কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি :
কুড়িগ্রামে ভয়াবহ ভাঙন শুরু হয়েছে রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নে। গত ৩/৪ বছরের ভাঙনে এই ইউনিয়নের তিনভাগের দুইভাগ এলাকা তিস্তা নদীর করাল গ্রাসে বিলীন হয়ে গেছে। নদী তীরে ভাঙন কবলিতদের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠেছে আকাশ-বাতাস। পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে গত দেড় মাস ধরে জিও ব্যাগ ফেলানো হলেও ভাঙন ঠেকানো যায়নি।
গত এক সপ্তাহেই অর্ধ-শতাধিক বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙন কবলিতদের অনেকেই খোলা আকাশে রোদ-জলে ভিজে মানবেতর জীবন যাপন করছে।
এদিকে নদী তীর রক্ষা বাঁধ থেকে মাটি কেটে জিও ব্যাগ ভরানোর অভিযোগ উঠেছে পাউবোর শ্রমিকদের বিরুদ্ধে। ফলে সেই এলাকা দিয়ে গাড়ী-ঘোড়া চলাচল আপাতত বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়াও বাঁধের পঞ্চাশ ফুট পাশ থেকেই ড্রেজার দিয়ে বালু তোলা কতটুকু পরিবেশ বান্ধব তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
শুক্রবার সকালে সরজমিনে ভাঙন কবলিত চতুরা ও কালিরহাট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, খোলা আকাশে বেশ কয়েকটি বাড়ী পরে আছে। উদাস চোখে তাকিয়ে আছে লোকজন।
কালিরহাট এলাকার পঁচাশি বছরের বৃদ্ধা সোহাগী জানান, বাপ-মায়ে আদর করি নাম রাখছিল সোহাগী। স্বামীও চলি গেল; সেইসাথে সোহাগ-সুখও কাড়ি নিল তিস্তা নদী। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রোমন্থন করছিলেন তিনি পুরনো দিনগুলি। আর তার চোখের কোল বেয়ে ঝড়ে পরছিল অশ্রু।
তার ছেলে সামারু চন্দ্র রায়ের স্ত্রী পূর্ণিমা চন্দ্র রায় জানান, বাড়িঘর, জমিজমা, গাছপালা সব নদী কেড়ে নিল। চারদিন ধরে খোলা আকাশে পড়ে আছি। জায়গা না পেয়ে ঘরবাড়ী রাস্তায় ফেলে রেখেছি। ছেলে ইন্টারে আর মেয়ে ক্লাস সিক্সে পড়ে। তাদেরকে নিয়ে খুব বিপদে আছি। এখন কি করবো জানি না।
সাংবাদিক এসেছে শুনে নারায়ণ চন্দ্র বর্মন (৬৩) ছুটে এলেন। বললেন, বাবারে ২০ বার বাড়ী ভাঙছি। হামরা এ্যালা নি:স্ব হয়া গেছি। হামাকগুলার দেকপের কাঁইয়ো নাই। টেকা পয়সা নাই। জায়গাও কিনবার পাবার নাগছি না। হামরা পথের ভিখারি হয়া গেছি। সরকার হামারগুলার জন্য থাকবার জাগা করি দেউক।
চতুরা হংসধর বাঁধের মাথা এলাকার আহাম্মদ আলীর রাত কাটে নির্ঘুমে। ঘরের উঠোনে চলে এসেছে নদী। যে কোন মূহুর্তে বিলীন হয়ে যেতে পারে। ফলে আতংক আর উদ্বেগে সময় কাটছে তার পরিবারের লোকজনের।
তিনি জানালেন, বিদ্যানন্দ বাজার, তৈয়ব খাঁ, ডাংরা, ডাবুরহালান, ডারিয়া, হংসধর, কালিরভিটাসহ সাড়ে তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙছে তিস্তা নদী। গত এক সপ্তাহে ভেঙে গেছে চতুরার মনতাজ আলী, আমজাদ আলী, হাফিজুর রহমান, আলী মন্ডল, মমতাজ, আইজুল ও জমির হোসেনের বাড়ী।
হংসধর বাঁধের মাথা ও কালিরহাট এলাকার মকবুল, ইয়াকুব মিস্ত্রী, দীনবন্ধু রায়, নিপেন চন্দ্র রায়, সামাল চন্দ্র রায়, সুরেশ চন্দ্র রায়, সুধীর চন্দ্র রায়, নারায়ণ চন্দ্র রায়, প্রদীপ চন্দ্র রায়, সুকুমার চন্দ্র রায়, বাণেশ্বর চন্দ্র রায়, উপেন চন্দ্র রায়, লক্ষ্মীকান্ত চন্দ্র রায়, নিবাস চন্দ্র রায়, নিবারণ চন্দ্র রায়, সুবাস চন্দ্র রায়, সঞ্জয় চন্দ্র রায়, জয়ন্তী রায়, রঙমালা, সুবল, প্রফুল্ল, যতীশ, নবীন চন্দ্র রায়সহ আরও অনেকের বসতভিটা।
জয়ন্তী রানী কাঁদতে কাঁদতে বলেন, বাপুরে বাড়ী আগুনে পুড়লেও ভিটাটা থাকে। কিন্তু নদী খাইলে কিছুই থাকে না।
চতুরা এলাকার আজাদ, কামরুল জানান, এখানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিয়োজিত শ্রমিকরা বাঁধ নষ্ট করে মাটি কেটে জিও ব্যাগে ভরাচ্ছে। এখন এই রাস্তা দিয়ে গাড়ী-ঘোড়া চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। বিষয়টি নিয়ে শ্রমিকদের প্রশ্ন করা হলে তারা জানান, বাঁধ থেকে মাটি কেটে জিও ব্যাগ ভরাচ্ছি। আবার ড্রেজার দিয়ে সেটা পূরণ করছি। বাঁধ থেকে মাত্র ৫০গজ দুরেই বসানো হয়েছে ড্রেজার। তাই দিয়েই মাটি পূরণের কথা জানালেন তারা।
বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তাইজুল ইসলাম জানান, গত এক দশকে আমার ইউনিয়নের এক চতুর্থাংশ এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। আগে ভোটার ছিল ২৯ হাজার এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজারে। এগারটি মৌজার মধ্যে ৭টি মৌজা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বার হাজার ভোটার এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। এখানে জিও ব্যাগ ফেলানো হলেও ভাঙন ঠেকানো যাচ্ছে না। আমরা সরকারের কাছে এই এলাকার ভাঙন ঠেকাতে দ্রুত স্থায়ী কাজ চাই।
এ ব্যাপারে কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম জানান, আমাদের লোকজন কালিরহাট এলাকায় ভাঙন ঠেকাতে জিও ব্যাগ ডাম্পিং কাজ করছে। কেউ বাঁধ কেটে মাটি ভরার কাজ করে থাকলে সেটা আমাদের জানা নেই। আমরা চর থেকে নৌকায় বালু এনে কাজ করছি। আর ড্রেজারের কাজ এখন বন্ধ রয়েছে।
জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন জানান, ভাঙন কবলিতদের পুনর্বাসনের জন্য সরকার কাজ করছে। আমরা ফিজিবিলিটি দেখে স্থায়ীভাবে কর্মসূচি গ্রহণ করবো।
Leave a reply