বাউফল (পটুয়াখালী) করেসপনডেন্ট:
পটুয়াখালী বাউফলের সোনাভানু বেগমের মেয়ে তাসলিমা বেগম ভাগ্যের ফেরে এখান আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরের দেশ পাকিস্তানের নাগরিক। আশির দশকের শেষের দিকে পরিবারের অভাব-অনটন দূর করতে বাউফল থেকে রাজধানী ঢাকায় যান সোনাভানু বেগমের দুই মেয়ে লুৎফা বেগম ও তাসলিমা বেগম। কাজ নেন গার্মেন্টসে। নিয়মিত চিঠি আদান-প্রদান চলতো স্বজনদের সাথে।
এক ঈদের আগে বাড়ি ফেরার কথা জানিয়ে পাঠানো চিঠিই তাদের সাথে ছিল শেষ যোগাযোগ। পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পরে দুই বোনের স্থান হয় দুইটি ভিন্ন দেশে। দীর্ঘ তিন যুগ পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ নেই তাদের। তবে লুৎফার খোঁজ না মিললেও প্রায় ৩২ বছর পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে তাসলিমাকে খুঁজে পেয়েছে পরিবারের সদস্যরা।
দীর্ঘ প্রায় তিন যুগ পরে হলেও হারিয়ে যাওয়া দুই মেয়ের মধ্যে একজনকে ফিরে পেয়ে খুশি বৃদ্ধা সোনাভানু বেগম। কিন্তু ভিডিও কলে মেয়েকে দেখার সুযোগ হলেও সরাসরি কাছে পাওয়ার সুযোগে ছিল অনিশ্চয়তা। পাচারকারীর খপ্পরে পরে কিশোরী বয়সে পাকিস্তানে পাচার হয়ে যান তাসলিমা বেগম। সেসময় তার বোনকে পাঠানো হয় ভারতে। দীর্ঘদিন পর পাকিস্তানের নাগরিকত্ব পেয়েছিলেন তাসলিমা। সেখানে এখন সংসার আছে তার।
তাসলিমার সাথে যোগাযোগ করে পাচারের সেই ঘটনা এবং দেশে ফিরে একনজর মাকে দেখার জন্য তার আর্তনাদের নিয়ে গত ২৯ অক্টোবর সংবাদ প্রচার করে যমুনা টেলিভিশন। সেই সংবাদ প্রচারের একমাসের ব্যবধানেই বাংলাদেশে ঘুরতে আসার জন্য তিন মাসের টুরিস্ট ভিসা পেয়েছেন তাসলিমা বেগম ও তার শিশু কন্যা।
এখন শুধু বিমানের টিকেটের অপেক্ষা। পাকিস্তান বসে নিজ বাড়িতে ফেরার প্রহর গুনছেন তাসলিমা বেগম। মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি যমুনা টেলিভিশনকে জানান বলেন, প্রায় ৩২ বছর আগে বোনের সাথে মিরপুরের একটি গার্মেন্টসে কাজ করতেন। বেশি বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে তাকে এবং তার বড় বোন লুৎফা বেগমসহ প্রায় ১৫ জন কিশোরী ও তরুণীকে অজানা উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয়।
একসময় তাদের বহনকারী যানবাহন থেকে তাদের নামালে লুৎফাসহ কয়েকজন বুঝতে পারেন ভারতের কাশ্মিরে আছেন তারা। এ নিয়ে নারী পাচারকারী চক্রের সদস্য বাচ্চুর সাথে বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হলে লুৎফাকে অনেক মারধর করে সেই বাচ্চু। এরপর আর নিজের বোনকে খুঁজে পাননি। তাসলিমাসহ অন্যদের দুর্গম একটি পথ ব্যবহার করে পাঠানো হয় পাকিস্তানের করাচি শহরে। সেখানে একজন বৃদ্ধ পুরুষের কাছে রাখা হয় তাদের। বৃদ্ধের টেরিটোরি থেকে পালাতে সক্ষম হলেও অজানা ভিন দেশে দিক-বিদিক ছুটতে থাকেন তিনি। একসময় জ্ঞান হারান।
তখন পাকিস্তানের বাসিন্দা হুজুর বাখশ্ নামে একজন তাকে দয়া করেন। তাকে চিকিৎসা করান এবং সেখানে বৈধভাবে আশ্রয়ের সুযোগ করে দেন। এক সময় পরিচয় বাড়লে তাসলিমাকে বিয়ে করেন হুজুর বাখশ্। এই দম্পতির সংসারে আছে ৪ সন্তান। সন্তানদের সহযোগিতায় তাসলিমা পেয়েছেন পাকিস্তানের নাগরিকত্ব। মায়ের মুখে নানা বাড়ি সম্পর্কে জানতে পারে সন্তানরা। পরে নেট দুনিয়ার সহযোগিতায় দীর্ঘ আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরের বাউফলের একজন ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয় তাসলিমার সন্তানরা। সম্প্রতি সেই ব্যক্তি (প্রকৌশলী মেহেদি হাসান শাওন) ও যমুনা টিভির সহযোগিতায় তিনি পরিবার দেখার সুযোগ পেয়েছেন জানিয়ে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে তাসলিমা বেগম।
বাউফল উপজেলার কালাইয়া ইউনিয়নের টেম্পু স্ট্যান্ড সংলগ্ন হাওলাদার বাড়ির মরহুম জুলফিকার হাওলাদারের ছোট মেয়ে তাসলিমা বেগম। তার বাংলাদেশের ফেরার খবরে আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছে পুরো গ্রামবাসীর মাঝে।
এ বিষয়ে তৎকালীন ইউনিয়ন পরিষদের সাধারণ সদস্য মধু সুদন দাস ওরফে মধু মেম্বার বলেন, লুৎফার বয়স ছিল তখন ১৯ বছর আর তাসলিমার ১৩ বছর। ১৯৮৫ বা ৮৬ এর দিকে একদিন সকালে সোনাভানু বাসার এসে মেয়েদের পাচ্ছে না বলে জানায়। পরে দীর্ঘদিন তাদের যোগাযোগ পাওয়া যায়নি। আমরা ভেবেছি হয়তো কোনো দুর্ঘটনায় ওদের মৃত্যু হয়েছে। মেয়েদের খোঁজ না পেয়ে শোকে অসুস্থ হয়ে জুলফিকার হাওলাদার দুইবছর শয্যাশায়ী থেকে ১৯৮৯ সালে মারা যান।
/এনকে
Leave a reply