আল মাহফুজ
‘আমি কাউকে বলিনি সে নাম
কেউ জানে না, না জানে আড়াল
জানে কান্নার রঙ
জানে জোছনার ছায়া..’
যে থাকে হৃদয়ের অন্দরে, তার নাম মুখে নেয়া যায়? যার নাম কেউ জানে না, জানে অশ্রুবিন্দু। যার নামের আড়ালে রয়েছে অজস্র রাতের বাড়ি ফেরার গল্প। ভুল দরোজায় কড়া নাড়ার গল্প। তার নাম জানে জোছনার আভা, জানে সঞ্জীব চৌধুরী। কারণ, সেই নাম মনের খাঁচায় পরম যতনে পুষে রেখেছিলেন তিনি। কাউকে বলেননি, কাউকে বলা যায় না হয়তো।
সঞ্জীব চৌধুরীর নাম তখনও শুনিনি। নিজের ঘরে গান-টান তেমন শোনা হতো না। আত্মীয় অথবা পাড়ার বাসিন্দাদের ক্যাসেট প্লেয়ারে বেজে ওঠা গানই ছিল ভরসা। আর ছিল মোড়ে মোড়ে সিডির দোকান। খুলনার ময়লাপোতা, আমতলা, নিউ মার্কেট, ডলফিন মোড়, স্কুল অব মিউজিক ইত্যাদি জায়গা ছিল গানের তৃষ্ণা মেটানোর আশ্রয়স্থল। লোকমুখে ভেসে বেড়ায় এলআরবি, মাইলস, সোলস। বাতাসে কান পাতলে শোনা যায় ফিলিংস, আর্ক, প্রমিথিউসসহ নানা ব্যান্ডের কলতান। নানাবাড়িতে পৌষের ক্ষেতে বসে রোদ পোহাই। শুনি দূর থেকে ভেসে আসা কোরাস– ‘চল্ বু বাইজান, মাডি কাডা, চাইয়া রইলি কার পানে..’
সেই থেকে সঞ্জীব চৌধুরী। সেই থেকে ঘ্রাণ নেয়া ‘দলছুট’ নামক গন্ধরাজের। সঞ্জীব চৌধুরী থেকে সঞ্জীব দা’ (বড়ভাইরা তাকে এই নামেই ডাকতো)। ডানা ভাঙা শালিক। স্বপ্নবাজির পাখি। রঙিলা পালে আউলা বাতাস। বয়স সাতাশের ধর্ম। বায়োস্কোপের বাক্সো। আগুনের কথা। সমুদ্র স্নানে নষ্ট শহর। ফুলের বুকে ধুতরার ঘ্রাণ। তারপর? তারপর ছুঁয়ে কান্নার রঙ.. ছুঁয়ে জোছনার ছায়া..
‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র প্রভাব যেমন কলকাতার পরবর্তী ব্যান্ডগুলোর ওপর পড়েছিল, বাংলাদেশে এই প্রসঙ্গে সঞ্জীব চৌধুরীর নাম বললে খুব বেশি ভুল বলা হবে কি? আধুনিক বাংলা গানের পালা বদল ঘটে সঞ্জীবের হাত ধরে। এ বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকলেও বলা যায়– পরবর্তী জেনারেশনে সঞ্জীব চৌধুরীর লিরিক বা গানের প্রভাব রয়েছে বিপুল।
বাংলাদেশে কয়েক দশক আগেও ‘সিঙ্গার-সং রাইটার’দের (যারা নিজের লিরিকে নিজেই সুর বেঁধে সেটি কণ্ঠে তোলেন) তেমন দেখা যেতো না। বিরলপ্রজ ছিল এরা। বাংলাদেশে আধুনিক গানে সঞ্জীব চৌধুরী দেখালেন, সিঙ্গার-সং রাইটাররা কেমন হয়। তার আগে ছিলেন মাকসুদুল হক, তবে সেটা ব্যান্ড মিউজিকে। ছিলেন সাহেদ-তরুণ মুন্সীরা, তবে তারা সঞ্জীবের মতো প্রভাব রাখতে পারেননি।
সঞ্জীব নিজে যেমন লিখতেন, তেমন অন্যের কবিতায় সুর বসিয়ে সেটা নিমেষেই সেদ্ধ গান বানিয়ে দিতেন। সঞ্জীবের গানের গলা নিয়ে উচ্চবাচ্য করার কিছু নেই কিন্তু তার লিরিক বাছাই ছিল প্রশংসাযোগ্য। সেগুলো টিপিক্যাল ছান্দসিক লিরিক নয়। গানের মিটারে বসানো যায় না। কিন্তু সেই গানই তার গলায় বারুদ হয়ে বেরোয়। কখনও সখনও মরমিবাদের খাঁচা ভাঙ্গে। কখনোবা প্রেমের জিগির তুলে ছল ভাঙ্গে ঘাই হরিণীর।
সঞ্জীব চৌধুরী শুধু একজন শিল্পী নয়, একটা প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। একজন বিপ্লবী কিংবা তার চেয়েও অনেক কিছু বেশি। রাজু ভাস্কর্যে দাঁড়িয়ে ক্ষমতার গদির পোষ্য ক্যাডারদের চোখে আঙ্গুল তুলে চিৎকার করতে পারেন যিনি, তিনি সঞ্জীব। সাম্যবাদের স্বপ্ন নিয়ে ফাঁসির রজ্জু আলিঙ্গন করা কর্নেল তাহেরের খুনির নাম যিনি জানতে চান, তিনি সঞ্জীব। পুলিশ কর্তৃক ধর্ষিত ও নিহত কিশোরী ইয়াসমিন আক্তারকে নিয়ে প্রতিবাদী গান বেঁধে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তুলেছিলেন যিনি, তিনিই সঞ্জীব। এখন যারা পথে ঘুরে ঘুরে স্বপ্নের কথা জানাতে চান, তাদের স্বপ্ন দেখানোর সাহস দেখিয়েছিলেন সঞ্জীব।
অনেকেই মনে করেন, সঞ্জীব চৌধুরী-বাপ্পা মজুমদারের যুগলবন্দী (‘দলছুট’) এখনও বহাল থাকলে এর প্রভাব হতো সুদূর প্রসারী। কিন্তু সেটা আর সম্ভব নয়। সঞ্জীব আগুনের ফুলকির মতো এসেছিলেন। চলে গেছেন জোনাকির মতো আলো জ্বেলে, কাউকে কিছু না বলে (১৯ নভেম্বর ২০০৭)। দলছুট হওয়া সেই ফুলকির আঁচ যারা পেয়েছে, তারাই এখন বুকে লালন করছে সঞ্জীবনী ধারা। মারজুক রাসেল, বাপ্পা মজুমদার, জয় শাহরিয়ার, মুয়ীয মাহফুজ থেকে এই প্রজন্মের শুভ-সভ্যতা; সবার কাছেই ‘সঞ্জীব’ যেন শাখা প্রশাখা বিস্তৃত বিশাল এক মহীরুহ।
রুহের ভেতরে বা নিউরনে ঘুরে বেড়ায় যারা, তাদের মধ্যে অন্যতম সঞ্জীব চৌধুরী। জীবনের সূর্যমুখী সময়ে আমার আমিতে তাকে আবিষ্কার করি কিন্তু ততোদিনে পাগল রাগ করে চলে গেছে। আমি ঢাকা শহরের রাস্তাঘাটে হাঁটি আর এখনও হাহা শুন্য বুক নিয়ে সঞ্জীব দা’কে খুঁজে বেড়াই। তার লিরিক-সুর-ধ্বনি, তার বুক ভরা সাহস; সবমিলিয়েই এক অনন্য সত্তা সঞ্জীব।
সঞ্জীব মানে সত্য উচ্চারণ। সঞ্জীব মানে ফিনিক্স পাখি। সঞ্জীব মানে বিষণ্ণ পালকের প্রতিষেধক। এই তুড়ির তালে নাচতে থাকার নাম সঞ্জীব নয়। এই মরে মরে বেঁচে থাকার নাম সঞ্জীব নয়।
‘ঐ কান্না ভেজা আকাশ আমার ভালো লাগে না
থমকে থাকা বাতাস আমার ভালো লাগে না
তুড়ির তালে নাচতে আমার ভালো লাগে না
এই মরে মরে বেঁচে থাকা ভালো লাগে না..’
Leave a reply