রবীন্দ্রনাথ মরে গেছেন অনেককাল আগে কিন্তু তার দেহখানি গোর দিতে দেয়া হয়নি ব্যবসার স্বার্থে। বাঙালির মনন, শিল্প আর চেতনার ব্যবসার জন্য রবীন্দ্রনাথকে দরকার হচ্ছে এবং হবে কিন্তু রবীন্দ্র সাহিত্যের সত্যিকারের চর্চা করতে নারাজ। অমন উত্তুঙ্গের মত একজন প্রতিভাবান মানুষের ভাবনায় জড়াতে যে ‘কঠিনেরে ভালোবাসতে হয়, বাঙালির তাতে অনিহা চিরকালের।’
হ্যাঁ জানি অনেকে হৈ হৈ করে বলে উঠবে- ‘কেন আমি তো এখনও নিয়মিত পড়ি’ বা ঘরে আমার রবীন্দ্র রচনাবলী। সে তো কালিদাসও পড়ছে কেউ কেউ; কিছু লোক আজীবন পড়েও যাবে। কিন্তু তারা কতজন।
যারা ত্রিশের কোটা পেরিয়েছেন তারা স্মরণ করতে পারেন, গত কয়েক দশকে পরিচিত ক’জনকে রবীন্দ্রনাথের বই বা গীতবিতান পড়তে দেখেছেন কিংবা শুনেছেন। রাস্তায় চলতে ফুটপাত ছাড়া কোথায় ছিন্নপত্র চোখে পড়েছে। যদি বলা হয়, ঘরোয়া চর্চায় কি পড়া যায় না? এইরে, এতো প্যাঁচপ্যাঁচে সিরিয়াল নয়, যা ঢুলুঢুলু চোখে দেখলেও বোঝা যায়। উচ্চমানের শিল্পের সমস্যা হচ্ছে তার পেছনে খাঁটুনি লাগে। তাই সাহিত্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উল্টেপাল্টে দেখা হয়তো যায়, বোঝা সহজ নয়। যতক্ষণ পর্যন্ত না পরীক্ষার বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে বা বুককেসটা খালি না দেখাচ্ছে ততক্ষণ রবীন্দ্র রচনাবলীর প্রয়োজন পড়ে না বাঙালির। এই বাঙালির আসলে সাহিত্যিক বা ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ চাই না; চাই উৎসবের রবী, চাই ব্যবসার রবী। আর দশটা পণ্যের মতই টেগর একটা বিজনেস প্রোডাক্ট।
এর একটা কারণ হতে পারে বাঙালি নতমস্তক পছন্দ করে। তাই রবীন্দ্রনাথকে পূজা করা হচ্ছে আজও। তার শিল্প বা সাহিত্যকে সমালোচনার ক্ষমতা গড়ে উঠেছে ক’জন বাঙালির? আর করবেই বা কি, প্রথম নন ইউরোপিয়ান নোবেল বিজয়ীর সামনে কীইবা করার আছে ভেতো জাতির। ‘উন্নত মম শির’ সেতো কথার কথা। সুতরাং পূজা প্রিয় বাঙালি রবীন্দ্রনাথের সামনে সেই যে করজোড়ে নত হয়েছে, আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি।
রবীন্দ্রনাথের পূজা ও প্রার্থণা পর্বের খুব জনপ্রিয় একটি গান ‘নয়ন তোমায় পায়না দেখিতে’। পরের লাইনটাও যে কাউকে জিজ্ঞেস করুন বলে দেবে- ‘রয়েছ নয়নে নয়নে’। তারপর আর জানে না। গুন গুন করে যাবে। ‘আজি এ প্রভাবে রবির কর’- যে কাউকে পুছ করলে গড়গড় করে পরের চরণ বলে দেবে ‘কেমনে পশিল প্রাণের পর’ অথচ তারপর? আর জানি না!
এ দৈন্যতার প্রধান কারণ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কোথাও রবীন্দ্রনাথ প্রয়োজন নেই। অসীম রবীন্দ্রনাথ দিয়ে কী করবো আমরা যেখানে অসম হলেই চলে। দাড়ি আর আলখেল্লাওয়ালা দুর্দণ্ড প্রতাপশালী একটি ইমেজ জাগিয়ে তুলে প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে দুঘন্টা লেকচার দেয়া যায়। সেটা নিজের জন্যই কেননা রবীন্দ্রনাথকে ওভাবে বক্তৃতায় বাঁচিয়ে না রাখলে রাবীন্দ্রিক বেনিয়ারা খাবে কী।
হ্যাঁ বাঙালি পড়ার বদলে হয়তো এখন শোনে বেশি। কিন্তু সেটাও রিফ্লেক্ট অ্যাকশনের মত জানেন তো? ধরা যাক, দুজন মানুষ মুখোমুখি। একজন অপরজনকে হঠাৎ ধাতব কিছু একটা ছুড়ে দিল আর উল্টোপাশে থাকা লোকটা তা লুফে নিল। যিনি লুফে নিলেন তিনি কিন্তু ভালোবেসে বস্তুটি ক্যাচ করেননি, ধরেছেন বস্তুর প্রতি তার রিফ্লেক্ট অ্যাকশন হিসেবে। যে কোন সংগীতও এই ধরণের রিফ্লেকশন। বারবার শুনতে শুনতে ওই বস্তুর প্রতি মন প্রবিষ্ট হয়। যেমন: কাপড় কাঁচার সেরা সাবান… কাপড় কাঁচার সেরা সাবান- হুইল।
রবীন্দ্রনাথ জীবদ্দশায় বলেছিলেন ‘আমার আর কিছু বেঁচে থাক বা না থাক, গান টিকে থাকবে’। রবীঠাকুর কি এই টিকে থাকারই কথা ভেবেছিলেন। গীতবিতানের একটি পাতা না উল্টেও জেনারেশনের পর জেনারেশন কি বিশ্বকবির কল্পনায় ছিল সেকালে। দুই লাইন গাওয়ার পর গুনগুন করে গেলাম যা খুশি একটা! তারপর আমারও পরানও যাহা চায়!
বাঙালি পড়ে না বললে ভুল বলা হয়। সে কী পড়ে? পত্রিকার পাতায় ছাপা হওয়া গসিপ বা ওজন কীভাবে কমাবেন- এসব পড়ে; টিভি স্ক্রলে সরসর করে চলে যাওয়া খবর পড়ে আর ফেসবুকে প্রচুর পরনিন্দা পড়ে!! এই যেমন এখন পড়ছে!!!
লেখক: আমিন বাবু, সাংবাদিক
Leave a reply