মেরুন রঙের ফুল হাতা টি-শার্ট পরা ছেলেটিকে দেখলে চট করে তার ইতিহাস পড়ে ফেলা যায় না। আপাতদৃষ্টিতে সৌম্যদর্শন ছেলেটির নাম আরিফ। আরিফ বিল্লাল। সদ্য কৈশোর পেরিয়ে যৌবন স্পর্শ করা ছেলেটি প্রাণশক্তিতে ভরপুর, আর সে জন্যই কিনা তাকে আলাদা করে চোখে পড়ে। তার স্মিত হাসিমাখা মুখ দেখে কে বলবে এক সময় এই ছেলেটিই ছিল সুন্দরবনের ত্রাস! গহীন বনে কিংবা গভীর সাগরে দোর্দণ্ড প্রতাপে দস্যুবৃত্তি করে বেড়াতো। সাধারণ এক কিশোর থেকে কীভাবে দস্যু হয়ে উঠলো আরিফ? কেমন ছিলো সে জীবন? কেনইবা ফিরে এলো স্বাভাবিক জীবনে? সুন্দরবন ঘুরে এসে জানাচ্ছেন তোয়াহা ফারুক।
গভীর সাগরে তিনটি দস্যুদলের ট্রলার মুখোমুখি। হঠাৎই শুরু হলো গোলাগুলি। একপাশে দস্যু রাজু বাহিনীর কিছু লোকজন, অন্যপাশে গামা বাহিনী ও কানা অলি বাহিনী। আকস্মিক এ ত্রিমুখী লড়াইয়ের জন্য রাজু বাহিনী মোটেও প্রস্তুত ছিল না। তার ওপর দলনেতা রাজুসহ বাহিনীর বড় অংশ তখন অনুপস্থিত। অন্যদিকে, গামা আর কানা অলি বাহিনী আজ যেন যুদ্ধজয়ের প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। নির্বিচার গোলাগুলিতে রাজু বাহিনীর বেশকিছু লোক হতাহত হলো। বাকিরা ভয়ে যেন পাথর হয়ে গেল। এ দফায় প্রাণ নিয়ে পালাতে পারলেই হয়। তখন লিকলিকে এক কিশোর অস্ত্র হাতে তুলে নিলো। দারুণ নিশানায় প্রতিপক্ষের দিকে গুলি ছুঁড়তে থাকলো। পাশাপাশি, বাহিনীর লোকদের কাপুরুষতা নিয়ে কটাক্ষ চালাতে থাকলো। যত্তসব ভীতুর দল! বাঁচতে চাইলে মেশিন নিয়ে ‘ফাইট’ করো। এহেন অপমান সহ্য করা যায়!
এরপর রাজুর অল্প ক’জন লোকই দুটো পূর্ণশক্তির বাহিনীকে পরাস্ত করে ফিরে এলো। কিন্তু তাদের বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটছেই না। অস্ত্র হাতে ফাইটে লিড দিয়েছে যে ছোকরা তাকে কখনো অস্ত্রই চালাতে দেখেনি তারা। আরিফ নামের এই ছোকরা এতদিন তাদের ফুটফরমাশ খেটে এসেছে। বাঘা বাঘা সব ডাকাতকে ছাপিয়ে সেই কিনা আজকের হিরো, টিভি পর্দা থেকে উঠে আসা নায়ক যেন! কে এই আরিফ? একটু আগে থেকেই শুরু করা যাক।
আরিফের জন্ম সাতক্ষীরার আশাশুনিতে। ছোটবেলা থেকেই খুব দুরন্ত ছেলেটি। তার সরল স্বীকারোক্তি, ‘যতসব মন্দ মানুষজন, এরাই ছিল আমার বন্ধু।’
২০০৯ সাল। আরিফ তখন অষ্টম শ্রেণিতে। পড়াশোনা বাদ দিয়ে বাড়ি ছেড়ে খুলনার কয়রায় চলে যায় আরিফ। সেখানে তার এক দুলাভাই থাকে। দু’জনের মেলে ভালো। একসাথে মাছের ব্যবসা করবে, এমনটাই ছিল ভাবনা। আরিফের দুলাভাইয়ের ঘুরেফিরে এক কথা, একটা ঘাট নিতে পারলে ভালো হয়। যেখানে কেবল তারাই মাছ ধরতে পারবে, জালের ব্যবসা করবে।
আরিফকে একথা বলার কারণ ছিল। আরিফের মামা রাজু তখন নামকরা ডাকাত। রাজু একবার বলে দিলেই আশেপাশের লোকজন সেখান থেকে সরে যাবে। ঘাঁটানোর সাহস পাবে না কেউ। ভয়ে ভয়ে মামাকে কথাটা জানায় আরিফ। পড়াশোনার লাটে উঠবে এ চিন্তায় আপত্তি করে রাজু। বলে, এ লাইনে ঝামেলা আছে, এর মধ্যে আসার দরকার নেই।
নানাভাবে মামাকে রাজি করানোর চেষ্টা করে আরিফ । ভাগ্নের চাপাচাপিতে একসময় তাদের একটা ঘাট নিয়ে দেয় দস্যু রাজু। যারা আগে থেকে ঘাট দখল করে ছিল, রাজু তাদের সরিয়ে দিল। সরাসরি রাজুর সাথে বিরোধিতা করার সাহস না করলেও আরিফ ও তার দুলাভাইয়ের নামে তারা থানায় জিডি করলো। এসব পরোয়া করার সময় আছে আরিফদের? তাদের পাশে আছে দস্যু রাজু, যার ভয়ে কাঁপে গোটা সুন্দরবন।
