চোরচক্রের দৌরাত্ম্যে মহাসড়কে রফতানিমুখী গার্মেন্টপণ্য পরিবহন ঝুঁকির মুখে পড়েছে। চালক, হেলপার, ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি এবং পরিবহন শ্রমিকদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা চোরচক্র এখন বেপরোয়া।
সাঈদ প্রকাশ ওরফে সিলেটি সাঈদ ও মনাইয়া নামে দু’জন চক্রের সর্দার। এরা গত দু’বছরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দুই শতাধিক চুরির ঘটনা ঘটিয়েছে। অথচ মামলা হয়েছে মাত্র ৩০টির।
এ ধরনের চুরির সঙ্গে জড়িত ৬০ দুর্ধর্ষ চোরের একটি তালিকা তৈরি করেছেন গোয়েন্দারা। তালিকা ধরে একাধিক সংস্থা অনুসন্ধানে নেমেছে। অধিকাংশ চুরির সঙ্গে এ দুই সর্দারের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।
রফতানির পথে গার্মেন্টপণ্য চুরির কারণে দেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য না পেয়ে অনেক বিদেশি ক্রেতা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এতে আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।
একের পর এক চুরির ঘটনা ঘটলেও মামলা করতে আগ্রহী নন ভুক্তভোগী পরিবহন ব্যবসায়ীরা। একাধিক পরিবহন ব্যবসায়ীর ভাষ্য- প্রথমত, মামলা করে তারা তেমন কোনো উপকার পান না। সাধারণ চুরির সঙ্গে এই চুরির ঘটনা মিলিয়ে ফেলা হয়। জামিনযোগ্য ধারায় দুর্বল মামলা করায় আসামিরা গ্রেফতার হলেও দ্রুত ছাড়া পায়।
এর চেয়ে তারা চোরদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মালামাল উদ্ধারের চেষ্টা করেন। চাহিদামতো অর্থ পেলেই চোররা ফেরত দেয় মালামাল। এসব কারণে অধিকাংশ ঘটনায় মামলা হয় না। এ ছাড়া চক্রটির সঙ্গে অনেক প্রভাবশালী জড়িত। ফলে তাদের কিছুই করা সম্ভব হয় না।
আন্তঃজেলা ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী জাফর আহম্মদ বলেন, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ছত্রছায়ায় মহাসড়কে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে চোরচক্র।
চালক ও হেলপারদের যোগসাজশে রফতানির পথে গার্মেন্টপণ্য চুরির ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় তারা ঝুঁকির মুখে পড়েছেন। মালামাল চুরি হলে একদিকে পরিবহন ব্যবসায়ীদের ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে; অন্যদিকে গার্মেন্ট মালিকদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। আবার বিদেশি ক্রেতারা মালামাল কম পেয়ে চুক্তি বাতিল করছেন। অনেক ক্রেতা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এতে দেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।
তিনি বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক এখন পুরোটাই অনিরাপদ। চোরচক্রে অতিষ্ঠ হয়ে তাদের বিষয়ে সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করায় উল্টো তারা হত্যার হুমকি দিচ্ছে।
সাঈদ প্রকাশ ওরফে সিলেটি সাঈদ ও মনাইয়া আমাকে হত্যার হুমকিও দিয়েছে। এ ঘটনায় ২৬ এপ্রিল চট্টগ্রাম মহানগরের সদরঘাট থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করেছি। এ বিষয়ে সাঈদ প্রকাশ ওরফে সিলেটি সাঈদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার ব্যবহৃত দুটি মোবাইল নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। মনাইয়ার মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে সেটিও বন্ধ পাওয়া যায়।
মহাসড়কে রফতানিযোগ্য তৈরি পোশাক চুরির ঘটনায় ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) এবং চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) একাধিক ইউনিট তদন্ত শুরু করেছে।
জানতে চাইলে ডিএমপির গোয়েন্দা পুলিশের সিরিয়াস ক্রাইম বিভাগের সিনিয়র সহকারী কমিশনার সোলায়মান মিয়া বলেন, সম্প্রতি রাজধানীর তুরাগ থানা এলাকা থেকে চোরচক্রের সাত সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। রফতানির সময় পণ্য চুরির সঙ্গে জড়িত অনেকের নাম বলেছে তারা। এখন এসব তথ্য যাচাই-বাছাই হচ্ছে।
সিএমপির গোয়েন্দা উত্তর বিভাগের এডিসি মির্জা সায়েম মাহমুদ বলেন, সম্প্রতি গার্মেন্টপণ্য চুরির মামলায় ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়। পরে রিমান্ডে এনে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অনুসন্ধান চলছে।
দুর্ধর্ষ চোরচক্রে যারা : মামলার তদন্তের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা জানান, মহাসড়কে তৈরি পোশাক চুরির অধিকাংশ ঘটনার সঙ্গে সাঈদ প্রকাশ ওরফে সিলেটি সাঈদ ও তার একান্ত সহযোগী মনাইয়া জড়িত। সিলেটি সাঈদ দীর্ঘদিন এর সঙ্গে জড়িত।
তার গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজার সদরের দরলপপুর গ্রামে। তার বাবার নাম আছিফ মিয়া। মনাইয়ার বিস্তারিত পরিচয় জানার চেষ্টা করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের এক নেতার নেতৃত্বে একটি চোর সিন্ডিকেটের তথ্য এসেছে গোয়েন্দাদের হাতে।
গোয়েন্দা তালিকায় থাকা দুর্ধর্ষ চোরদের মধ্যে রয়েছে- চালক আকবর আলী, চালক মহিন উদ্দিন, চালক রুবেল হোসেন, চালক নিজাম হোসেন, হেলপার রাসেল, হেলপার সুমন, আনোয়ারুল আজীম, আবদুল লতিফ, সেলিম, রাজীব হাওলাদার, রানা হাওলাদার, জাহাঙ্গীর হোসেন, শহিদুল ইসলাম, আনসার আলী, হারুন, বাবলু, মো. হৃদয়, সাইদুল হক, রাসেল, দালাল নুরু, সাহাদাত হোসেন, ওবায়দুল হক, সোহাগ হোসেন, সিরাজ মিয়া, সুমন, কাওছার হোসেন, সাজ্জাদ হোসেন, শাহাদাত হোসেন, আনোয়ার হোসেন, রাসেল ওরফে শাহজাহান, মঞ্জুরুল ইসলাম, মনির হোসেন, খোরশেদুল আলম মামুন, মধু শেখ, নাজির, আবদুল করিম, সজীব হোসেন, স্বপন, রিপন, বাবুল, মুন্না, সালাউদ্দিন, আবদুল মান্নান, সায়েদুল হক, রাসেদ, শহিদুল ইসলাম, রাশেদ, নজরুল, ইয়াছিন উদ্দিন, জাকির মাঝি, হুদয় মাঝি, সাকিবুল মাঝি, রাজু মাঝি, মহসিন মাঝি, নবী হোসেন, ইউসুফ ও বাবু।
পুলিশ জানায়, পণ্যগুলো পোশাক কারখানা থেকে রফতানির উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠানোর সময় চালক ও পরিবহন শ্রমিকদের সহায়তায় পথেই চুরি হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিশেষ পদ্ধতিতে প্যাকেট খুলে কিছু পণ্য সরিয়ে নেয়া হয়। পরে আবার প্যাকেট সিলগালা করে আগের মতো করে রাখে।
অনেক সময় প্যাকেটে ঝুট রেখে সিলগালা করে দেয়া হয়। ফলে বিদেশে যাওয়ার পর ক্রেতারা পণ্য কম পাচ্ছেন। এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে অনেক বিদেশি ক্রেতা বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানির আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এতে ক্রেতারা রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চুরি হওয়া পণ্যগুলো ফেনীর বিসিক শিল্পনগরী, খাইয়ারা, ছাগলনাইয়া, লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন এলাকা, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া, নারায়ণগঞ্জের কাঞ্চন, রূপগঞ্জ, সোনারগাঁ, ভূলতা, গাজীপুরের টঙ্গী এবং জয়দেবপুর এলাকায় বিভিন্ন গোপন ডিপোতে রাখা হয়। এদিকে ঢাকার উত্তরা, বনশ্রী, খিলক্ষেত ও গুলশান এলাকায় চক্রের গোপন ডিপো রয়েছে। সেখান থেকে তারা অসাধু স্টকলট ব্যবসায়ীদের কাছে পণ্যগুলো বিক্রি করে দেয়।
সূত্র: যুগান্তর
Leave a reply