মুরশিদুজ্জামান হিমু
বাগাতিপাড়ায় তখনও খানসেনারা আসেনি। দু’একজন বলাবলি করছে, শহরে এসেছে। খুব জ্বালাও-পোড়াও করছে। গুলি করে মানুষ মারছে। রাস্তাঘাটে ধরে ধরে অপদস্থ করছে অনেককে। স্বপনের ভয়, কখন যে গ্রামেও চলে আসে হানাদাররা!
স্বপন ঠাকুরের বাড়ি নাটোরের বাগাতিপাড়ার নিভৃত পল্লি তমালতলায়। বাবা-মাকে নিয়ে মাটির খুপড়ি ঘরে বসবাস। বাবার চুনের ব্যবসা। অল্প পুঁজির ব্যবসা যাকে বলে। কোনোরকমে টেনেটুনে সংসার চলে। স্বপনের আয়-রোজগারও তেমন নেই। কিন্তু বয়স তো থেমে রইছে না। সুঠাম দেহের স্বপন যে দেখতে দেখতে ‘যুবক স্বপন’ হয়ে উঠেছে।
বয়স যেহেতু হয়েছে, ছেলেকে বিয়ে দিতে হবে। বাবা তাই কন্যা দেখলেন। পাশের গাঁ-য়েরই মেয়ে। বেশ মানাবে স্বপনের সাথে। কথাও পাকা হয়ে গেল। দিন-ক্ষণ-পঞ্জিকা দেখে বিয়েটাও হয়ে গেল স্বপনের। ঘরে এল টুকটুকে এক বউ।
দেশ উত্তাল। চারদিকে ‘গণ্ডগোল’ চলছে, মানে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা সংগ্রাম। প্রায়ই গোলার শব্দে কেঁপে ওঠে চারদিক। ধীরে ধীরে বাগাতিপাড়ার কাছে চলে এসেছে পাকিস্তানিরা। তাণ্ডবলীলা চালাচ্ছে, জ্বালিয়ে দিচ্ছে ঘরবাড়ি। একমুখ, দু’মুখ হতে হতে হতে সে খবর আসছে তমালতলাতেও।
হঠাৎ একদিন সকালে সোরগোল পড়ে গেল গ্রামে। হানাদার এসেছে, পালাও পালাও। গ্রামের বেশিরভাগ লোকজনই সেদিন যে যেভাবে পারলেন, গা ঢাকা দিলেন। স্বপরিবারে পালিয়ে বাঁচলেন স্বপন ঠাকুরও।
কিন্তু স্বপনের মন বসছে না কিছুতেই। দেশ মাতৃকার জন্য অস্ত্রহাতে লড়াই করবেন, মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এমন। আবার একটা পিছুটানও কাজ করছে। ঘরে মাসখানেকের বউ রেখে যাবেন? কে দেখবে তাকে? যদি পাকিস্তানিরা তুলে নিয়ে যায়? কে রক্ষা করবে? এমন নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মনে।
এভাবে কেটে গেল ক’দিন। হঠাৎ এক সকালে সবার ঘুম ভাঙল গুলির শব্দে। তাহলে কি মিলিটারি চলে এল গ্রামে? এবার কি তাহলে তমালতলাও জ্বালিয়ে দেবে হানাদাররা? হাতের কাছে যে যা পারছে, নিয়ে বের হচ্ছে। চারদিকে ছোটাছুটি করছে মানুষ। এবার জীবন রক্ষা হবে তো? নাকি হানাদারদের বুলেট এফোঁড়-ওফোঁড় করবে বুক?
ঘর থেকে নতুন বউ নিয়ে বের হলো স্বপন ঠাঁকুরও। হাতে কিছু টাকা আর ছোট্ট একটি ব্যাগ। তা নিয়ে দৌড়াচ্ছে দু’জন। গন্তব্য কোথায়, জানে না তারা।
কিছুদূর যাবার পর স্বপনের স্ত্রীর মনে হলো, বিয়ের একমাত্র স্মৃতি তাদের লাল টুকটুকে শাড়ি। তা ফেলে এসেছে ঘরে। স্বপনের স্ত্রী সেই শাড়ি ছাড়া যেতে নারাজ। প্রাণ যাবে তো যাবে, কিন্তু বিয়ের স্মৃতি শাড়ি তার চাই-ই চাই।
বউয়ের আবদার রক্ষায় স্ত্রীকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে বাড়ির দিকে রওনা হল স্বপন। এদিকে, আশপাশ পুরোটা ঘিরে ফেলেছে পাকিস্তানি হানাদাররা। তারই মাঝে অনেক কৌশল করে লুকিয়ে লুকিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়ল স্বপন। সিঁকেয় তোলা শাড়িটি নিয়ে বের হতেই পড়ে গেল হানাদারদের সামনে।
গ্রামের রাজাকাররা ততক্ষণে জানাতে বাকি রাখেনি যে, সামনের ব্যক্তিটি একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী।
বেদম মারপিট করা হলো তাকে। শক্ত বুটের তলায় যেন নিমিষেই পিষে ফেলা হলো গ্রামের সহজ-সরল স্বপনকে। গাছের সাথে বেঁধে রেখে ঘরে ঢুকলো হানাদাররা।
জীর্ণশীর্ণ বাড়ি ঠিকই। কিন্তু সেই স্যাঁতস্যাঁতে দেয়ালে ফ্রেমে বাঁধাই করা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি। দেখেই একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল পাকিরা। এত বড় সাহস! এমনি ‘হিন্দু’, তারওপর দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর ছবি! ওর ক্ষমা নেই আজ! মৃত্যুই আজ তার একমাত্র গন্তব্য।
পাকিস্তানি সেনারা বঙ্গবন্ধুর ছবি দেয়াল থেকে নামিয়ে আনল। ছুঁড়ে ফেলল বুটের তলায়। পরে সেই ভাঙা ফ্রেমের ছবি বেঁধে দিল স্বপন ঠাকুরের গলায়। ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে তাকে নিয়ে আসা হলো তিন রাস্তার মোড়ে।
ততক্ষণে স্বপন ঠাকুর বুঝে গেছে, এই পৃথিবীর আলো-বাতাস আর তার জন্য নয়। বিদায় জানাতে হবে সবকিছুকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দু’দিক থেকে দু’জন গুলি করলো স্বপন ঠাকুরকে। বঙ্গবন্ধুকে বুকে নিয়ে রক্তাক্ত স্বপন লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নিশ্চিত করা হলো এক বাঙালির মৃত্যু।
(এটি একটি সত্য ঘটনা, লেখার ক্ষেত্রে কিছু অলঙ্কার ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র।)
যমুনা অনলাইন: এমএইচ/টিএফ
Leave a reply