টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের দুই যুগ, অর্জন-সাফল্য কতটুকু?

|

মেহেদী হাসান রোমান⚫

২৬ জুন, ২০০০। লন্ডন থেকে এক খুশির বার্তা এল। ঠিক বছরখানেক আগে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে অংশগ্রহণের স্বাদ পেয়েছে বাংলাদেশ। আগের শতাব্দীর শেষ কয়েক বছরে বাংলাদেশের ক্রিকেট যেন নতুন গতি পেয়েছে। আমরা যে সময়ের কথা বলছি, তখন বিশ্ব ক্রিকেটে ‘তিন মোড়ল’ নীতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেনি। আইসিসির হেড অফিস তখনও স্থানান্তরিত হয়নি দুবাইয়ে। ক্রিকেটের বাজার ভারতকেন্দ্রিক হতে যাওয়ার ব্যাপারটাও প্রায় এক দশকের অপেক্ষা নিয়ে বসে আছে। এরই মাঝে নতুন খবর– আমাদের ছেলেরা যে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলতো দেশের অঞ্চলভিত্তিক কিংবা বিভাগভিত্তিক দলের হয়ে, এবার সাদা পোশাকের একটা জাতীয় দল দেখতে যাচ্ছি আমরা।

১০ নভেম্বর, ২০০০। হেমন্তের এক মিষ্টি সকাল। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ব্লেজার গায়ে চাপিয়ে বাংলাদেশের অধিনায়ক আন্তর্জাতিক টেস্টের টস করতে পারার এক বিরল উপলক্ষ্যের সাক্ষী হলেন। দেশের প্রথম টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসে ধরা দিয়েছিল নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের হাতে।

অভিষেক টেস্টে ভারতীয় অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলির সাথে নাঈমুর রহমান দুর্জয়।

এই যে সাদা পোশাকের তথা ক্রিকেটের সবচেয়ে রাজকীয় ভার্সন টেস্ট খেলতে চাওয়ার আকুতি, এটি যেকোনো দেশেরই থাকতে পারে। তবে সেই দেশে ক্রিকেটের সার্বিক হালচাল, অগ্রগতি, অবকাঠামোগত সুবিধা, দর্শক, খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স এমনকি রিজিওনাল ফ্লেভারটাও বেশ মুখ্য। এই ‘রিজিওনাল ফ্লেভার’ টা বেশ ভালোই পেয়েছিল বাংলাদেশ। সবশেষ শতাব্দীর শেষ দশকে উপমহাদেশের ক্রিকেট ছিল বেশ রমরমা। ১৯৯২ সালে পাকিস্তান, ১৯৯৬ সালে শ্রীলঙ্কা বিশ্বকাপ জেতে। ১৯৯৯ সালে ফাইনালে হেরে যায় পাকিস্তান। ভারতও তখন বেশ শক্তিশালী দল। পৃথিবীর ভৌগলিক অবস্থান মাঝেমাঝে বেশ সুবিধা করে দেয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যে সেটিই হয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আপনিই বলুন, এই বাংলাদেশের ভূখণ্ডটাকে তুলে নিয়ে যদি কোরিয়া উপদ্বীপ কিংবা দক্ষিণ আমেরিকার উরুগুয়ে-ব্রাজিলের মাঝে সংযুক্ত করে দেয়া যেতো, তাহলে সেখানে কি ক্রিকেটের সেই প্রভাব থাকতো?

১৯৯৮ সালে আইসিসি মিনি বিশ্বকাপ (পরবর্তীতে এর নামকরণ হয় আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি) আয়োজন করে পুরো ক্রিকেট বিশ্বকে চমক দেখিয়েছিল বাংলাদেশ। এর মধ্য দিয়ে দেশে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তার ঢেউও বয়ে যায়। এরপর থেকেই মূলত আইসিসির পূর্ণ সদস্য হওয়ার দাবি জিইয়ে তুলেছিল লাল-সবুজ শিবিরের তৎকালীন শীর্ষ কর্তারা। অবশেষে সেই আক্ষেপ ঘুচিয়ে ২০০০ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট পা রাখে ক্রিকেটের সবচেয়ে অভিজাত সংস্করণ টেস্ট আঙিনায়।

১৯৯৮ সালে আইসিসি নকআউট টুর্নামেন্টের আয়োজক বাংলাদেশ।

জগমোহন ডালমিয়া নামে এক ভদ্রলোক ছিলেন। ভারতীয় এই ক্রিকেট সংগঠক ও ব্যবসায়ীকে আলাদা করে ধন্যবাদ না দিলে বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তির উদযাপন স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে না। টাইগারদের এই স্বীকৃতি অর্জনে অনস্বীকার্য ভূমিকা রাখেন আইসিসির এই সাবেক সভাপতি। এছাড়া, বিসিবির তৎকালীন সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরীর কূটনৈতিক দক্ষতাও সেই সময় বেশ প্রশংসা কুড়ায়। দশম সদস্য হিসেবে টেস্ট পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হয় বাংলাদেশ।

