেন। দলদাস-স্তাবকদের ভিড় আর মুহুর্মুহু হাততালির মধ্যে কবি শিশুটাকে খোঁজেন আঁতিপাঁতি করে। কারণ, শিশুরা মিথ্যে বলে না।

সে এসে একবার এই উলঙ্গ রাজার সামনে
নির্ভয়ে দাঁড়াক।
সে এসে একবার এই হাততালির ঊর্ধ্বে গলা তুলে
জিজ্ঞাসা করুক:
‘রাজা, তোর কাপড় কোথায়?’

এই স্পষ্ট কথাটা কেউ বলতে পারেনি, পেরেছিল আহনাফরা। এই সত্য ভাষণ, স্পষ্ট উচ্চারণ কেবল আহনাফদের পক্ষেই সম্ভব। তাই উলঙ্গ রাজারা আহনাফদের মেরে ফেলে। তাই হীরক রাজার দেশে আহনাফদের শহীদ হতে হয়। আর এইসব মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নতুন ইতিহাস রচিত হয়। আমরা বলেছিলাম– ‘সবকিছু মনে রাখা হবে।’ হ্যাঁ, বাংলাদেশ মনে রাখবে আহনাফকে। বাংলাদেশ মনে রাখবে নাম না জানা আরও অনেক আহনাফদের।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply