মেহেদী হাসান রোমান⚫
আগামীকাল ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতা ও হামলার বর্ষপূর্তি। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল মিলে প্রায় ৪৩ হাজার মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি শতশত পরিবারের বাড়িঘর ও স্বজন হারানোর ঘটনার সাক্ষী এই অঞ্চল। এখানকার দৃশ্যমান সার্বিক ঘটনার পর্যবেক্ষণে বছর শেষে বিশ্ব সম্প্রদায় তাদের অবস্থান জানান দিয়েছে নানাভাবে। কিন্তু মার্কিন মিত্রতায় তেল আবিব কতটুকু সুবিধা পাচ্ছে বা নেতিবাচকভাবেও উজ্জীবিত হচ্ছে, সেটিও প্রশ্নসাপেক্ষ।
পাশাপাশি যুদ্ধ চলছে ইউক্রেন-রাশিয়া জুড়েও, যার আলোচনা তুলনামূলক কম বলা যায়। পৃথিবীর অনেক জায়গায় যুদ্ধবিরোধী নানা সমাবেশ ও সভায় নিজেদের উপস্থিতি জানান দিয়েছে বিশ্ব সম্প্রদায়। তবে নিজেদের সেই একরোখা রেশকে যেনো ধ্রুবক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে আসছে তেল আবিবের নেতানিয়াহু সরকার।
ইসরায়েলে হামাসের হামলায় প্রাণ হারিয়েছিল ১ হাজার ২’শ বেসামরিক নাগরিক। অন্যদিকে, গাজা? সেখানে প্রায় ৪২ হাজার মানুষ মারা গেছে। গাজা উপত্যকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই পরিসংখ্যান দিয়েছে যাকে জাতিসংঘ বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে বর্ণনা করেছে। এই যে হাজারের অধিক ইহুদি মারা গেল, তারা যেমন মানুষ; তেমনি ৪২ হাজার ফিলিস্তিনিও তো মানুষ।
ইসরায়েল কেবলমাত্র আটকে নেই গাজা যুদ্ধেই। এই মুহূর্তে তারা স্থল অভিযান পরিচালনা করছে লেবাননে। লেবাননের মিলিশিয়া সংগঠন হিজবুল্লাহ এবং ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রেক্ষাপটে লেবাননে সর্বাত্মক হামলা শুরু করে তারা। গাজা ও লেবানন মিলিয়ে ইসরায়েলের হামলা নতুন করে উত্তপ্ত করে তুলেছে মধ্যপ্রাচ্যকেও। এই যুদ্ধ গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। যেনো যুদ্ধের ডামাডোলে নতুন তত্ত্ব নিয়ে আসছে তারা।
ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট রইসি হত্যাকাণ্ডে ইসরায়েলকে দায়ী করে কেউ কেউ। তবে রইসির সেই হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের ঘটনায় ইসরায়েলের সম্পৃক্ততার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়নি। রইসির মৃত্যুর আগে-পরে একাধিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যকে চাপে রেখেছে ইসরায়েল, চিত্রটা অনেকটা এরকম।
ইসরায়েলের মিত্র আমেরিকা ২০২০ সালে এক ড্রোন হামলায় ইরানের মেজর জেনারেল কাসেম সোলায়মানিকে হত্যা করে। এরপর হালের লেবানন ইস্যুতে হট টপিকে তাদের বন্ধু ইসরায়েল। হিজবুল্লাহপ্রধান নাসরাল্লাহকে হত্যা করে গোষ্ঠিটির কফিনে শেষ কয়েকটি পেরেকের প্রথমটি ঠুকে দেয় ইসরায়েল। এরপর তারা দাবি করে সেই সংগঠনটির পরবর্তী প্রধানকেও হত্যা করা হয়েছে। প্রশ্নের মুখে পড়ে যায় হিজবুল্লাহর সক্ষমতা। সেই চ্যালেঞ্জে আপাতদৃষ্টে জয়ী ইসরায়েল।
শুধুমাত্র গাজায় যুদ্ধ ইস্যু নয়, ইরান এবং দেশটির সমর্থিত গোষ্ঠিটির চেইন অব কমান্ড ভেঙে দেয়ার যে সক্ষমতা আছে ইসরায়েলের- সেটি তারা প্রমাণ করেই চলেছে। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে অনেক রাষ্ট্রপ্রধানের ওয়াক আউটের ঘটনা দেখা যায়। কিন্তু সেটি কেনো? তেল আবিবের প্রতি রাগ-ক্ষোভ, নেতানিয়াহুর দেশের সাথে পররাষ্ট্রনীতিতে তাদের অনাগ্রহ নাকি গাজা ইস্যুতে হাজার-হাজার নিরীহ মানুষের আর্তনাদ তাদের তাড়া করে?
মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরানের নেতৃত্বে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আরও জোরদার হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এমন হলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়বে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। কিন্তু এতোকিছুর পরও মার্কিন আশির্বাদপুষ্ট ইসরায়েলের আদৌ কোনওকিছু খেয়াল করার কারণ নেই বলে মনে করতে পারে অনেকে। কোন দেশ তাদের পাসপোর্টে ‘এক্সেপ্ট ইসরায়েল’ লিখলো, সেটি হয়তো খুব একটা মাথাব্যাথার কারণ নয় তাদের।
তেল আবিব-ওয়াশিংটন সম্পর্ক নিয়ে আপেক্ষিক মন্তব্য করাটা খুব সহজ। তবে কৌশলগত এবং অতিক্ষুদ্র সময়ে এই বন্ধুত্বতে একটা মেকি লোক দেখানো বিষয়ও দেখা গিয়েছে একাধিক সময়ে। সামনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এই নির্বাচন উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দুই দলকেও ইসরায়েল ইস্যুতে বেশ সরব হতে দেখা গেছে। কেউ বলেছেন, প্রতিপক্ষ প্রার্থী জিতলে ইসরায়েল নামে দেশই থাকবে না। তার জবাবে অপর প্রার্থী প্রতিপক্ষের যুক্তিখণ্ডন করেছে। আবার, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কার কথাও উঠে এসেছে মার্কিন নির্বাচনের বিতর্কে। সেই কথার রেশেও কোথাও যেনো চলে আসে ইসরায়েল। ব্যাপারটা এমন, বৈশ্বিক আলোচনায় আবশ্যিক একটি নাম- ইসরায়েল।
সম্প্রতি এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে প্রশ্ন করা হয়, যদি ইসরায়েল রাফাহ’তে তাদের পরিকল্পিত সামরিক অভিযান অব্যাহত রাখে, তাহলে কী হবে? এর উত্তরে বাইডেন বলেন, আমি তাহলে তাদের অস্ত্র সরবরাহ করবো না। যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের সম্পর্কের অনেকটা মূল ভিত্তি বলা যায় এই অস্ত্র সরবরাহ। ফলে গত চার দশকে এই প্রথমবারের মতো দুদেশের মধ্যে একটা কূটনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে। এটি অবশ্য দীর্ঘমেয়াদী যে না, তা অনুমেয়।
একটা প্রশ্ন তাই অনেকের মনেই ঘুরপাক খায়। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে হোসেন মিয়ার শখের ময়নাদ্বীপের মতোই কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে একটি ‘শখের সাম্রাজ্য’ ইচ্ছে করে তৈরি করে রেখেছে? এর উত্তর হোয়াইট হাউজই দিতে পারবে। তবে সোভিয়েত ভেঙে রাশিয়ান সাম্রাজ্য কিংবা ব্রিটিশদের উপনিবেশে অষ্টাদশ শতাব্দীতে সূর্যাস্ত না দেখার মতো জমিদারির ইচ্ছে যে কারও হতেই পারে। তবে সেই গল্পে যখন অর্ধলক্ষ মানুষের প্রাণ হারানোর বিষয় চলে আসে, তখন শুধু সাধারণ অধিবেশনের সেই রাষ্ট্রপ্রধানরা নয়, ওয়াকআউট করতে পারে বিশ্ব সম্প্রদায়।
তবে পৃথিবীর এমন কিছু দেশও আছে, যারা নিরপেক্ষ। এতোটা নিরপেক্ষ অবশ্য তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে বললে ভুল হবে না। উদাহরণ হিসেবে আফ্রিকার দু-একটি দেশের কথা বলাই যায়। তারা গাজা ইস্যু নিয়ে কী-ই বা বলবে? বললে শুনবেই বা কে?
মূলত, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও দ্বিপাক্ষিক পররাষ্ট্রনীতিতে ইসরায়েল যখন যুক্তরাষ্ট্রের খুব কাছ থেকে সব ইস্যুতে সমর্থন পেয়ে থাকে, সেখানে অনেক দেশের চেয়ে যোজন-যোজন এগিয়ে থাকে ইসরায়েল। এর মূলে অবশ্যই বন্ধুত্ব। আরও বিশেষভাবে বললে ‘মার্কিন বন্ধুত্ব’। আর সেটিই তাদের একগুঁয়ে অথবা ‘ডোন্ট কেয়ার’ লেবাস দিয়েছে কি না, সে প্রশ্ন তোলাটাও বোধহয় অবান্তর।
/এমএইচআর
Leave a reply