মা-বাবা ও ভাইবোনদের সঙ্গে ঈদ করতে ঘরে ফিরতে শুরু করেছে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। আর এ সুযোগে ঈদ স্পেশাল সার্ভিসের নামে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার থেকে ঢাকা-বরিশাল নৌ-রুটের লঞ্চসহ অভ্যন্তরীণ রুটের লঞ্চগুলো ২০ ভাগ ভাড়া বাড়িয়েছে।
যদিও লঞ্চ মালিকদের দাবি ভাড়া বাড়ানো হয়নি। ঈদ উপলক্ষে সরকারি রেট কার্যকর করা হচ্ছে মাত্র। অপরদিকে জীবনহানির ঝুঁকিও বাড়ছে। ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ-তিনগুণ বেশি যাত্রী নিয়ে লঞ্চ ঘাট ছাড়লেও বিআইডব্লিইটিএ কর্তৃপক্ষ নীরব ভূমিকা পালন করছে।
জানা গেছে, সারা বছর রাজধানী থেকে দক্ষিণাঞ্চলগামী লঞ্চগুলোয় ডেকের ভাড়া ২০০ টাকা নেয়া হয়। আর সিঙ্গেল কেবিনের ভাড়া ৯০০ এবং ডাবল কেবিন ১৮০০ টাকা নেয়া হয়।
ভিআইপি কেবিনের ভাড়া প্রকারভেদে তিন-পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়। কিন্তু ঈদ এলেই সরকার নির্ধারিত ভাড়ার অজুহাত তুলে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়। এবারও সরকার নির্ধারিত রেটের অজুহাতে বৃহস্পতিবার থেকে ঈদ স্পেশাল সার্ভিসে ডেকের ভাড়া ২৫০ টাকা, সিঙ্গেল (এসি/নন-এসি) ১১০০ এবং ডাবল (এসি/নন-এসি) ২২০০ টাকা এবং ভিআইপি কেবিনের ভাড়া ৬-৭ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ঈদ উদযাপন করতে ঢাকা থেকে বরিশালে আসা প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা নামে এক লঞ্চযাত্রী জানান, দুই ধরনের রেট দিয়ে লঞ্চ যাত্রীদের হয়রানি করা হচ্ছে। প্রতি বছরই এভাবে প্রতারণা করা হয়। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল (যাত্রী পরিবহন) সংস্থার ভাইস চেয়ারম্যান ও সুন্দরবন লঞ্চের মালিক সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, ‘আমরা সরকার নির্ধারিত ভাড়ার বেশি নেই না। তবে স্বাভাবিক সময়ে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কম নিয়ে থাকি। ঈদের সময় সদরঘাট বা বরিশাল লঞ্চঘাটের এক প্রান্ত থেকে যাত্রী ছাড়াই ফিরতে হয়। তাই এ সময় সরকার নির্ধারিত ভাড়া নিয়ে থাকি।’
বিআইডব্লিউটিএ’র বরিশাল নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের যুগ্ম পরিচালক আজমল হুদা মিঠু সরকার বলেন, ঈদে ভাড়া বেশি নেয়া হয় না। তবে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বেশি নেয়া হয়। এরপরও সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কম নেয়া হচ্ছে। এরপরও কোনো অভিযোগ এলে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেব।
ঢাকা-বরিশাল নৌরুটে নিয়মিত চলাচলকারী এমভি সুরভী-৭ এর ধারণক্ষমতা এক হাজার ২০৫ জন। পারাবত-৭ এর ৭৫০ জন, পারাবত-২ এর এক হাজার পাঁচজন, কালাম খানের ৯০০, কামাল-১ লঞ্চের ৭১৫ জন এবং কীর্তনখোলা-২ লঞ্চের এক হাজার ১৩০ জন যাত্রীর ধারণক্ষমতা রয়েছে। ঈদে ধারণক্ষমতার কোনো বালাই থাকে না। লঞ্চে তিল ধারণের জায়গা থাকে না।
এ সময় দেখা যায় লঞ্চের ছাদ থেকে কেন্টিনের মধ্যেও যাত্রী নেয়া হয়। এমন অবস্থায় শত শত যাত্রীর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লঞ্চগুলো চলাচল করছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক মাস্টার জানান, ঈদের সময় বাড়তি যাত্রী চাহিদা থাকায় বেশি যাত্রী পরিবহন করা হয়। তবে কোনো কোনো সময় তা ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে চলে যায়। বেশি যাত্রী পরিবহন করা হলেও নিয়ম অনুযায়ী এসব নৌযানে যাত্রীদের জীবন রক্ষার সরঞ্জামাদি নেই। এমভি পারাবত-১১ লঞ্চের যাত্রী ধারণক্ষমতা এক হাজার ২৫ জন। ধারণক্ষমতা অনুযায়ী লঞ্চটিতে লাইফ বয়া থাকার কথা ২৫৩টি। কিন্তু ১১৬টি আছে। ২২টি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের মধ্যে ১২টি থাকলেও তিনটি বিকল। এমভি সুরভী-৭ লঞ্চের যাত্রী ধারণক্ষমতা ৮৯০ জন। লাইফ বয়া ২০০টির পরিবর্তে ১০৫টি আছে। ফায়ার বাকেট ১৮টির মধ্যে তিনটি বিকল। এ লঞ্চের কোথাও বালুভর্তি বাক্স দেখা মেলেনি।
সুন্দরবন-৭ লঞ্চে যাত্রী ধারণক্ষমতা ৯৯০ জন। এতে ১৫৩টি বয়া আছে। একই অবস্থা অন্য লঞ্চগুলোরও। প্রত্যেক যাত্রীর জন্য একটি করে লাইফ জ্যাকেট থাকার নিয়ম থাকলেও ২-৩টি লঞ্চে সামান্য কিছু রয়েছে। তবে অন্যসব লঞ্চে একটিরও খোঁজ মেলেনি। চারজন যাত্রীর জন্য একটি করে বয়া থাকার নিয়ম থাকলেও বাস্তবে তা নেই।
এছাড়া কোনো লঞ্চেই প্রয়োজনীয় অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র/ফায়ার বাকেট, পাম্প, ফাস্ট এইড বক্স, বালির বাক্স নেই। এমন অবস্থায় নিরাপত্তা সরঞ্জামাদি না থাকলেও লঞ্চগুলো ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ-তিনগুণ যাত্রী পরিবহন করছে। দক্ষ-মাস্টার সুকানির পরিবর্তে লস্কর দিয়ে মাঝে-মধ্যে লঞ্চ চালানোর অভিযোগ রয়েছে। ভরা বর্ষায় মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে এসব লঞ্চ চলাচল করলেও কর্তৃপক্ষ ম্যানেজ হয়ে নির্বিকার।
যাত্রীদের অভিযোগ, বাধ্য হয়েই তারা অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে লঞ্চে উঠছেন। ২০ ভাগ বেশি ভাড়া নেয়া হলেও কোনো ধরনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে না। কোনো ধরনের দুর্ঘটনা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপুল প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন যাত্রীরা।ৱ
সূত্র: যুগান্তর
Leave a reply