দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোতে মৌলিক পরিবর্তন আসছে। ধীরে ধীরে এই কাঠামো পরিবর্তিত হয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন উন্নত দেশের অর্থনীতির কাতারের দিকে এগোচ্ছে।
দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে আরও টেকসই করতে সরকার ইতিমধ্যে বহুমুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) কৃষির অবদান কমিয়ে শিল্প খাতের অবদান বাড়ানোর কৌশল নেয়া হয়েছে।
একই সঙ্গে সেবা খাতের অবদান কমানো হচ্ছে। প্রযুক্তিনির্ভর সেবা বাড়ানোর মাধ্যমে কমানো হচ্ছে উৎপাদন খরচ। এর মাধ্যমে অর্থনীতিতে কাঠামোগত রূপান্তর আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব মিলে উন্নত অর্থনীতির দিকে পর্যায়ক্রমে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য তৈরি বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি কাঠামোর প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, উন্নত অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট হচ্ছে টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন। কম খরচে বেশি পণ্য উৎপাদন। ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি। জিডিপির আকারের তুলনায় কর আহরণের পরিমাণ বাড়ানো। বাংলাদেশের অর্থনীতি ইতিমধ্যে সেদিকে যাত্রা শুরু করেছে। আগামীতে এসব লক্ষ্য আরও বেশি মাত্রায় অর্জনের জন্য সরকার সেভাবে নীতি প্রণয়ন করছে। জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান বৃদ্ধি পেলে স্থায়ী কর্মসংস্থান বাড়ে। কিন্তু কৃষিতে কর্মসংস্থান বাড়ে অস্থায়ীভাবে। যদিও এখনও কৃষিতেই কর্মসংস্থানের হার বেশি। এরা বেশির ভাগই খণ্ডকালীন কর্মী। এদের স্থায়ী কাজের জোগান দিতে হলে শিল্প খাতকে চাঙ্গা করতে হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০১-০২ অর্থবছরে জিডিপিতে কৃষির অবদান ছিল ২০ শতাংশ। এর আগে এর অবদান আরও বেশি ছিল। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কৃষির অবদান কমে ১৪ দশমিক ১ শতাংশ হয়েছে। চলতি অর্থবছরে ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ খাতে লক্ষ্যমাত্রা আরও কমিয়ে ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ করা হয়েছে।
তবে জিডিপিতে কৃষির অবদান কমলেও এ খাতে উৎপাদন বেড়েছে। প্রযুক্তি ও আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে এ খাতে উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। প্রতি বছর গড়ে কৃষি খাতের উৎপাদন বাড়ছে ১৫ থেকে ১৭ শতাংশ হারে। কৃষির উৎপাদন নির্ভর করে আবহাওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পণ্যের দাম পাওয়ার ওপর। এ কারণে এ খাতকে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তির আসনে ধরে রাখা সম্ভব নয়। এ কারণেই শিল্প খাতের দিকে নজর দিয়েছে সরকার। উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতিও শিল্প খাতের ওপর নির্ভরশীল। তবে কৃষি উৎপাদনকে কাজে লাগাতে সরকার কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তুলছে। এতে কৃষিতে টেকসই উন্নয়ন হচ্ছে। একই সঙ্গে অর্থনীতিতে শিল্পের অবদান বাড়ছে।
আগে সেবা খাতের অবদান জিডিপিতে অনেক কম ছিল। গ্যাস উৎপাদন ও মোবাইল ফোন সেবা খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর ফলে এ খাতের অবদান বেড়েছে। ২০০১-০২ অর্থবছরে জিডিপিতে সেবা খাতের অবদান ছিল ৫৬ দশমিক ২ শতাংশ। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ছিল ৫২ দশমিক ২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে ধরা হয়েছে ৫১ দশমিক ৯ শতাংশ। আগামী অর্থবছরের জন্য ধরা হয়েছে ৫১ দশমিক ৬ শতাংশ।
জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান এখন বেড়ে চলেছে। ২০০১-০২ অর্থবছরে শিল্প খাতের অবদান ছিল ২৩ দশমিক ৮ শতাংশ। গত অর্থবছরে এ খাতের অবদান বেড়ে হয়েছে ৩৩ দশমিক ৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে ধরা হয়েছে ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী অর্থবছরের জন্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ।
কর্মসংস্থানের দিক থেকে এখনও সবচেয়ে বেশি রয়েছে কৃষি খাতে। এরপর রয়েছে সেবা খাতে ও সর্বশেষ শিল্প খাতে। তবে গত ২০ বছরে শিল্প খাতে কর্মসংস্থানের হার বাড়ছে। সেবা খাতের বহুমুখী প্রসার হওয়ায় এ খাতেও কর্মসংস্থান বাড়ছে। তবে কৃষি খাতে কর্মসংস্থানের হার কমতে শুরু করেছে। আর কৃষি খাতের কর্মীরাই বেশি আয় বৈষম্যের শিকার। কেননা সারা বছর তাদের কাজের নিশ্চয়তা নেই। ফলে আয়ের ধারাবাহিকতা বজায় থাকে না। কৃষি খাতের একটি অংশ মৎস্য খাত। এ খাতের জেলেদের যখন মাছ ধরা বন্ধ রাখা হয় তখন সরকার থেকে সহায়তা দেয়া হয়। কিন্তু কৃষি খাতের জন্য এমন কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে এ খাতের কর্মীরা বঞ্চিতই থাকছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২০০১-০২ অর্থবছরে মোট কর্মসংস্থানের মধ্যে কৃষি খাতে নিয়োজিত ছিল ৫১ দশমিক ১ শতাংশ। গত অর্থবছর পর্যন্ত তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪০ দশমিক ২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে তা হবে ৩৯ দশমিক ৮ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে এ খাতে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৯ দশমিক ৫ শতাংশ।
একইভাবে ২০০১-০২ অর্থবছরে সেবা খাতে কর্মসংস্থানের হার ছিল ৩২ শতাংশ। গত অর্থবছরে তা বেড়ে হয়েছে ৩৯ দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে হবে ৩৯ দশমিক ৭ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে ৪০ শতাংশ করার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
২০০১-০২ অর্থবছরে শিল্প খাতে কর্মসংস্থানের হার ছিল ১৬ শতাংশ। গত অর্থবছরে তা বেড়ে হয়েছে ২০ দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে তা হবে ২১ দশমিক ২ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে এ খাতে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২২ শতাংশ।
Leave a reply