নগরীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা নদী ও সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। রাত-দিন চোর, ছিনতাইকারী, চোরাকারবারি ও মাদক ব্যবসায়ীদের উৎপাতে নদীতে চলাচলকারী মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে।
নদীর ভেতর সংশ্লিষ্টদের নজরদারি না থাকায় অপরাধীরা বুড়িগঙ্গাকে অভয়ারণ্য হিসেবে বেঁচে নিয়েছে।
এ ছাড়া নদীতে চলাচলকারী বালুবাহী ট্রলার থেকে বিভিন্ন গ্রুপের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ উঠছে। ভুক্তভোগী স্থানীয় লোকজন ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
ভুক্তভোগীরা জানান, প্রতিদিন লঞ্চগামী ও নদী পারাপার হওয়া যাত্রীদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ছিনতাই ও চুরি করে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে চোর ও ছিনতাইকারী চক্র।
সদরঘাটকেন্দ্রিক তেল চোরাকারবারি চক্রের কার্যক্রম ও নদীতে ভাসমান মাদকসেবীদের উৎপাত দিন দিন বেড়ে চলছে। ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকায় মাদক বেচাকেনা করছে মাদক ব্যবসায়ীরা।
প্রতিদিন বুড়িগঙ্গার পোস্তগোলা থেকে সদরঘাট-বাদামতলী ও সোয়ারীঘাট পয়েন্টে কালোবাজারিরা তেল ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে।
চোরাইপথে ডিজেল চোরাকারবারি চক্র জাহাজ, লঞ্চসহ বিভিন্ন নৌযান থেকে অর্ধেক মূল্যে তেল ক্রয় করে। ক্রয় করা তেলে ভেজাল মিশিয়ে খোলা বাজারে বিক্রি করছে। আবার গ্রুপগুলোর মধ্যে আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময় মারামারির ঘটনাও ঘটে।
সূত্র জানায়, ২০ মে কেরানীগঞ্জের তেলঘাট থেকে সদরঘাটে নৌকায় পাড়ি দেয়ার সময় ৭-৮ জন যাত্রীকে ট্রলারযোগে আসা একদল ছিনতাইকারী অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সর্বস্ব লুটে নেয়।
এ ঘটনায় ভুক্তভোগীরা সদরঘাট টার্মিনাল পুলিশ ফাঁড়িতে অভিযোগ জানালে নদীর ভেতরের সীমানা তাদের নয় বলে জানিয়ে দেয় পুলিশ।
২ মে কেরানীগঞ্জের মিরেরবাগ থেকে নৌকাযোগে সদরঘাটে যাওয়ার সময় একজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ছিনতাইকারী চক্র আশি হাজার টাকা লুটে নেয়। ৪ জুন সকাল ৯টার দিকে টঙ্গির একজন কাপড় ব্যবসায়ী চর কালীগঞ্জ থেকে ৩০০ পিস জিন্স প্যান্ট ও ১০০ পিস শার্ট নিয়ে নদী পার হওয়ার সময় ট্রলারযোগে কয়েকজন যুবক এসে অস্ত্রের মুখে সব নিয়ে যায়।
অন্যদিকে সদরঘাট টার্মিনালের গ্যাংওয়ে ও লঞ্চের ভেতরও সংঘবদ্ধ চোর ও ছিনতাইকারীরা প্রায়ই যাত্রীদের লাগেজ, মোবাইল ও মানিব্যাগ নিয়ে চম্পট দিচ্ছে। টার্মিনাল ও লঞ্চ থেকে গত এক মাসে অন্তত ২০ ব্যক্তি তাদের মানিব্যাগ, লাগেজসহ মূল্যবান সামগ্রী খুইয়েছে।
অন্যদিকে বুড়িগঙ্গার সদরঘাট, শ্যামবাজার, ওয়াইজঘাট পয়েন্টে সন্ধ্যা নামলেই ভাসমান মাদকের হাট বসে। ছোট ডিঙ্গি নৌকায় করে দীর্ঘদিন ধরে মাদক বিক্রেতারা গ্রাহকদের কাছে ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন মাদক বিক্রি করছে।
নদীতে আধা ঘণ্টা-এক ঘণ্টার জন্য ছোট নৌকা ভাড়া নিয়ে মাদক সংগ্রহ করে নিরাপদে তা সেবন করার সুযোগ থাকায় বুড়িগঙ্গার ভাসমান মাদক স্পট নিরাপদ জোন হিসেবে গড়ে উঠেছে।
প্রতিদিন এসব পয়েন্টে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই নৌকা রিজার্ভ করার হিড়িক পড়ে যায় বলে জানান অনেক মাঝি। আবদুল খালেক নামের এক মাঝি জানান, সারা দিন খেয়া পারাপারে তেমন আয় হয় না।
কোনো কোনো দিন ভাতের পয়সাও উঠাতে কষ্ট হয়। সন্ধ্যার পরেই কয়ডা পয়সা হয়। স্যারেরা এক থেকে দেড় ঘণ্টা রিজার্ভ নিয়ে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা দেয়।
এ সময় স্যারেরা কি করে প্রশ্ন করলে হাসি দিয়ে এ মাঝি বলেন, ছোট ছোট বোতলে কি জানি খায়, একেকটার দাম বলে হাজার টেহা (টাকা)।
নদীতে চলাচলরত প্রতিটি নৌযান ও বালুবাহী ট্রলার থেকে বিভিন্ন সংস্থার নামে ৫-৬টি পয়েন্টে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে।
আবুল হাসেম নামে একজন বাল্কহেডের সুকানি (ট্রলার চালক) বলেন, প্রতি ট্রিপে নৌ-পুলিশকে ৫ লিটার ডিজেল ও ২০০ টাকা দিতে হয়। না হলে ট্রলার আটকে দেয়া হয়। ছোট ও বড় ট্রলার ভেদে এ হার ৫০০ টাকা পর্যন্ত হয় বলে জানান তিনি।
হাসনাবাদ নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. শরিফুল ছিনতাই রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে না পারার কথা স্বীকার করে বলেন, আমরা নদীতে নিয়মিত টহল দিচ্ছি। তার পরও অপরাধীদের ঠেকানো যাচ্ছে না।
তবুও আমরা চেষ্টা করছি। তবে টাকা উঠানোর কথা তিনি অস্বীকার করেন।
অন্যদিকে, রাতে বুড়িগঙ্গা নদীতে বালুবাহী কার্গো জাহাজ, বাল্কহেড চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও জাহাজ মালিকরা মানছেন না। এর ফলে ছোটখাটো দুর্ঘটনা লেগেই আছে বলে জানান ভুক্তভোগীরা।
এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর ঢাকা নদীবন্দরের বন্দর শাখার যুগ্ম পরিচালক একেএম আরিফুর রহমান বলেন, নদীর নিরাপত্তা ও অবৈধ নৌযান দেখার দায়িত্ব আমাদের নয়। এটি দেখার দায়িত্ব পুলিশ ও নৌপরিবহন অধিদফতরের।
তবে বর্দিং চার্জ আদায়ের বিষয়ে তার জানা নেই বলে জানান তিনি। নৌ অধিদফতরের জরিপ রেজিস্টার প্রকৌশল বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মির্জা সাইফুর রহমান বলেন, আইন মোতাবেক একটি জাহাজের মালিক নিবন্ধনের আবেদন করার পর আমাদের কার্যক্রম শুরু হয়।
এ কারণে কেউ অবৈধ নৌযান চালালে তা দেখার দায়িত্ব আমাদের নয়। সদরঘাট নৌথানার অফিসার ইনচার্জ রেজাউল করীম ভুইয়া বলেন, গত কয়েক দিন আগে নদীতে ছিনতাই করার সময় আমরা দুই ছিনতাইকারীকে হাতেনাতে গ্রেফতার করেছি। ওই ছিনতাইকারীদের গ্রেফতারের পর থেকে নদীতে ছিনতাই অনেক কমে গেছে।
নৌ-পুলিশের ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার একেএম এহসান উল্যা বলেন, নদীতে যে কোনো দুর্ঘটনায় দায়ী করা হয় পুলিশকে। কিন্তু নজরদারির দায়িত্ব নৌ-পুলিশের একার নয়। সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব বিআইডব্লিউটিএ’র।
বালুবাহী ট্রলারগুলোর রাতে চলাচল নিষেধাজ্ঞা অমান্য করা ও অবৈধ নৌযানের বিরুদ্ধে নৌ-পুলিশ দুই মাসে ৩৫টি মামলা করেছে।
সূত্র: কাওসার মাহমুদ, যুগান্তর
Leave a reply