শামসউজজোহা:
জুলাই মাসের সমান্তরালে শ্রাবণ বয়ে যায়, শ্রাবণ ধারা বয়। এবারও যাচ্ছে আরেকটি শ্রাবণ। শ্রাবণ মানেই হয় পাগলা হাওয়া, নয়তো বাদল দিন। শ্রাবণ মানেই ঘোষণা ছাড়াই বৃষ্টি। তুমুল বৃষ্টি। শ্রাবণের বৃষ্টি বলে কথা। গাঢ় এবং গভীর এই বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা।
২০১১ সালের ২৯শে জুলাই কোনো ঘোষণা ছাড়াই শ্রাবণের এমনই এক পাগলা হাওয়া বয়ে গেল, ভাবতে গেলেই মন কাঁদে। কক্সাবাজার গিয়েছিল আবিদ। সমুদ্রে নেমেছিল। আর ফিরলো না। সেই থেকে আবিদ আর গান গাইলো না। আবিদ আর কথা বললো না। গান নিয়ে নতুন কোনো পরিকল্পনা করে না। শো করে না। আবিদ আর ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’ গাইবে না।
প্রতি বছর জুলাই আসে, সাথে শ্রাবণ আসে, আর একটা মৃত্যুবার্ষিকী আসে। প্রতিবছরেই আসে, পত্রিকায় খবর বের হয়, টেলিভিশনে, অনুষ্ঠানে স্মরণ করা হয়। কিন্তু নতুন একটা গানও আবিদ করে না।
মাত্র ২৫ বছর বয়সের মধ্যেই গান গেয়ে আবিদ আমাদের মুগ্ধ করেছেন। আমাদের প্রত্যাশা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। অথচ একটি দিনের ব্যবধানে এমন হয়ে গেল যে আমরা আর তার গান শুনতে পাবো না। তার গানগুলো শুনতে গেলেই মনে হয় সেদিন সন্ধ্যায় সাগরের সেই ঢেউটা না আসলেই কি হতো না? কার জন্য এমন হলো? কাকে দায়ী করবো আমরা।
অসহায়ের মতো নিয়তির কথাই বলবো শুধু। নাকি আবিদ সেদিন না গেলেই পারতেন এই বলে বলে বিলাপ করবো? কী ভাববো? মনকে কি কখনও সেটা বোঝানো যায়? নাকি বুঝিয়ে লাভ হয়?
আমি এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পাই না। আমার কাছে কোনো সান্ত্বনা বাণী নেই, অন্তত আবিদের বাবা-মা, আবিদের ছোটভাই বাঁধনের জন্য। আবিদের বাবা মিনা মিজানুর রহমান পেশায় একজন আইনজীবী হলেও মনেপ্রাণে একজন শিল্পী, গান তার নেশা। আপাদমস্তক একজন সংস্কৃতিকর্মী। সেখান থেকেই ছেলে আবিদের এই সংগীত জীবনের যাত্রা শুরু হয়েছিল। পুরো পরিবারেই তার ছায়া আছে। আবিদের মা রমা রহমান পেশায় শিক্ষক। কিন্তু শিল্পী হিসেবেই বেশি শনাক্ত করা যায় প্রতি মুহূর্তেই। শুধু আবিদ নয় তাদের ছেলে বাঁধনের কণ্ঠেও রবীন্দ্রনাথের গান। মোট কথা পুরো পরিবারেই আছে সংগীতের প্রতি প্রেম।
আজ আবিদের জন্য অনেকে কথা বলছেন। লেখা হচ্ছে পত্রিকায়, স্মরণিকায়। একটি কবিতার কথা আজ মনে পড়ছে। ‘সমুদ্রসংক্রান্তি’ নামে এই কবিতাটি বন্ধু কবি হেনরি লুইসের লেখা।
‘বিজ্ঞাপনের মতো সমুদ্র তার উচ্ছসিত লকলকে জলরাশি মেলে ধরে।
সমুদ্রের সন্তান নেই।
গর্ভ যন্ত্রনা কি তা সে বোঝেও না।
তার স্তন বন্ধ্যা।
আছড়ে পড়ে হ্যামিলনের বাঁশির গুপ্ত হামলা।
মাতৃগর্ভে জলরাশিতে বেশ কয়েকমাস সাঁতার কেটেছিলাম।
অথচ বড় হওয়ার সাথে সাথে তা ভুলে গেলাম?
সমুদ্র সত্যিই আপনার কি মায়ের চোখ নেই?