জগমোহন ডালমিয়া (বা’য়ে)।

একবার এক সাক্ষাৎকারে সাবের হোসেন চৌধুরী বলেছিলেন, জগমোহন ডালমিয়া বাংলাদেশের একজন প্রকৃত বন্ধু ছিলেন। যখন বাংলাদেশ বিশ্বপর্যায়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখছিল, তখন যে কয়টি ব্যক্তি আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তার মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম।

তিনি আরও বলেন, টেস্ট মর্যাদার জন্য আমাদের দুটি পূর্ণ সদস্য দেশের সমর্থন প্রয়োজন ছিল। তখন আমরা তাদের কাছে যাই এবং তিনি আমাদেরকে প্রথম এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের সমর্থন দেন। আগে আমরা এশিয়া অর্থাৎ ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার সমর্থন পাই এবং এখানেই তার সেই প্রাথমিক ভূমিকা ছিল। এই ভূমিকা আমাদের জন্য অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেসময় বাংলাদেশ যদি এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের সহায়তা না পেতো, তাহলে পরবর্তীতে টেস্ট স্ট্যাটাসের জন্য আবেদন করে খুব একটা লাভ হতো না।

জগমোহন ডালমিয়া টেস্ট স্ট্যাটাস পেতে বাংলাদেশের জন্য একটি ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছিলেন। কিন্তু তার উত্তরসূরির অনেকেই বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তি অতিদ্রুত হয়েছে বলে রব তুলেছিলেন। অবশ্য সেটি বাংলাদেশের মাঠের পারফরম্যান্সের তাগিদেই বলা।

এরপর কেটে গেছে ২৪টি বছর। দীর্ঘ দুই যুগ। বাংলাদেশের পরে আরেক এশিয়ান সেনসেশন আফগানিস্তানের পাশাপাশি আইরিশরাও পেয়ে গেছে টেস্ট স্ট্যাটাস। নবীন এই দুই দলকে বাদ দিলে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সবচেয়ে কম ম্যাচ খেলেছে টাইগাররা, মাত্র ৬টি। সবচেয়ে বেশি লঙ্কানদের বিপক্ষে, ২৬টি। অবশ্য এখনও কারও বিপক্ষে দুই অঙ্কের ম্যাচ জিততে পারেনি বাংলাদেশ। সর্বোচ্চ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জয় এসেছে সর্বসাকুল্যে ৮টি।

প্রথম টেস্ট জয়। জানুয়ারি, ২০০৫।

২০০০ সালের নভেম্বরে ভারতের বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচের প্রথম ইনিংসে যে শুরুটা করেছিল বাংলাদেশ, সেই রেশ তারা ধরে রাখতে পারেনি। দ্বিতীয় ইনিংসেই সেই খেই হারিয়ে ফেলা বাংলাদেশ এখনও আমাদের কাছে চির পরিচিত। সাদা পোশাকের রাজকীয়তা কতটুকু ধরে রাখতে পেরেছে বাংলাদেশ, সেটিও প্রশ্নসাপেক্ষ। সাদা পোশাকের ক্রিকেটে ৩৪ ম্যাচ পর প্রথম জয়ের স্বাদ পায় টাইগাররা। কাঙ্ক্ষিত জয়টি জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। ঐতিহাসিক সেই জয়ের সাক্ষী চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়াম।

ক্রিকেটের এই রাজকীয় সংস্করণে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাফল্য দেশের মাটিতে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়াকে হারানো। চলতি বছর পাকিস্তান সফরে গিয়ে তাদের মাটিতেই স্বাগতিকদের হোয়াইটওয়াশ করার আরেক গৌরবের উপলক্ষ্য এসে ধরা দিয়েছিল বাংলাদেশের ক্রিকেট ভক্তদের। বিশ্বমঞ্চে অন্যতম বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান নামটিও লাল-সবুজের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন। ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে সিরিজ হারালেও সেই ক্যারিবিয়ান স্কোয়াড নিয়মিত ও হাইপ্রোফাইল ক্রিকেটার দিয়ে সাজানো ছিল না। তবে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা ব্যতিত সব দলের বিপক্ষে অবশ্য জয় পেয়েছে বাংলাদেশ।

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম ও একমাত্র টেস্ট জয়। মিরপুর, ২০১৭।

বছরের পর বছর অসহায় আত্মসমর্পণে একপেশে হার। টেস্ট ক্রিকেট মানেই যেন বাংলাদেশের একই দৃশ্যের পুনঃপ্রচার। যে কয়টা বড় জয় এসেছে, এসবের প্রভাবে সেসবকেও ‘ফ্লুক’ বলেই মনে করতো অনেকে। কারণ, সফলতা পেলে সেটাকে ধরে রাখতে পারা কিংবা নিদেনপক্ষে দলটা যে ঠিক পথে আছে, সেই অনুযায়ী মাঠে খেলে দেখানোটাই মুখ্য। যখন টেস্ট স্ট্যাটাস ছিল কেবল দশটা দেশের, তখন বাংলাদেশের অবস্থান ছিল র‍্যাংকিংয়ের একদম শেষে। আয়ারল্যান্ড আর আফগানিস্তান নতুন করে পূর্ণ সদস্য হওয়াতে টেস্ট দল বেড়ে এখন বারোটা। বাংলাদেশ এখন নবম অবস্থানে। একে কি উন্নতি বলবেন? এখন পর্যন্ত ১৪৮ টেস্ট খেলেছে টাইগাররা। এর মধ্যে ১০৮ ম্যাচে হার। আর জয় মোটে ২১ ম্যাচ। বাকি ১৯ ম্যাচ ড্র।

বাংলাদেশ নিজেদের একমাত্র দিবা-রাত্রির টেস্ট খেলেছে ভারতের বিপক্ষে। কলকাতা, ২০১৯।

উপমহাদেশে ক্রিকেট এক আবেগের নাম। রাবন লঙ্কার দেশ থেকে সিন্ধু সভ্যতার পাকিস্তান কিংবা হট ফেভারিট ভারত- এদের সঙ্গে সমান্তরালে নিজেদের অর্জনকে দাঁড় করানোর কতটুকু অর্জন আছে বাংলাদেশের? পদার্থবিজ্ঞানে গতি, ত্বরণ কিংবা বেগের গাণিতিক ফর্মুলায় যদি বিচার করা যায়, সেই ফলাফল হয়ত শূন্যেও দাঁড়িয়ে নেই। ক্রমাগত ঋণাত্মক গ্রাফ স্কেলের দিকেই ধাবিত হচ্ছে বাংলাদেশের টেস্ট পারফরম্যান্স।

ব্যক্তিগত অর্জন কিংবা এক সাকিব আল হাসানের অলরাউন্ডার নাম্বার ওয়ান এবং আশরাফুলের সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান তকমাকে একপাশে রেখে দিলে দল হিসেবে ১৭ কোটি জনসংখ্যার এই দেশের সাদা পোশাকের সাফল্যকে কি রঙিন বলতে পারবেন? সাদা রং কিংবা টেস্ট স্ট্যাটাস তো গর্বের বিষয়, কিন্তু সেই সাদা পোশাকে সাফল্যও কি ধবধবে সাদা হয়েই থাকবে? সাদা যেমন আভিজাত্যের রং, তেমনি ‘হোয়াইটওয়াশ’ কি ওয়ার্ডেও কিন্তু সাদা আছে।

টেস্টে টানা সবচেয়ে বেশি হারের রেকর্ড বাংলাদেশের। অভিষেক টেস্ট থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত টানা ২১ ম্যাচ হেরেছে লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। দুর্জয় থেকে শান্ত, টেস্টের রাজদণ্ড কি আদৌ আমাদের কোনো অধিনায়কের হাতে দেখা যাবে?

নাগরদোলায় ওঠা-নামা চক্র থাকে। তবে বাংলাদেশ কোনোদিনও সেই রিংয়ের শীর্ষে উঠতে পারেনি। তারা সরল দোলকের বলগুলোর মতো তলানিতেই দুলতে দুলতে দুই যুগ পার করে ফেলেছে। টেস্টের রাজকীয় এই ফরম্যাটে সাফল্য কত দেরি, পাঞ্জেরী?

টেস্টের রাজদন্ড। র‍্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে উঠলে অথবা টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল জেতার পর জয়ী দলের অধিনায়কের হাতে তুলে দেয়া হয় এই রাজকীয় ট্রফি।

টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম দল: নাঈমুর রহমান (অধিনায়ক), শাহরিয়ার হোসেন, মেহরাব হোসেন, হাবিবুল বাশার, আমিনুল ইসলাম, আকরাম খান, আল-শাহরিয়ার, খালেদ মাসুদ (উইকেটরক্ষক), মোহাম্মদ রফিক, হাসিবুল হোসেন, বিকাশ রঞ্জন দাশ।

/এমএইচআর


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply