লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি :
লক্ষ্মীপুরে রোগমুক্তির আশায় মসজিদ ধুয়ে পানি পান করাকে ধর্মীয় কুসংস্কার
ও বিদা’ত হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন আলেম-ওলামারা।
গত ২০ দিন ধরে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার চর মার্টিন ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ছেরাজ আমিন জামে মসজিদ ধুয়ে দিতে ভিড় জমান নারীরা। আধপাকা মসজিদটি ধোয়ার জন্য এখন পুরুষদেরও দেখা মিলে। রোগমুক্তি, পরীক্ষায় ভালো ফলাফল ও চাকরিসহ বিভিন্ন
নিয়ত পূরণ হওয়ার আশায় মসজিদ ধুয়ে দিতে ভিড় জমান তারা। অনেকে মনের আশা
পূরণের জন্য বোতলে করে পানি নিয়ে যান বাড়িতে।
তবে এ বিষয়ে লক্ষ্মীপুর তিতাঁখা জামে মসজিদের খতিব মো. হারুনুর রশিদ জানান, বায়তুল্লাহ শরীফ, মসজিদে নববী ও বায়তুল মুকাদ্দাস মসজিদ ছাড়া পৃথিবীর সকল মসজিদ একরকম। এছাড়াও মসজিদ ধুয়ে রোগমুক্তি কামনা নেহাত একটি কুসংস্কার। এটিকে বিদা’ত হিসেবে আখ্যা দেন এই আলেম।
সরেজমিনে দেখা যায়, ফজরের নামাজ শুরুর আগেই বিভিন্ন বয়সী কয়েকজন নারী এসে
মসজিদ ঘরের পাশে পুকুর ঘাটে দাঁড়িয়ে আছেন। কথাবার্তায় বুঝা গেল বহুদূর থেকে ছুটে এসেছেন তারা। ফজরের নামাজ শেষ হওয়ার পরপরই মুসল্লিরা মসজিদ থেকে বের হয়ে দ্রুত মসজিদ খালি করে দেন।
পরের দৃশ্যটা আরও অন্যরকম। দাঁড়িয়ে থাকা নারীরাসহ আরও অনেকেই জগ ও ছোট কলসি হাতে নিয়ে নেমে পড়েন মসজিদ ধোয়ার কাজে। পাশের পুকুর ও নলকূপ থেকে হিসেব করে তিন জগ কিংবা তিন কলসি পানি নিয়ে এসে ঢেলে দেন মসজিদের দরজা, বারান্দা এবং মেহরাবে। অনেকেই মসজিদ ধুয়ে গড়িয়ে পড়া কিছু পানি বোতলে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা দেন। কেউ কেউ দুই রাকাত নামাজও আদায় করেন। অনেককে মসজিদের দরজা, দেয়াল এবং মেহরাব ধরে কাঁদতেও দেখা গেছে। নারীদের পাশাপাশি কয়েকজন যুবককেও দেখা গেছে একই কাজে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, বহু বছর (আনুমানিক ১৯৫০ সাল) আগে মেঘনা নদী ভাঙতে ভাঙতে বর্তমান লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ এলাকায় পৌঁছায়। তখন ভবানীগঞ্জ এলাকার করিম বক্স জামে মসজিদটি নদী ভাঙনের কবলে পড়ে। পরবর্তীতে কমলনগর উপজেলার চর মার্টিন ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে নতুনভাবে স্থাপন করা হয়। মসজিদের নতুন স্থানটি জনৈক ছেরাজ আমিনের দখলে ছিল। তাই এর নামকরণ করা হয় ছেরাজ আমিন মসজিদ। মসজিদটি প্রথমে খড়ের ছাউনির থাকলেও পরে টিনের ছাউনি দেয়া হয়। অন্যান্য মসজিদের ন্যায় সাধারণ মসজিদ ছিল এটি।
কমলনগরের হাজিরহাট থেকে ছুটে আসা মধ্যবয়সী নারী জেবুন্নেছা জানান, তিনি মসজিদ ধোয়া কিছু পানি বোতলে ভরে নিয়েছেন। রোগ মুক্তির লক্ষ্যে বাড়িতে গিয়ে সেগুলো পান করবেন।
আব্দুর রহমান নামে এক শিক্ষার্থী জানায়, তার এসএসসি পরীক্ষা চলছে। মা-বাবার কথা মতো সে পরীক্ষার ভালো করার নিয়তে মসজিদ ধুয়েছে।
মসজিদ এলাকার বাসিন্দা সালেহা বেগম জানান, তরুণী থেকে বৃদ্ধা সকল বয়সের নারী বিভিন্ন নিয়তে এখানে আসছে। তবে এখন নারীদের পাশাপাশি পুরুষদেরও আসা শুরু হয়েছে।
বর্তমানে প্রতি শুক্রবার পূর্বের তুলনায় লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেকে মসজিদ ধোয়া পানি বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন খাওয়ার নিয়তে। অনেক নিয়ত করে নামাজও পড়ছেন। কেউ কেউ মসজিদের দেয়াল ছুঁয়ে কান্নাকাটি করছেন।
যারা একবার পানি দিয়ে মসজিদ ধুয়েছে তাদেরকে আসতে হবে পরপর তিন শুক্রবার।
গ্রামের শাহে আলম পূর্বের মুরব্বিদের বরাত দিয়ে জানান, তিনি শুনেছেন প্রায় ২০ বছর আগে বর্তমান ইমামের বাবা নাকি স্বপ্ন দেখেন- যেসব নারী শুক্রবার এ মসজিদ ধুয়ে দেবেন বিনিময়ে তার মনের আশা পূরণসহ রোগমুক্তি হবে। এ কথাটি কোনও এক নারীর কান হয়ে এখন হাজার হাজার নারীর কানে পৌঁছে গেছে।
এখন প্রতি শুক্রবারই শতশত নারী ছুটে আসছেন মনের আশা পূরণের জন্য।
স্থানীয় ইউপি সদস্য (মেম্বার) ও মসজিদ পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক
সাহাব উদ্দিন বলেন, যুগ যুগ ধরে লক্ষ্মীপুর সহ পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর নারীরা কাজটি করছেন। এতে সকলে ক্ষতিগ্রস্ত নয় উপকৃত হচ্ছেন। তাছাড়া শত-শত নারী মসজিদ ধুয়ে পানি নিয়ে যাওয়ায় স্থানীয় কোন মুসুল্লি ও সমাজের সমস্যা হচ্ছে না। তবে সকলের মনোবাসনা পূরণ হচ্ছে দাবি করে বলেন, এজন্য প্রতিনিয়ত মানুষদের ভিড় বাড়ছে মসজিদ প্রাঙ্গণে।
মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি আবুল খায়ের ও ইমাম মাওলানা জাহের মুন্সি
বলেন, দীর্ঘদিন থেকে একশ্রেণীর নারী-পুরুষরা মসজিদ ধুয়ে গড়িয়ে পড়া পানি পান করছেন। মসজিদে নামাজ আদায় ও টাকা দান করছেন বিভিন্ন নিয়তে। তবে কি ভাবে ও কবে থেকে এটি শুরু হয়েছে তা জানা নেই তাদের। তবে এটিকে বিদা’ত হিসাবে কয়েকবারই উপস্থাপনা করা হয়েছে, বুঝানো হয়েছে পানি নিতে আসা লোকদের। দূর-দূরান্ত থেকে আসা মানুষজন তাদের বাঁধা উপেক্ষা করে কাজটি করে যাচ্ছেন বলে দাবি করেন তারা।
জানতে চাইলে কমলনগর হাজিরহাট হামেদিয়া ফাজিল ডিগ্রী মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা যায়েদ হোসেন ফারুকী বলেন, মক্কা, মদিনা এবং বায়তুল মোকাদ্দাসের মতো তিনটি মসজিদ বাদে আল্লাহর কাছে পৃথিবীর সকল মসজিদের গুরুত্বই সমান। সুতরাং কোন একটি বিশেষ মসজিদকে নিয়ত করে ধুয়ে দেয়া বিদা’ত হবে। তিনি মুসলমানদের এ রকম কাজ থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করেন।
চর মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ইউসুফ আলী বলেন, বিষয়টি তিনি জানেন না। তবে এরকম কাজ তার দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকায় হয়ে থাকলে সেটি বন্ধ করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে লক্ষ্মীপুর জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. আব্দুল গফফার বলেন, মসজিদ ধুয়ে গড়িয়ে পড়া পানি পানে রোগমুক্তি সম্ভব নয়। বরং ময়লা পানি পান করলে ডায়রিয়া, আমাশয় সহ পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য গুজবে কান দিয়ে ময়লা পানি পান করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান এই কর্মকর্তা।
এদিকে নিয়ত করে মসজিদ ধোয়াকে ধর্মীয় কুসংস্কার ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কাজ আখ্যা দিয়ে তা বন্ধ করতে প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন স্থানীয় মুসল্লিরা।
Leave a reply