বাংলাদেশি সংখ্যালঘুদের যেন আবার এপারে চলে আসতে না হয়, এ জন্যই লড়াই-গর্জন: ময়ূখ

|

ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ, ভারতীয় এই সাংবাদিক বাংলাদেশে বেশ পরিচিতি পেয়েছেন। বিশেষ করে শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর বাংলাদেশ নিয়ে তার অতি উৎসাহী নানা মন্তব্যের কারণে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ভারতীয় সংবাদমাধ্যম রিপাবলিক বাংলার এ জ্যেষ্ঠ সম্পাদকের উপস্থাপনা বাংলাদেশে আলোচনা-সমালোচনার খোরাক জুগিয়েছে বেশ। তার নানা ভিডিও ক্লিপ ছড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। যা নিয়ে বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকারীরা বেশ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। ময়ূখ রঞ্জন ঘোষকে নিয়ে ট্রলও করেছেন তারা।

ময়ূখ রঞ্জন ঘোষের আলোচিত মন্তব্যের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ তালেবানি রাষ্ট্র হচ্ছে। বাংলাদেশের ইলিশ খাবেন না, দিঘার ইলিশ খাবেন না, ডায়মন্ড হারবারের ইলিশ খাবেন বলেও মন্তব্য করেন ভারতীয় এ সাংবাদিক।

এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেন, ড. ইউনূস আসুন, ১২শ’ রকমের মাছ খাওয়াবো।

বাংলাদেশ নিয়ে কেন তার কথা বলা, এর কিছুটা ইঙ্গিত মিলেছে ময়ূখ রঞ্জন ঘোষের এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে। তিনি লিখেছেন ‘বাংলাদেশের অনেক ইউটিউবার, সাংবাদিক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। আপনাদের একাধিক কৌতূহলের মধ্যে একটি, পূর্ববঙ্গে আমার কোনো শিকড় আছে কি না। ময়ূখের বাংলাদেশে কেউ ছিল? উত্তর হ্যাঁ, আবার না-ও। আমি ইস্টবেঙ্গল সমর্থক, আমি বাঙাল, আমি ছিন্নমূল পরিবারের কিন্তু এই আধুনিক বাংলাদেশের সঙ্গে টান? না নেই। কোনো এক অলীক দীকশূন্যপুরের নাম ছিল পূর্ববঙ্গ। আমার বাপ-ঠাকুরদার দেশ ছিল। আবেগটা রয়েছে। ওই দেশটা আর নেই।

আমার ঠাকুরদা, ঠাকুরমা, দাদামশাই, দিদিমা সবাই ওপার বাংলার। ৪৬-৪৭ সালে এক রাতের নোটিশে পূর্ববঙ্গ ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল হিন্দু হওয়ার অপরাধে। ঠাকুরদা, ঠাকুরমা, দাদামশাই, দিদিমা কেউ বেঁচে নেই। কিন্তু তাদের পৌত্র-পৌত্রীসম বাংলাদেশি সংখ্যালঘুদের ৪৬-৪৭-৪৮-৭১ এর মতো আবার না চলে আসতে হয় এপারে, তার জন্যই আমার লড়াই। আমাদের গর্জন।

যাক গে, আপনাদের প্রশ্নের উত্তর বিস্তারিত দিতে হলে বলি, আমার ঠাকুরদা মনোরঞ্জন ঘোষের আদি বাড়ি ছিল বারুদীর কাছে। গ্রামটির নাম নয়ামাটি। ওখানে লোকনাথ বাবার মৃত্যুস্থান ও আশ্রম। জ্যোতি বসুরও আদি ভিটে। বাবার কাছে শুনেছি, হেমলতা বসু জ্যোতি বসুর মা। প্রভাবতী ঘোষ, মনোরঞ্জন ঘোষের মা। এই হেমলতা বসু ও প্রভাবতী ঘোষ দু’জন সম্পর্কে মাসতুতো বোন ছিলেন। হাবিবুল্লাহ নামে একজন ছিলেন, যারা বংশ পরম্পরায় জ্যোতি বসুর বাড়ির রক্ষা করতেন ,যা এখন সংগ্রহশালা হয়ে গেছে। মনোরঞ্জন ঘোষের সাথে এই হাবিবুল্লাহর দীর্ঘ দিন যোগাযোগ ছিল। শুনেছি, আমাদের কলকাতার বাড়িতেও বেশ কয়েকবার এসেছেন। কিছুই অবশিষ্ট নেই আর ওখানে। কোনো এক নদীর পারে ছিল নয়ামাটি, সম্ভবত ভাঙ্গনে তলিয়ে গেছে। ঠাকুরমার বাড়ি ময়মনসিংহ ছিল শুনেছি।