কিছুদিনের মধ্যে ঘটে গেল আরেক ঘটনা। যে জিডি করেছিলো তার একভাইকে কারা যেন খুন করলো। হত্যা মামলার আসামি হয়ে গেল আরিফ ও তার দুলাভাই। আরিফের ভাষ্যমতে, স্থানীয় প্রভাবশালীদের বিরোধের জেরে এ হত্যার ঘটনা ঘটে। মাঝখানে পরে তারা আসামি হয়ে যায়। এখানেই তাদের ব্যবসার ইতি।
মিথ্যা মামলার ফেরারি আসামি হয়ে পালিয়ে বেড়াতে থাকে আরিফ ও তার দুলাভাই। প্রথমে তারা যায় মোংলা, আরিফের নানা বাড়ি। কিন্তু বেশিদিন থাকতে পারেনি। হত্যা মামলার অপবাদ মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াতে বেড়াতে একসময় অতিষ্ঠ হয়ে গেল কিশোর আরিফ। আবারও তার মামা দস্যু রাজুর শরণাপন্ন হলো। এবার রাজু বাহিনীর সাথে নিচে নামতে (জঙ্গলে দস্যুবৃত্তিতে) চাইলো আরিফ। শোনামাত্র নাকচ করে দিলো রাজু। নিজে নামকরা ডাকাত হয়ে ভাগ্নেকে কেন এপথে আসতে বাধা দিলো রাজু? আরিফের ভাষায়, তার বাবাকে রাজু অনেক সম্মান করতো, মূূূলত সে কারণেই অনাগ্রহ। রাজু চাইতো ভাগ্নে পড়াশোনা করে সম্মানজনক কিছু একটা করুক।
কিন্তু কিশোর আরিফের মনে ততদিনে দস্যুবৃত্তির ‘রোমাঞ্চ’ ঢুকে গেছে। সে গোঁ ধরায় একসময় রাজু তাকে দেখা করতে বললো। বন বিভাগের একটা অফিসে (আরিফের ভাষায় ‘গেওখালি অফিস’) আসতে বললো। সময়মতো আরিফ সেখানে গিয়ে হাজির। কিন্তু রাজুর কোনো খবর নাই। তিনদিন পর বাহিনীসহ রাজু সেখানে পৌঁছালো। গিয়েই আরিফকে কড়া শাসন করলো। শখ কত তার, ডাকাত হবে!
প্রশ্ন জাগতে পারে, সরকারি অফিসে কীভাবে বনদস্যুরা অবাধে যাতায়াত করতো? তখন এটা ছিল সাধারণ ঘটনা, ওপেন সিক্রেট। দাপটের সাথে সুন্দরবনে ঘুরে বেড়াতো দস্যুরা। চাইলেই যে বাড়তি লোক ডেকে এনে এদের শায়েস্তা করা যাবে, দুর্গম বনে সেটা সহজও ছিল না। ফলে দস্যুদের সাথে সমঝোতা করেই চলতো সবাই।
রাজু তার ভাগ্নেকে বললো, এসেছ যখন কয়েকদিন থেকে হাজার দশেক টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরে যাও। কিন্তু আরিফ নাছোড়বান্দা; এভাবে ফেরারি হয়ে থাকার চেয়ে বরং মামার কাজেই যোগ দিবে সে। রাজু তাকে আশ্বস্ত করে, মামলার বিষয় সে দেখভাল করবে। আরিফের কথা, যতদিন মামলা আছে অন্তত ততদিন সে মামার সাথেই থাকবে। রাজুর শর্ত, আরিফ যতদিন তাদের সাথে থাকবে কোনো অস্ত্র ধরতে পারবে না। বাহিনীর খাবারের ব্যবস্থা, রান্না-বান্না, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করবে। এভাবেই সুন্দরবনের কুখ্যাত দস্যু রাজুর বাহিনীর সাথে যুক্ত হয়ে পড়লো আরিফ। সে ছিল বাহিনীটির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। রাজুর ভাগ্নে হওয়ায় বাহিনীর সদস্যরা তার সাথে ভালো ব্যবহার করতো।
আরিফ ভেবেছিল, মামার এসব শর্ত কথার কথা, তাকে নিরুৎসাহিত করার জন্য বলা। কিন্তু সত্যি সত্যি রান্না-বান্না, পানি টানা, ধোয়ামোছা করার কাজই দেয়া হলো তাকে। এ কাজে কষ্ট ছিলো, থ্রিল ছিল না মোটেও, যার আশায় আরিফের ডাকাত হওয়া। রোজ ৪৫/৫০ জনের খাবার রান্না করতে হতো তাকে। এসব কাজে তার সঙ্গী ছিলো বাচ্চু নামের আরেক কিশোর, বয়সে খানিকটা বড়। অল্প সময়ে বাচ্চুর সাথে গভীর বন্ধুত্ব হয় আরিফের। সুযোগ পেলেই বাহিনীর সদস্যদের নজর এড়িয়ে একেকটা অস্ত্র নেড়েচেড়ে দেখতো তারা। কীভাবে একটা ‘ফাইট’ করে রাজু বাহিনীর সক্রিয় সদস্য হয়ে ওঠা যায়, গল্পে-কল্পনায় সে ছবিই আঁকতে থাকে দুই বন্ধু।
(চলবে…)
দ্বিতীয় পর্ব পড়তে : দস্যুদের খাবারে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে ৫২ লাখ টাকা নিয়ে পালায় আরিফ
যমুনা অনলাইন: টিএফ
Leave a reply