বন্যা ও বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২২ জেলার সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের ৭০১ কিলোমিটার মহাসড়ক, আঞ্চলিক ও জেলা সড়ক। রেলপথ ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার। এসব সড়ক ও রেলপথ জোড়াতালি দিয়ে দ্রুত মেরামতের কাজ চলছে। মাঝে মাঝে বৃষ্টিতে ছেদ পড়ছে। ঈদের আগের কয়েকদিনে এসব সড়ক ও রেলপথ মেরামতের কাজ শেষ করা প্রায় অসম্ভব। এ অবস্থায় দু’দিন পর বুধবার থেকেই শুরু হচ্ছে পুরোদমে ঈদযাত্রা।
ভাঙাচোরা সড়ক ও দুর্বল রেলপথ দিয়ে চলা বাস-ট্রেনের গতির ওপর এর প্রভাব পড়বে। জোরে চললে বাড়বে দুর্ঘটনার ঝুঁকি। ফলে কমে যাবে বাস ও ট্রেনের গতি। এতে ভেঙে পড়তে পারে ট্রেন ও বাসের সিডিউল। যাত্রাপথে লাগবে অতিরিক্ত সময়। বৃষ্টি থাকলে সড়ক ও রেলপথে ঈদযাত্রায় দুর্ভোগ তীব্র হবে। ইতিমধ্যে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা, নড়বড়ে লাইন ও মেয়াদোত্তীর্ণ সেতু দিয়ে সর্বনিম্ন গতিতে ট্রেন চালানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এসব তথ্য জানিয়েছে।
জানা গেছে, বন্যা ও বৃষ্টি শুরুর আগেই সরকারি হিসাবে ৪ হাজার ২৪৫ কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়ক খারাপ অবস্থায় ছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৭০১ কিলোমিটার রাস্তা। সবমিলিয়ে প্রায় ৫ হাজার কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়কে সমস্যা রয়েছে। ঈদের সময় ঘনিয়ে আসার এসব সড়ক আপৎকালীন সংস্কার করা হচ্ছে।
এছাড়া ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে ঢাকা, জয়দেবপুর-টাঙ্গাইল ও রাজধানীর আবদুল্লাহপুর থেকে টঙ্গী হয়ে জয়দেবপুরসহ বিভিন্ন সড়কে উন্নয়ন কাজ চলমান। এসব সড়কে কোথাও কোথাও থেমে থেমে যানজট হচ্ছে, কোথাও ধীরগতিতে গাড়ি চলছে। এছাড়া শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ী এবং পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটে ফেরি পারাপারে বিঘ্ন ঘটায় যাত্রীদের বসে থাকতে হচ্ছে।
অপরদিকে শুধু রেলপথ ঝুঁকিতে নয়, রেলওয়েতে প্রায় ৮০ শতাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন ও কোচ দিয়ে এখনও ট্রেন চলছে। আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়া এসব ট্রেনে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই ভ্রমণ করেন যাত্রীরা। সংশ্লিষ্টরা জানান, ঈদে সড়ক ও রেলে যাত্রী চাপ কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। এর আগে মেরামত শেষ না হলে ও বৃষ্টি থাকলে ঈদযাত্রায় চরম ভোগান্তির শিকার হতে পারেন যাত্রীরা।
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলাম বলেন, সড়ক নেটওয়ার্ক নিয়ে বড় কোনো শঙ্কা নেই। তবে স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বিড়ম্বনা থাকবে। আগের মতো যাতায়াত স্মুথ (মসৃণ) হবে না, তবে সড়ক নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হবে না। তিনি বলেন, সব সড়কে গাড়ির গতি কম থাকবে না, কিছু জায়গায় গতি কম থাকবে, কিছু জায়গায় স্বাভাবিক থাকবে। প্রকৃতির ওপর কর্তৃত্ব চালানো যায় না- এটা মেনে নিতে হবে।
অপরদিকে ঈদের আগে যে সময় আছে, তাতে রেলওয়ের মেরামত করা প্রায় অসম্ভব বলে মনে করছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) মো. আনোয়ারুল হক জানান, ৭ আগস্ট থেকে ঈদযাত্রা শুরু হচ্ছে। এর আগেই জরাজীর্ণ এবং বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত রেলপথ মেরামত করতে হবে। মাঠপর্যায়ে শ্রমিক সংখ্যা বাড়িয়ে দ্রুত মেরামতের কাজ চলছে। কিন্তু, বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত লাইন মেরামত করতে হচ্ছে বিভিন্ন কৌশলে।
লাইন থেকে কোথায় পানি নেমে গেছে, কোথাও পানি নামেইনি। উভয় সংকটে আমাদের কাজ করতে হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত স্থানগুলো স্থায়ী মেরামত করতে হলে কয়েক মাসের প্রয়োজন। আমরা অল্প সময় পাচ্ছি, এ সময়ের মধ্যেই অস্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানগুলো মেরামত করছি। এসব স্থান দিয়ে সর্বনিম্ন গতিতে ট্রেন চালানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ঈদে ট্রেনে নির্ধারিত যাত্রীর তুলনায় ৩-৪ গুণ বেশি যাত্রী চলাচল করায় এবার আমরা শঙ্কায় ভুগছি। উনিশ থেকে বিশ হলেই যে কোনো বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ঈদে অতিরিক্ত যাত্রী বহনে বাস কোম্পানিগুলো ২৪ ঘণ্টাই ট্রিপ দিয়ে থাকে। দূরত্ব ভেদে প্রতিটি বাস দিন-রাতে অন্তত দুটি ট্রিপ দেয়। সে অনুযায়ী আগাম টিকিট বিক্রি করে। কিন্তু সড়কে যানজট ও ধীর গতি হলে ওই সিডিউল ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। এবার বন্যা ও বৃষ্টিতে এমনই আশঙ্কা করছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা। যদিও গত কয়েক ঈদে স্বস্তিতে যাত্রী বহন করেছেন তারা।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যা বলেন, এখন পর্যন্ত সড়কে ভাঙাচোরার কারণে ভোগান্তি হয়নি। তবে সামনের কয়েকটা দিনে বৃষ্টি হলে ভোগান্তি হতে পারে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, বন্যার কারণে অনেক সড়কের বিভিন্ন অংশে ছোট-বড় গর্ত তৈরি হয়েছে, ওইসব স্থানে গাড়ি খুব সাবধানে চালাতে হয়।
গতিও বেশি তোলা যায় না। ধীরগতিতে খুব সাবধানে গাড়ি চালাতে হচ্ছে। ঈদের সময় রাস্তায় গাড়ির চাপ বেশি থাকবে। তার আগে ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক মেরামত না হলে যানজটও তৈরি হতে পারে। অন্যদিকে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকবে।
জানা গেছে, বন্যায় ২২ জেলার ৭১০ কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত জেলার মধ্যে কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, লালমনিরহাট, জামালপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও চট্টগ্রাম অন্যতম। এসব সড়ক মেরামতের কাজ চলছে। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের ২৩টি টিম এসব কাজ মনিটরিং করছে।
এছাড়া স্থানীয় সরকার বিভাগের অনেক সড়কই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোনো সড়কে পানি জমে আছে। বন্যার আগে সড়ক ও জনপথ অধিদফতর এক সার্ভে রিপোর্ট প্রকাশ করে। ওই রিপোর্টে দেখা গেছে, দেশের ২১ হাজার কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়কের মধ্যে ৪ হাজার ২৪৫ কিলোমিটার রাস্তার অবস্থা ভালো নয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিবহন মালিক বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা কোনো মতে জোড়াতালি দিয়ে চলাচলের উপযোগী করা হচ্ছে। একটু বৃষ্টি হলেই তা আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। ভাঙাচোরা রাস্তার কারণে হেলেদুলে গাড়ি চলে। এসব সড়কে দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানো যায় না। অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটছে।
তিনি বলেন, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের মীরেরবাজার, পূবাইল, কালীগঞ্জ সড়কের অবস্থা ভালো নয়। চুয়াডাঙ্গা থেকে কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ, জামালপুর, নেত্রকোনা অনেক সড়ক ভাঙাচোরা। উত্তরবঙ্গের সড়কের অবস্থা খারাপ। টাঙ্গাইল ও রংপুরে বেশকিছু রাস্তা খারাপ অবস্থায় আছে। এমন অবস্থা থাকলে তা বিপজ্জনক হতে পারে বলে মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, যাত্রাপথে বেশি সময় লাগলে গাড়ি যথাসময়ে ঢাকায় ঢুকতে পারবে না। তখনই দেখা দেবে সিডিউল বিপর্যয়। আমরা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ সিডিউল বিপর্যয়ের ব্যাকআপ রাখি। কিন্তু এর বেশি হলেই বিপত্তি দেখা দেয়।
ট্রেন : এবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত রেলপথ রেলওয়ে সংশ্লিষ্টদের ভাবিয়ে তুলছে। অতিবর্ষণ বা বন্যায় নড়বড়ে রেললাইনের নিচের মাটি নরম হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বন্যার পানি পুরোপুরি নেমে না যাওয়ায় স্থায়ীভাবে কাজও করা যাচ্ছে না। গত বর্ষা মৌসুমে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে বিভিন্ন রেলপথের পাথর, স্লিপার ও ব্রিজ পানির তোড়ে ভেসে গিয়েছিল। মাইলের পর মাইল রেলপথ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। যা এখনও স্থায়ীভাবে মেরামত করা সম্ভব হয়নি।
এবারের বন্যায়ও পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে প্রায় সাড়ে ৩শ’ কিলোমিটার রেলপথের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বন্যার শুরুতেই ঘটেছে নানা দুর্ঘটনা। রাজশাহীর হালদাগাছি এলাকায় লাইন নড়বড়ে হওয়ায় একটি তেলবাহী ট্রেনের নয়টি বগি লাইনচ্যুত হয়। ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে প্রায় ২৮ ঘণ্টা। টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গায় পুংলী রেলসেতুর দুই পাশের মাটি দেবে যায়। এতে নয় ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে।
বন্যার কারণে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে অন্তত ১০টি ট্রেনের রুট পরিবর্তন করা হয়েছে। রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের জামালপুর-দেওয়ানগঞ্জ বাজার সেকশন, জামালপুর-তারাকান্দি সেকশন, সরিষাবাড়ী-বয়ড়া স্টেশন সেকশন লাইনে বন্যায় ডুবে যাওয়ায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। চট্টগ্রাম-দোহাজারি রেল সেকশনে বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
অপরদিকে রংপুর-সান্তাহার-পার্বতীপুর-দিনাজপুর-গাইবান্ধা রুটেও ক্ষতি হয়েছে। পশ্চিমাঞ্চলের বাদিয়াখালী রোড-ত্রিমোহিনী জংশন স্টেশনের মধ্যবর্তী স্থানে রেললাইনের ওপর প্রায় দেড় থেকে দুই ফুট পানি ছিল। এ পথে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে লাইনের। বন্যায় রংপুর-কাউনিয়া-সান্তাহার-বগুড়া-বোনারপাড়া-কাউনিয়া-লালমনিরহাট ও দিনাজপুর-সান্তাহার-বুড়িমারী-সান্তাহার-লালমনিরহাট সেকশনের বিভিন্ন স্থানের লাইন পানিতে তলিয়ে যায়। পাথর, মাটি, স্লিপারসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ভেসে যাওয়ায় লাইন মেরামত করতে হিমশিম খাচ্ছে সংশ্লিষ্টরা।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী আফজাল হোসেন জানান, বন্যায় পশ্চিমাঞ্চল রেলপথে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এখনও বিভিন্ন সেকশন লাইনে পানি রয়েছে। কোথাও কোথাও পানি নামলেও পুরো লাইন এবড়ো-খেবড়ো হয়ে গেছে। আমরা বন্যার মধ্যেই লাইন ঠিক রাখার জন্য বিভিন্ন কৌশলে কাজ করে আসছি। যেসব স্থানে পানি নেমে গেছে সেখানে দ্রুততার সঙ্গে মেরামত কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। প্রায় ৬০ কিলোমিটার রেলপথ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এসব স্থান অস্থায়ীভাবে মেরামত করা হচ্ছে শুধু ঈদযাত্রা ঠিক রাখার জন্য। অস্থায়ীভাবে মেরামত করা স্থান দিয়ে সর্বনিম্নগতিতে ট্রেন চালানোর জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। গতি কমিয়ে ট্রেন চালাতে গিয়ে সিডিউল বিপর্যয় হতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতিতে যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাটাই প্রধান কাজ।
পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ সুবক্তাগীন জানান, পূর্বাঞ্চলে বৃষ্টি ও বন্যায় রেলপথের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে আমরা ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। অতিরিক্ত শ্রমিক লাগিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে মেরামত কাজ শেষ করতে চাচ্ছি। ঈদে প্রতিটি ট্রেনই অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ নিয়ে চলাচল করে। অস্থায়ীভাবে মেরামত করা সেকশন দিয়ে ট্রেনের গতি কমিয়ে চালাতে হবে। ইতিমধ্যে মেরামত করা লাইনের মাটি এখনও নরম রয়েছে। নির্ধারিত গতিতে ট্রেন চালাতে গেলেও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
সূত্র: যুগান্তর
Leave a reply