দাদু আর দিদিমা দু’জনেই পাবনার। মায়ের বাবা হাটুরিয়া,পাবনা। মায়ের মা নূতন ভারেঙ্গা,পাবনা। তবে দাদু নীরেন্দ্র নারায়ণ রায়ের খুব অল্প বয়সে ওনার বাবা আসামের গৌরীপুর এস্টেট দেখাশোনার কাজ নিয়ে গোটা পরিবার নিয়ে আসামে চলে আসেন। দাদু প্রমথেশ বড়ুয়ার টি এস্টেটে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন। প্রমথেশ বড়ুয়ার ভাই ছিলেন বিখ্যাত শিকারি লালজী। দাদুর বন্ধু। দেশ অশান্ত হতে শুরু করে। একটু একটু করে অসম, জলপাইগুড়িতে চলে আসতে শুরু করেন সব্বাই। দিদার এক ভাই অগ্নিযুগের বিপ্লবী মোহিত মৈত্রর নামে জলপাইগুড়ির কাছে মোহিত নগর আছে। যুগান্তর দলের সদস্য ছিলেন পাবনার ছেলে মোহিত। ব্রিটিশ রাজবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে তার পাবনার বাড়ি থেকে রিভলভার ও গোলাবারুদসহ গ্রেফতার করা হয়। সশ্রম কারাদণ্ড দিয়ে আন্দামান জেলে পাঠানো হয়। সেই বন্দিশিবিরে ২৩ দিন অনশন ধর্মঘট করে যে কজন বিপ্লবী প্রাণ উৎসর্গ করেন মোহিত মৈত্র তাদের অন্যতম। তার স্মৃতিতে একটি মূর্তি আন্দামানের সেলুলার জেলের বাইরে স্থাপিত হয়েছে।

দিদিমার বিয়ের আগে বাড়ি ছিল পাবনার একটি ছোট এলাকায়। মৈত্র, সান্যালদের বাড়ি। পদ্মা দিয়ে যাতায়াত করতে হতো। প্রথমে পুরান ভারেঙ্গা। নদী পুরান ভারেঙ্গা খেয়ে নিলে, নতুন ভারেঙ্গা। নির্দিষ্ট করে বললে, নগরবাড়ি বলে এক জায়গায়। মৈত্র বাড়ি। সেটিও আর নেই। শুনেছি, বড় চৌধুরীদের বাড়ি একজন কিনে নিয়ে থাকেন।
পূর্ববঙ্গ আর পূর্ব পাকিস্তান এক না। ছিল না কোনদিন। গোল্লাছুটের মাঠে যেদিন থেকে চাপ চাপ রক্ত পরে থাকতে লাগলো, যেদিন থেকে তুলসীতলা ছেড়ে এক কাপড়ের মধ্যে শালগ্রাম শিলা লুকিয়ে কাঁটাতার পেরিয়ে আসতে হলো, সেদিন থেকে মনেও কাঁটাতার তুলে দেয়া হয়েছিল। তবু কি শিকড় ভুলতে পেরেছিল দাদু ঠাকুরদা? ভাগ্যিস ওরা মারা গেছে। নতুন বাংলাদেশ দেখলে ওরা কষ্ট পেত আরও। প্রকাশ করতো না। মন ভালো করতে পদ্মার ইলিশ কিনে খাওয়াতো। কিন্তু ওতেও তো হিন্দুর রক্ত লেগে আছে। কোনো এক অলীক দীকশূন্যপুরের নাম ছিল পূর্ববঙ্গ। আমার বাপ-ঠাকুরদার দেশ ছিল। আবেগটা রয়েছে। ওই দেশটা আর নেই। অনেকটা ক্ষত চিহ্ন আছে। মলম লাগাচ্ছি ওতেই।’

/এমএন


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply