বিশ্বব্যাপী স্মার্টফোনে ফ্রন্ট বা সেলফি ক্যামেরা যত বেশি উন্নত হচ্ছে ‘সেলফি’ যেন এক নেশায় পরিণত হচ্ছে। গত প্রায় এক দশকে বিশ্বজুড়ে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে বহু মানুষ। প্রতি বছর সেলফি তুলতে গিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এক গবেষণায় উঠে এসেছে, গত দশ বছরে হাঙরের আক্রমণে যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে তার পাঁচগুণ মানুষ মরেছে সেলফি তুলতে গিয়ে! দিন দিন স্মার্টফোন কোম্পানিগুলো তাদের সেলফি ক্যামেরা উন্নত থেকে উন্নততর করছে। পাশাপাশি সেলফি স্টিকসহ ছবি তোলার নানারকম অনুষঙ্গ আগমনের পর আরও সহজে সেলফি তোলা যাচ্ছে। ফলে সেলফি তোলার ঝোঁকও বাড়ছে।
ভারতের জার্নাল অব ফ্যামিলি মেডিসিন অ্যান্ড প্রাইমারি কেয়ার পরিচালিত গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। ২০১১ সালের অক্টোবর মাস থেকে ২০১৭ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী সেলফি তুলতে গিয়ে ২৫৯ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে হাঙরের আক্রমণে মারা গেছে মাত্র ৫০ জন মানুষ।
গবেষকরা বলছেন, সেলফি তোলার আসক্তি সত্যি সত্যিই একটা ‘সমস্যা’ এবং আপনি যদি দিনে ৬টির বেশি সেলফি তোলা এবং তা সামাজিক মাধ্যমে আপলোড করার তাড়না বোধ করেন তাহলে বলতে হবে আপনার ‘ক্রনিক সেলফাইটিস’ হয়েছে। এ নিয়ে সম্প্রতি দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান- ইংল্যান্ডের নটিংহ্যাম ট্রেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় এবং ভারতের থিয়াগারাজার স্কুল অব ম্যানেজমেন্ট মিলে একটি জরিপ করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেলফি মেয়েরা বেশি তুললেও তরুণরা সেলফি তুলতে ঝুঁকি নেয় বেশি। এ কারণে সেলফি তুলতে গিয়ে মোট মৃত্যুর তিন-চতুর্থাংশই ঘটে ছেলেদের ক্ষেত্রে পানিতে ডুবে, গাড়ি দুর্ঘটনায়, পড়ে গিয়ে বা গুলি খেয়ে। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটেছে ভারতে। জানা যায়, মোট জনসংখ্যা ১৩০ কোটি। সেলফি তুলতে গিয়ে ভারতে ১৫৯ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী সেলফিতে মোট মৃত্যুর অর্ধেক। এটাকে রোধ করতে ভারত জুড়ে ইতিমধ্যে ‘নো সেলফি জোন’ ঘোষণা করা হয়েছে; শুধু মুম্বাই শহরেই ১৬টি এমন এলাকা রয়েছে।
যেখানে-সেখানে হরহামেশা সেলফি তোলায় ব্যস্ত এক শ্রেণির মানুষ। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে কাজটি করে থাকেন তারা। কখনও কখনও ঘটে দুর্ঘটনাও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেলফি নিয়ে ঘটছে মজার মজার ঘটনা। আর তাই তো সেলফি তোলাকে এক ধরনের মানসিক রোগ বলেছেন একদল গবেষক।
রাস্তাঘাটে, যে কোনো মুহূর্তে, বন্ধুদের আড্ডা, বিয়েবাড়িসহ বিভিন্ন উপলক্ষে সেলফি তোলাটা এখন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আসলে তা নয়। এক ধরনের অবসেসিভ ডিজঅর্ডারের কারণেই এ সেলফি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। তা এমন পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে যে, বিপজ্জনক সেলফি তোলা থেকেও বিরত থাকছে না তারা।
রাশিয়ায় সেলফি তোলার সময় ব্রিজ ও বহুতল ভবন থেকে পড়ে মৃত্যু হয়েছে বেশ কিছু মানুষের। এমনকি ল্যান্ড মাইন হাতে নিয়ে সেলফি তুলতে গিয়েও মৃত্যু হয়েছে অনেকের। যুক্তরাষ্ট্রে সেলফি তুলতে গিয়ে সব থেকে বেশি মৃত্যু হয়েছে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে। জানুয়ারি মাসে তাইওয়ানে ৩৬ বছর বয়সী এক সেলব্রিটি পাহাড়ের চূড়ায় বিকিনি পরে সেলফি তুলতে গিয়ে খাদে পড়ে মারা গেছেন। বিপদ কমাতে ২০১৫ সালে রাশিয়ায় পুলিশ ‘ঝুঁকিমুক্ত সেলফি’ নামে একটি জনসচেতনতামূলক গাইড বইও প্রকাশ করেছিল।
সেলফির ইতিহাস : রবার্ট কর্ণিলিয়াস, একজন মার্কিন আলোকচিত্রী, যিনি ১৮৩৯ সালে নিজের একটি আত্ম-প্রতিকৃতি ক্যামেরায় ধারণ করেন, যা ছিল প্রথম কোনো একজন ব্যক্তির আলোকচিত্র। ১৯০০ সালে পোর্টেবল কোডাক ব্রাউনি বক্স ক্যামেরা বাজারে আসার পর ফোটোগ্রাফিক আত্ম-প্রতিকৃতি তোলা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। বহনে সহজ এই ক্যামেরার সাহায্যে আয়নার মাধ্যমে সেলফি তোলার প্রচলন শুরু হয় তখন থকেই। সেলফি শব্দটির প্রাথমিক ব্যবহার ২০০২-এর আগে পাওয়া গেলেও ২০০২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর অস্ট্রেলিয়ান এক অনলাইন ফোরামে (এবিসি অনলাইন) প্রথম ব্যবহৃত হয়।
Leave a reply