হোয়াইট হাউজ যাত্রা: ইতিহাস কি লেখা হবে কমালার হয়ে?

|

মাত্র মাস তিনেক আগেও ছিলেন সাইডলাইনে। জো বাইডেন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালে খুলে যায় কপাল। চব্বিশের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থীর মনোনয়ন পেয়ে নেমে পড়েন ভোটের ময়দানে। সঙ্গে সঙ্গেই বৈশ্বিক রাজনীতির অর্ধেক দৃষ্টি নিজের দিকে করে নেন কমালা হ্যারিস। লড়াইয়ে নেমে ডেমোক্র্যাট শিবিরকে উজ্জীবিত করেছেন। আভাস মিলছে হাড্ডাহাড্ডি প্রতিদ্বন্দ্বিতার। জয় পেলে কমালা হ্যারিসই হবেন আমেরিকার প্রথম কোনো নারী প্রেসিডেন্ট, সে কথা সবার জানা।

সেই দৌঁড়ে পৌঁছানোর আগেই তিনি নিজের নামের পাশে যুক্ত করেছেন একাধিক নতুন পরিচয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বড় রাজনৈতিক দলের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কমালা হ্যারিস। একাধারে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম দক্ষিণ এশীয় (ভারতীয়) আমেরিকান সিনেটর; ক্যালিফোর্নিয়ার প্রথম নারী, প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ও প্রথম দক্ষিণ এশীয় অ্যাটর্নি জেনারেল; সানফ্রান্সিসকোর দক্ষিণ এশীয় ও কৃষ্ণাঙ্গ জেলা অ্যার্টনি; যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী ও প্রথম এশিয়ান আমেরিকান।

পড়াশোনা করতে ১৯ বছর বয়সে ১৯৫৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান শ্যামলা গোপালান। তার জন্ম ভারতের তামিলনাড়ুর চেন্নাইতে। বিদেশ বিভূঁইয়ে থিতু হয়ে শ্যামলা গোপালান বিয়ে করেন ডোনাল্ড হ্যারিসকে। যার জন্ম উত্তর আমেরিকার ক্যারিবিয়ান দ্বীপ অঞ্চলের জ্যামাইকায়। তিনি বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়তে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। বর্তমানে তিনি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। আর শ্যামলা গোপালান ২০০৯ সালে মারা যান।

এই অভিবাসী দম্পতির ঘরে জন্ম কমালা হ‍্যারিসের, ১৯৬৪ সালের ২০ অক্টোবর ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ডে। সে ও তার বোন মায়া যখন অনেক ছোট, তখনই তাদের বাবা-মার বিচ্ছেদ হয়। এরপর তারা মায়ের কাছেই বড় হন। কমলা হ্যারিসের মা শ্যামলা গোপালান কানাডার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা এবং ইহুদি জেনারেল হাসপাতালে ক্যানসার গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন।

১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসির হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন কমালা হ্যারিস। সেখানে তিনি আলফা কাপ্পা আলফা তথা দেশের প্রাচীনতম কৃষ্ণাঙ্গ সমাজে যোগ দেন। আর রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনিই বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রথম গ্রাজুয়েট, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছেন।

পরে ক্যালিফোর্নিয়ায় ফিরে ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি হেস্টিংস’র আইন স্কুলে যোগ দেন। যেটি এখন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, সান ফ্রান্সিসকোর আইন স্কুল। সেখান থেকে কমালা হ্যারিস ১৯৮৯ সালে আইনে স্নাতক হন। আইনে স্নাতক হওয়ার পর ১৯৯০ সালে কমলা হ্যারিস আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।

ছাত্রাবস্থা থেকেই দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ এবং যুক্তরাষ্ট্রের জাতিগত সম্পর্কের মতো রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে সোচ্চার হতে থাকেন কমালা হ্যারিস। অল্প বয়সেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, দুর্বল মানুষদের অধিকার আদায়ে লড়াই করার ক্যারিয়ার গড়বেন, যখন তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাকে জানায়, সে বাড়িতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
সেই সিদ্ধান্ত থেকেই কমালা হ্যারিস একজন শিশু যৌন নির্যাতন বিশেষজ্ঞ প্রসিকিউটর হয়েছিলেন। জেলা অ্যাটর্নি হিসাবে তিনি গার্হস্থ্য সহিংসতা এবং বন্দুক সহিংসতার মতো বিষয় নিয়েও কাজ করেন।

এই ডেমোক্র্যাট প্রার্থী ২০০৪ সালে সান ফ্রান্সিসকোর জেলা অ্যাটর্নি নির্বাচিত হন। এর আগে তিনি প্রসিকিউটর হিসেবে কাজ করেন। এ সময় তিনি ওকল্যান্ডের আলামেডা কাউন্টির ডেপুটি জেলা অ্যাটর্নি হিসেবেও কাজ করেন।

২০১১ সালে কমালা হ্যারিস ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন রাজ্যের প্রথম নারী, প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ এবং প্রথম এশিয়ান আমেরিকান অ্যাটর্নি জেনারেল। এই দায়িত্ব পালন করার সময় তার বড় একটি কৃতিত্ব হচ্ছে ওপেন জাস্টিস তৈরি করা, যা ফৌজদারি বিচারের ডেটা জনসাধারণের কাছে সহজলভ্য করার জন্য একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। ডেটাবেজটি পুলিশ হেফাজতে থাকার সময় মৃত্যু ও আহতদের সংখ্যার তথ্য সংগ্রহ করে পুলিশের জবাবদিহিতা বাড়াতে সাহায্য করেছে।

২০১৪ সালে ডাগ এমহফ এর সাথে জুটি বাঁধেন কমালা হ্যারিস। তিনিও একজন আইনজীবী। কমালা হ্যারিসের নিজের গর্ভজাত কোনও সন্তান নেই। তার স্বামীর আগের স্ত্রীর দুই সন্তান আছে।

পরের বছর যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেটের সদস্য হওয়ার জন্য নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন কমালা হ্যারিস। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দু’জনেই তাকে সমর্থন দেন। ২০১৬ সালের নির্বাচনে তিনি সিনেটর নির্বাচিত হন।

সেই জয়ের স্মৃতিচারণে কমালা হ্যারিস বলেছিলেন, নির্বাচনের রাতটি অনেক কারণেই আমার কাছে ‘পরাবাস্তব’ ছিল। কেবল জয়ী হওয়ার কারণে নয়। আমি আমার রাজ্যের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী এবং দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে সিনেটর নির্বাচিত হয়েছিলাম।

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ নিয়ে তদন্তের সময় তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল জেফ সেশনসকে তীক্ষ্ণ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ২০১৭ সালে দেশজুড়ে আলোচনায় আসেন কমালা হ্যারিস। সাড়ে তিন মিনিটের ক্রমাগত প্রশ্নের পর জেফ সেশনস বলেছিলেন, আমি এত দ্রুত প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম নই! এটা আমাকে নার্ভাস করে তোলে।

২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়তে দলের মনোনয়ন প্রতিযোগিতায় শামিল হলেও শুরুতেই ছিটকে পড়েন। তবে কপাল মন্দ ছিল না। জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হওয়ার পরই তার রানিংমেট হিসেবে কমালা হ্যারিসকে বেছে নিয়েছিলেন। এতে অনেকে বিস্মিত হয়েছিলেন বটে, তবে জো বাইডেন বলেছিলেন এটি তার জীবনের সেরা সিদ্ধান্ত।

সেইবার মার্কিনরা ডেমোক্র্যাটদের বেছে নেন। আর কমালা হ্যারিস নাম লেখান দেশটির ইতিহাসে। প্রথম নারী, প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ এবং প্রথম এশিয়ান আমেরিকান হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস-প্রেসিডেন্ট হন।

এবার ডেমোক্র্যাটিক পার্টি প্রথমে জো বাইডেনকেই ফের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছিল। একাধিক কারণে গত ২২ জুলাই সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন জো বাইডেন। আর কমালা হ্যারিসকে সমর্থন জানান তিনি। জনমত জরিপে ট্রাম্পের চেয়ে পিছিয়ে ছিলেন বাইডেন। প্রার্থী বদলেছে, শেষ সময়ে এসে কী বলছে জরিপ।

নিউইয়র্ক টাইমস ও সিয়েনা কলেজের ২০–২৩ অক্টোবর পর্যন্ত পরিচালিত সর্বশেষ জাতীয় জরিপে দেখা যাচ্ছে, কমালা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্প দুইজনই ৪৮ শতাংশ সমর্থন নিয়ে সমান অবস্থানে রয়েছেন। বাকি ৪ শতাংশ ভোটার এখনও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। ৫ নভেম্বর মার্কিনিরা তাদের প্রার্থী বেছে নেবেন, তবে হোয়াইট হাউজ যাত্রায় ফ্যাক্টর যে ইলেক্টোরাল ভোট! সে যাত্রায় ইতিহাস কি লেখা হবে কমালার হয়ে?

গ্রন্থনা: মিশুক নজিব

সূত্র: কমালা হ্যারিস ডটকম, বিবিসি।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply