নক্ষত্রের রঙহীন বিদায়

|

মিশুক নজিব

শীর্ষস্থানীয় এক বিজ্ঞাপনী সংস্থার উচ্চপদস্থ সকলেই বেশ বিপাকে। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) রাহুল ভার্মার বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার অভিযোগ এনেছেন ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর মায়া লুথরা। দু’জনের মধ্যে একসময় প্রেম ছিল। সাত বছরের মাথায় তা রূপ নেয় দ্বন্দ্বে। এরপর একদিন বোর্ডের কাছে অভিযোগ করে বসলেন মায়া।

তদন্ত করতে গিয়ে বেশ বিপাকে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। কে সত্য বলছেন, কাকে অবিশ্বাস করবেন— এ নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যান। দু’জন মায়ার পক্ষে মত দিলে আবার দু’জন রাহুলকেই সত্য মনে করছেন। কিন্তু অভিযোগের যে নিষ্পত্তি করতে হবে। ইতি টানার মতো কোনো সিদ্ধান্তে আসতে হবে!

যৌন হয়রানির মতো অভিযোগ, এর যথাযথ নিষ্পত্তি না হলে গ্রাহক হারাতে পারে বিজ্ঞাপনী সংস্থাটি। অপরদিকে, রাহুল ভার্মার মতো স্টার পারফর্মার সিইও’র বিপক্ষে যদি সিদ্ধান্ত যায়, সেক্ষেত্রে সে যদি নতুন এজেন্সি খুলে বসে! এ নিয়ে মূল বিপত্তি। এর মধ্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে কে কে অ্যাডভার্টাইজিংয়ের বোর্ড রুমে হাজির চেয়ারম্যান, পরিচালক ও তদন্ত কমিটির সদস্যরা। মতামত দেয়া শুরু করেছেন… তার ফাঁকেই রাহুল ভার্মার ই-মেইল হাই, জোকার অ্যান্ড ফ্রেন্ডস, গত কয়েক সপ্তাহ থেকে আজ পর্যন্ত সকলে বেশ চাপের মধ্যে আছো। আমি চলে যাচ্ছি… এই ই-মেইল বার্তা আমার পদত্যাগপত্র। ই-মেইলে সে বোর্ডকে জানিয়ে দেয়, নতুন কোনো এজেন্সি করছে না। তাই তাদের গ্রাহক হারানোর ভয় নেই।

কে কে অ্যাডভার্টাইজিংয়ের সবচয়ে বেশি পারফর্ম করা কর্মকর্তার বিদায়বেলা ছিল এমন ফ্যাকাশে। এই দৃশ্য দেখা যাবে হিন্দি সিনেমা ইনকার-এ। এর আংশিক মিল পাওয়া যাবে বাংলাদেশের ক্রিকেটের পোস্টার বয় সাকিব আল হাসানের বেলায়। তিনি এমন একসময় ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর ঘোষণা দিলেন, যখন তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। শেয়ার কারসাজির দায়ে তাকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সে এখনও নিশ্চিত নন, এই মুহূর্তে দেশে ফিরলে তার পরিণতি কী হবে। গ্রেফতারের শঙ্কা তো রয়েছেই।

সাকিব ঠিক তেমনই এক মুহূর্তে বিশ্ব ক্রিকেটকে জানিয়ে দিলেন ইতোমধ্যে তিনি তার আন্তর্জাতিক শেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলে ফেলেছেন। ইতি টানছেন টেস্ট ক্যারিয়ারের। কিন্তু টেস্টে কোন ম্যাচটি তার শেষ ম্যাচ হবে এ নিয়ে দ্বিধায়। নিরাপত্তার নিশ্চয়তা মিললে ফিরবেন দেশে। অক্টোবরে মিরপুরে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে খেলতে চান নিজের শেষ টেস্ট। নিরাপদে থাকার নিশ্চয়তা না পেলে ঢাকা ফিরবেন না তা স্পষ্ট। অন্যথায় কাল ভারতের কানপুরে শুরু হতে যাওয়া টেস্ট ম্যাচটিই সাদা পোশাকে সাকিবের শেষ ম্যাচ হবে। খুব সম্ভবত তা-ই হতে যাচ্ছে। আর জানুয়ারিতে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি দিয়ে একদিনের ক্রিকেটকেও বাই বাই বলবেন সাকিব।

কানপুর টেস্টের আগ মুহূর্তে বৃহস্পতিবার (২৬ সেপ্টেম্বর) সংবাদ সম্মেলনে এসে প্রশ্নের জবাবে সাকিব আল হাসান বলেছেন, যদি সুযোগ থাকে, আমি যদি দেশে যাই, খেলতে পারি, তাহলে মিরপুর টেস্ট হবে আমার জন্য শেষ। সেই কথাটা বোর্ডকে বলা হয়েছে।

দেশে ফেরার আগে নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়ে সাকিবের ভাষ্য, আমি যেন গিয়ে খেলতে পারি এবং নিরাপদ অনুভব করি। যখন দেশের বাইরে আসার দরকার হবে, দেশের বাইরে আসতেও যেন আমার কোনো সমস্যা না হয়। বোর্ড খেয়াল করছে। বিষয়গুলোর সঙ্গে যারা জড়িত, তারা দেখছেন। তারা হয়তো আমাকে একটা সিদ্ধান্ত দেবেন।

কষ্ট কিংবা অভিমান থেকে কি সাকিব টেস্ট ছাড়ছেন? প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন, কষ্ট কিংবা অভিমান থেকে নেয়া নয়। আমার মনে হয়, সরে যাওয়ার জন্য এটাই সঠিক সময় এবং নতুনদের আসার সুযোগ তৈরি করে দেয়ার জন্য।

আর টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকেও সরে যাওয়ার বিষয়ে সাকিব বলেন, অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলে ফেলতে চাই, টি-টোয়েন্টি নিয়েও আমার কথা হয়েছে। বোর্ডের সবার সঙ্গে, নির্বাচকদের সঙ্গে, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে। টি-টোয়েন্টি থেকেও আমি সরে যাই। আপাতত পরের যে সিরিজগুলো আছে, নতুন খেলোয়াড় আসুক, সুযোগ দেয়া হোক।

এর কয়েক ঘণ্টা পর বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ বললেন, আমি তো আসলে কোনো এজেন্সি, পুলিশ বা র‍্যাব নই। এটা (নিরাপত্তা) আসলে আমার বা বিসিবির হাতে নেই। এটা সরকার-পর্যায় থেকে আসতে হবে।

বিসিবি সভাপতির এ কথায় যেটা অনুমান করা যাচ্ছে, তা হলো সাকিব দেশের মাটিতে তার শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে ফেলেছেন।

সাকিব যতই পাশ কাটিয়ে যাক না কেন, বাংলাদেশ ক্রিকেটের কোনো ভক্তই বিশ্বাস করবে না, সাকিব এভাবে রঙহীন বিদায় নিতে চেয়েছেন! গত বছর যখন শেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন, সাকিব নিজেও হয়তো ভাবেননি সেখানেই এ ফরম্যাটের ক্রিকেটে ইতি টানছেন তিনি। ভাবলে তখনই ঘোষণা দিতেন অবসরের, একসময়ের বন্ধু তামিম ইকবালকে নিয়েও সেসময় দ্বন্দ্বে জড়াতেন কি না তা প্রশ্ন থেকে যায়। দুই বন্ধুর সম্পর্কের মধ্যে ফাটল গোটা জাতি দেখেছে। যেই ফাটল ক্রিকেট ভক্তদের মধ্যে বিভক্তি এনে দিয়েছে।

বিশ্বকাপ থেকে ফিরে এই অলরাউন্ডার রাজনীতিতে নামলে সেই বিভক্তি আরও বাড়ে। নবগঙ্গার তীরে চালাতে চেয়েছিলেন নৌকা। সফলও হন তিনি। নবগঙ্গা থেকে তার নৌকা পৌঁছে যায় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে। তবে দ্বাদশ সংসদের সূর্য অস্ত যায় আট মাসের মাথায়। সংসদে প্রাক্তনের খাতায় নাম লেখান সাকিব। দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পাল্টানোর পর তার কপালে জুটেছে মামলা, আর্থিক শাস্তি। আর রাজনীতিতে তো তেইশের শেষ দিকেই বিরোধী সমর্থক জুটিয়েছে। সবমিলিয়ে এখন বন্ধুর পথে হাঁটছেন মাগুরার এ সন্তান।

এর আগেও নেতিবাচক তকমা, বির্তক, শাস্তি জুটেছে সাকিবের কপালে। এসবের পুরোপুরি দায় এড়াতে না পারলেও কিছুতেই কর্ণপাত করেননি এ ক্রিকেটার। মাঠের খেলা দিয়ে আলোটা ঠিক নিজ বরাবর রাখতে চাইতেন। ব্যক্তি সাকিবকে ছাপিয়ে ক্রিকেটার সাকিব রূপে হাজির হতেন। তাতে শেষপর্যন্ত অনেককিছু থেকেই পার পেয়ে যেতেন। তবে এবার প্রেক্ষাপট বেশ ভিন্ন। বাংলাদেশ ক্রিকেটের পঞ্চপান্ডবের মধ্যে দূরত্ব বেড়েছে আগেই। ক্রিকেট পাড়ার রাজনীতিতেও পরিবর্তনের বাতাস বয়ে গেছে। সাকিববিরোধী সমর্থকও তৈরি হয়েছে বেশ। তারচেয়ে বড় কথা, তার দল আওয়ামী লীগ বড্ড অসময় পার করছে। আর সেই আঁচ এসে পড়েছে সাকিবের গায়েও। তাই তো ক্রিকেট থেকে রঙহীন বিদায় নিতে হচ্ছে তার। অবসরের বেলাটা রাঙিয়ে নেয়া হলো না নিজের মতো করে। বাংলাদেশ ক্রিকেটে খারাপভাবে বিদায় নেয়ার রেওয়াজ যে পাল্টালো না, তা আবার দেখা গেলো। সাকিব নিশ্চয় ভাবেননি, তার বেলায়ও এর পুনরাবৃত্তি হবে।

একসময় সাকিবের ব্যাট যখন হেসেছে, দেশের মানুষ খুশিতে আত্মহারা হয়েছে। বিধ্বংসী বোলিং করে টাইগারদের যখন জয় এনে দিয়েছিল তখন আনন্দে মেতেছিল গোটা জাতি। আর এখন তার বিদায়ে মানুষের কী অভিব্যক্তি তা পাঠকের জন্যই তোলা থাক। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাকিবের অধ্যায় থামতে যাচ্ছে। এবার নিশ্চয় ক্রিকেটার সাকিবের অধ্যায়ের হিসাব-নিকাষ করতে পারবেন যে কেউ। কিন্তু তার ব্যবসা ও রাজনীতির অধ্যায় কোন পথে এগোবে, তা সামনের দিনই বলে দেবে।

তবে তার আগে অনেকের মনেই প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে— সাকিব কি একেবারেই বিদেশে থিতু হবেন নাকি পরিস্থিতি অনুকূলে এলে দেশে ফিরবেন। কিংবা দলের গ্রিন সিগন্যাল পেলে দেশে ফিরে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মোকাবেলা করে রাজনীতি চালিয়ে যাবেন? সেক্ষেত্রে তিনি কি ক্রিকেটের মতো আওয়ামী লীগের রাজনীতির পোস্টার বয় হয়ে উঠতে পারবেন?

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সাকিব আপাতত নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই কথায়— বাংলা প্রতিবাদের ভূমি, এক দূর্ভেদ্য দুর্গ। এই ভূমি বসন্তে ফুল ফোটায় আর গ্রীষ্মে পোড়ায়।

ক্রিকেটার সাকিব রাজনীতিতেও নিশ্চয় তার এই বিদায় বেলা মনে রাখবেন। গোটা জীবনই মনে রাখবেন। হয়তো এখান থেকে শিখবেনও। কারণ, জীবন একটা বিস্তীর্ণ পাঠশালা। এখানে শেখার কোনো শেষ নাই। যে বিদায় বেলায় আনমনে হয়তো গুনগুন করছেন— আকাশের তারাগুলো জ্বলে জ্বলে নিভে যায়, সকালের সোনা রোদ ঢেকে যায় কুয়াশায়।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply