শাকিল হাসান
মুখ ভর্তি দাড়ি। ঝাকড়া চুল। গায়ে ছেড়া ময়লা জামা। সকাল-বিকাল শূন্য দৃষ্টি তাকিয়ে থাকেন আফজাল। নাম ছাড়া সত্যিই আর কিছু নেই তার। একে একে সব হারিয়েছেন তিনি। ফরিদপুরের পাংশা উপজেলার এক গ্রামের বাসিন্দা আফজালরা তিন ভাই-বোন। তার এক সৎ ভাইও আছে। গ্রামে ক্ষেত মজুরের কাজ করতেন বলে জানিয়েছেন। অন্যের ক্ষেতে কাজ করলেও টাকা নিতেন না আফজাল। কারণ হিসেবে জানালেন, তার প্রয়োজন হতো না তাই নিতেন না।
গ্রাম থেকে একজন তাকে ঢাকায় নিয়ে আসে। এখানে ভ্যানগাড়ি চালানোর কাজ করেছেন কিছু দিন। পরে আবার গিয়েছেন গ্রামে। এরপর আবারও ঢাকায়। আবার ভ্যানগাড়ি চালানো। এছাড়া দিনমজুরীসহ বিভিন্ন কাজ করেছেন আফজাল। তার দাবি, সব সময় সাহায্য করেছেন অন্যদের। কিন্তু নিজের প্রয়োজনের সময় কারো সাহায্য পাননি তিনি।
তাকে ব্যবহার করে অন্যরা স্বার্থ হাসিল করেছে বলে মনে করেন আফজাল। তার প্রতি মানুষের এমন আচরণ শুধু দেখে গেছেন। প্রতিবাদ করে তাদেরকে কিছু বলতেও পারেন নি। একের পর এক এমন বঞ্চনায় মানুষের প্রতি ক্ষোভ মধ্য বয়সী এই ব্যক্তির।
এরই মধ্যে ঢাকায় এক লোক তার হাতে ট্যাবলেট (ইয়াবা) তুলে দেয়। তিনি জানান, একজন নারী তাকে ট্যাবলেট সেবনে নিষেধ করেছিল। কিন্তু তখন সেসব নিষেধ শোনেননি আফজাল। মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছেন তিনি।
মনে পোষা ক্ষোভ থেকেই কংক্রিটের এই শহরে কঠিন হৃদয়ের মানুষদের থেকে দুরে থাকেন আফজাল। তিন বছর ধরে ঘুরেছেন শহরের বিভিন্ন রাস্তায়। যেখানে রাত হতো সেখানেই থাকতেন। ছয়-সাত মাস ধরে থাকছেন মালিবাগ শান্তিনগর ফ্লাইওভারের একটি পিলারের খাঁজে। এখন সকাল-দুপুর-রাত এখানেই বসে থাকেন আফজাল।
ইচ্ছে হলে কখনো নামেন। খুব ক্ষিদে পেলে নেমে কারো কাছে হাত পেতে কিছু খান। তারপর আবার পিলারের ওপর তার নিজের রাজ্যে। এখানে বসে আকাশে ওড়া নিঃসঙ্গ কাকদের সাথে কথা বলেন আফজাল। তাদের দুঃখ হৃদয় দিয়ে অনুভব করেন নিশ্চয়। তাঁর পোড় খাওয়া চোখে ধরা পড়ে ফ্লাইওভার দিয়ে চলাচল করা লাখো নাগরিকের হাজারো রঙের জীবন।
তার ভাষায়- ‘শহরে যা বুঝলাম কে কারে মাইরে উঠতে পারে। কে কারে মাইরে নিজে উপরে উঠতে পারে সেই ধান্ধায় সবাই ব্যস্ত। এই চলতেছে পরিস্থিতি। সত্যি কথা।’
মালিবাগ-শান্তিনগর ফ্লাইওভারের পাশে বসা আফজালকে পাশ কাটিয়েই চলে যান খুব ব্যস্ত নাগরিকরা। কারো একটু ফুরসৎ নেই তাকাবার। আবার কারো কৌতুহলী চোখে পড়েন তিনি, ওইটুকুই। কারো কাছে তিনি পাগল। কারো কাছে নেশাগ্রস্ত। কারো কাছে বা শুধুই হাসির খোরাক।
ওই পথে নিয়মিত যাতায়াতকারী কয়েকজন বললেন, কয়েক মাস ধরেই তাকে দেখা যাচ্ছে এখানে। কেউ আবার দাবি জানান, কোন এনজিও বা সরকার যেন তাকে এখান থেকে নিয়ে পুর্নবাসন করে। তবে ব্যক্তিগতভাবে কেউ সাহায্য করতে রাজি হননি।
মানুষের প্রতি ক্ষোভ থাকলেও এখনো আফজালের কণ্ঠে আছে নতুন করে বাঁচার আকুতি। এখনো জীবনকে খুব করে ভালবাসতে ইচ্ছে করে তার। খুব করে চান ভালভাবে বাঁচতে। তার ভাষায়, নতুন করে জীবন শুরু করতে হলে কোন একজনের সাহায্য খুব দরকার।
আফজাল চিৎকার করে বলেন- ‘আমি বাসায় থাকতে চাইছিলাম। দিতে পারবা আমার বাসা। থাকতে দিবা আমারে।’
প্রয়োজনে কাজ আদায় করে ছুঁড়ে ফেলার ঘটনা সমাজে ঘটছে অহরহই। মানুষের প্রচণ্ড স্বার্থপরতায় আফজালের হৃদয়ে তৈরি করেছে দগদগে ক্ষত। তার দাবি, যান্ত্রিক এই শহর আর এর লোভী মানুষদের থেকে দুরে থাকতেই নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন সমাজ থেকে। তাই ফ্লাইওভারের পিলারের খাঁজে শূন্য দৃষ্টিতে আফজাল বসে থাকেন খুব একা, নিঃসঙ্গভাবে।
Leave a reply