আপনি দয়া করে উগ্র প্রকৃতির জলরাশি হবেন না।
সমুদ্র আপনি হবেন শান্ত,ভদ্র।
আর আত্মজা তুমি হবে ধীর আর সাতারু’
এখন যতই দিন যাচ্ছে, যতই শ্রাবণ আসছে ততই মন খারাপের কাল আসছে। স্বজনরা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়ছি। কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না। জীবন তো সময়ের সাথে সাথে কর্তব্য নির্ধারণ করে দেয়।
এই কর্তব্য শুধু নিজের জন্য নয়। দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য বিন্দুমাত্র যদি ভাবতে যাই তো অনেক কাজ করার আছে, করার থাকে।
আমাদেরও করার আছে অনেক কাজ। দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য। একটি সাক্ষাৎকারে আবিদ বলে গেছে, ‘আমি গান করি দেশের মানুষের জন্য। দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোঁটানোর জন্য।
মাত্র ২৫ বছরের জীবনে অনেক কাজ সে করে গেছে। শুধু গান গেয়ে নয়। অনেক গানের সে সুর করেছে, অনেক গানের মিউজিক কম্পোজ করেছে। অনেক লিরিক লিখেছে। লিখেছে গল্পের বইও।
দেশের মানুষ আবিদকে মনে রেখেছে। মনে রাখে। খুলনায় আবিদ বেড়ে উঠেছে। সেখানেই শুয়ে আছেন। খুলনা আবিদের শহর। সেখানে তার নামে স্মৃতি সংসদ গড়ে উঠেছে। সেই স্মৃতি সংসদ স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন করে প্রতিবছর। খুলনার হাদিস পার্কে ঘোর বর্ষাতেও মানুষের ঢল নামে।
প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে এবছর থেকে আবিদ সম্মাননা দেয়া হচ্ছে। ২৭ জুলাই ২০১৯-এ প্রিয় তিমির নন্দীকে এই্ সম্মাননা দেয়া হলো। নাট্যজন মামুনুর রশীদ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ফায়েকুজ্জামান উপস্থিত ছিলেন। সংস্কৃতিকর্মী শিল্পী সাধন ঘোষ, আব্দুস সালামসহ অনেকেই অংশ নেন এই আয়োজনে।
মনে পড়ছে ২০১৪ সালের শিল্পী আবিদ উৎসবের কথা। সে বছরের সেই উৎসব শুধু সংগীতের উৎসব ছিল না। ছিল একটা সাংগঠনিক পরিকল্পনার অংশ। দ্বিতীয় দিনের সন্ধ্যার আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন সংগঠক, অভিনেতা ও নাট্যকার মামুনুর রশিদ এবং সংগীত সমালোচক অধ্যাপক করুনাময় গোস্বামী। (পরে প্রয়াত)
শুরুটা মানুনুর রশিদ করলেন। সন্ধ্যার মঞ্চে খুলনাবাসির সামনে একটা আহবান জানালেন, সহযোগিতার, যাতে করে খুলনাতেই গড়ে উঠতে পারে একটা বড় সংগীতভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। শিল্পী আবিদ মিউজিক কলেজের কথা বলছিলেন তিনি। এরপর ড.করুনাময় গোম্বামী আরও একধাপ এগিয়ে বললেন দক্ষিণবঙ্গের দীর্ঘ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে। এ অঞ্চলে একটি পুর্ণাঙ্গ সংগীত বিশ্ববিদ্যালয় হবার বাস্তবতা আছে। এজন্য সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।
মামুনুর রশিদ সেদিন অনেক বড় করে ভাবার জন্যই আমাদের অনুরোধ করেছেন। ড. গোম্বামী ব্যাখ্যাও করেছিলেন সেটা। একটা সংগীত বিশ্ববিদ্যালয় মানে শুধুই সংগীত নয়। পারফর্মিং আর্টের সবগুলো বিষয় এখানে থাকতে পারে। আর এটি হওয়া উচিত সম্পূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। তাই জমি সংগ্রহ থেকে শুরু করে অনেক কাজ করার আছে। অনেক কাজ। অবশ্যই সরকারেরও সদিচ্ছা থাকতে হবে। আর সাধারণ মানুষের, খুলনার রাজনীতিবিদদের মধ্যে যারা উপস্থিত ছিলেন সবারই অকুণ্ঠ সমর্থন লক্ষ করেছি সেদিন।
সেই হলো একটা নতুন স্বপ্নের বীজ বোনা। আবিদের নামেই নামকরণের প্রস্তাবও রাখা হলো সেদিনই। ‘শিল্পী আবিদ সংগীত বিশ্ববিদ্যালয়’
আবিদের নামটিই এখন আমার কাছে একটি সংগীতের নাম। তাই তার স্মৃতিকে ঘিরে আরেকটি স্বপ্নের যাত্রা শুরু হোক।
শুধু খুলনাবাসীর কথা ভেবে নয়। সারাদেশের বাস্তবতা বিবেচনায় একটি অসাস্প্রদায়িক চেতনার আগামী প্রজন্ম গড়ে তুলতে আমরা আশা করি মিউজিক স্কুল বা সংগীত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
শুধুই আবিদের গানের কথা বলে বলে, লিখে লিখে আবারও আমরা হয়তো আরেকটি বিষাদময় দিন পার করতে পারবো কিন্তু অনেক কিছু করার বাকি থেকে যায়। দেশের জন্য। দশের জন্য। আবিদের ভালোবাসাকে, আবেগকে বাঁচিয়ে রাখা সাথে মানুষের জন্য কিছু ভাবতে পারলেই সেটা সম্ভব। তাই যাদেরই সুযোগ আছে কোনো অবদান রাখার, তারা সবাই এগিয়ে এলে নিশ্চয়ই একদিন সম্ভব হবে একটি সংগীত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন। দক্ষিণের মানুষের শুধু নয় সারা দেশের মানুষের জন্য, নতুন প্রজন্মকে সংগীতমুখী, সংস্কৃতিমনা মানুষ হিসেবে তৈরি করতে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রাখবে আজকের এই স্বপ্নই। স্বপ্নের নাম ‘শিল্পী আবিদ সংগীত বিশ্ববিদ্যালয়’ একটি বড় স্বপ্নের নাম হোক আরেকটি সংগীতের নামে। কারণ আবিদ একটি সংগীতের নাম।
Leave a reply