মুরশিদুজ্জামান হিমু
একরকম সম্মোহনী ক্ষমতা নিয়ে জন্মানো, বলা যায় ক্ষণজন্মা। আশির দশকের শুরুতে যখন ভেঙে গেল অনেকেরই পছন্দের ব্যান্ড হয়ে ওঠা ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’, তার সাথে ভাঙলো হাজারো তরুণের মন। ততদিনে গৌতম চট্টপাধ্যায়, তাপস দাসদের দেখে গিটারে মজেও গেছে অনেকে। কিন্তু ভাঙা-গড়ার খেলা যে নিয়তি।
গানের দল ভাঙলেও গান থামেনি। নীরবে-নিভৃতে গান করে গেছেন মহীনের ঘোড়ারা। পরবর্তীতে যদিও আবার ঘটা করে ফিরেছেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়। সে গল্পটা বলা যাক।
সালটা ১৯৯৫। ততদিনে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে মহীনের ঘোড়াগুলির গান। তাই ভক্তদের ভালোবাসা উপেক্ষা করাটাও বেশ কঠিন। অনেকের অনুরোধেই আবারও ফিরে আসে ব্যান্ডটি। তবে, এবার শুধু নিজেরা নয়, এক ঝাঁক নতুন মুখকে পরিচয় করিয়ে দেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়। কলকাতা বইমেলায় বের হয় ‘আবার কুড়ি বছর পরে’ অ্যালবামটি। এটা মহীনের ঘোড়াগুলির অ্যালবাম নয় ঠিক, এটা তাদের সম্পাদিত অ্যালবাম। ওই রেকর্ডে গান গাওয়ানো হয় ‘লক্ষ্মীছাড়া’, ‘ক্রসউইন্ডস’, ‘গড়ের মাঠ’র মতো ব্যান্ড বা সুরজিত চট্টোপাধ্যায়দের মতো শিল্পীকে। পরবর্তীতে যারা নিজ নামেই পরিচিত হয়ে উঠেছে। অ্যালবামটিতে মোট আটটি গান ছিল। যেগুলোর মধ্যে ‘পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে’, ‘কথা দিয়া বন্ধু ফিরা না আইলা’, ‘আমি ডান দিকে রইনা’, ‘পড়াশোনায় জলাঞ্জলি’ এখনও তুমুল জনপ্রিয়।
পরের দু’বছরও, অর্থাৎ ১৯৯৬ ও ৯৭ সালে বের হয় মহীনের ঘোড়াগুলি সম্পাদিত দ্বিতীয় ও তৃতীয় অ্যালবাম ‘ঝরা সময়ের গান’ ও ‘মায়া’। এক বছর বিরতি দিয়ে চতুর্থ সম্পাদিত অ্যালবাম ‘ক্ষ্যাপার গান’ বের হয় ১৯৯৯-তে। ওই বছরই বাংলা জীবনমুখী গানের ’আদিস্রষ্টা’ গৌতম চট্টোপাধ্যায় চলে যান না ফেরার দেশে। আপাতদৃষ্টিতে সমাপ্তি ঘটে গানের সফল ও ব্যতিক্রমী একটি ধারার।
গানের সহজিয়া বিশ্লেষণ :
এটা বলার অবকাশ রাখে না, গানে যতটা না প্রেম-ভালোবাসার কথা বলেছে মহীনের ঘোড়াগুলি, তার চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে বিপ্লবের কথা। একেকটি গানের পেছনেও রয়েছে বিপ্লবের লম্বা ইতিহাস। একটির গল্প বললে বোধহয় পরিষ্কার হবে বিষয়টি।
‘‘কথা দিয়া বন্ধু ফিরা না আইলা
এ কেমন কথা, হায় কি দশা!
কানে বাজে তোমার কথা, বুকে বাজে তাই ব্যাথা
কানের কথা বুকের ব্যাথা হইয়া
আমার প্রাণে জাগায় যে হতাশা
হায়, হায়, সব হারাইয়া কান্দি তো।
আশার ছলতায় ভুইল্যা গিয়া আজ পথে বসিলাম গো।
কবে তুমি ফিরা আসিবা বন্ধু রইলাম তার আসায়। হায় দুরাশা।”
এই গানটি শুনলে যে কেউ ভাবতে পারেন, নিতান্তই বুঝি প্রেম-বিরহ থেকে লেখা একটি গান। কিন্তু আদতেই কি তাই? মহীনের ঘোড়াগুলি ব্যান্ডের সদস্য তাপস দাস এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন এই গানটির পেছনের গল্প।
ষাটের দশকে গৌতম চট্টোপাধ্যায় অন্য একটি ব্যান্ডে বাজাতেন। রাজনীতি সচেতন এই ব্যক্তি কীভাবে যেন জড়িয়ে যান নকশাল আন্দোলনের সাথে। তখন গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের সাথে যারা রাজনীতি করতেন, তাদের অনেকেই গ্রেফতার হন। একদিন মায়ের অসুস্থতার খবর শুনে বাড়ি এলেন তিনি। কথাটা পুলিশের কানে যেতে সময় লাগলো না। ওই রাতেই গ্রেফতার হলেন মহীনের ঘোড়াগুলির অন্যতম এই প্রতিষ্ঠাতা।
জেল জীবনে অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা হলো গৌতমের। দেখলেন কীভাবে নীতিবিচ্যুত হলেন কমরেডরা। বলা যায়, একেকটি সেলের সাথে সে সময় পুলিশ ইচ্ছা করেই অবিশ্বাসের একটি সম্পর্ক তৈরি করতে চাইছিল। যেটা তারা সফলভাবে করলও।
আশা-নিরাশারা দোলাচলে তখন গৌতম চট্টোপাধ্যায়। কি হবে বিপ্লবের? কোন দিকে তার গন্তব্য? এই ভেবে অস্থির তিনি। কিন্তু বিশ্বাস ছিল, একদিন ঠিক পথেই ফিরবে বুকে ধারণ করা ‘বিপ্লব’। লিখে ফেললেন, ‘কথা দিয়া বন্ধু ফিরা না আইলা…’। মূলত বিপ্লবের প্রতি প্রেম থেকে গানটি লেখা।
আরেকটি গানের কথা বলা যাক।
‘‘পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে
স্যাটেলাইট আর ক্যাবলের হাতে
ড্রইংরুমে বোকা বাক্সতে বন্দী…
ঘরে বসে সারা দুনিয়ার সাথে
যোগাযোগ আজ হাতের মুঠোয়
ঘুচে গেছে দেশ কাল সীমানার গণ্ডি…’’
দেখুন অনেক বছর আগেও কিভাবে চিন্তা করেছিলেন গীতিকার। ধীরে ধীরে টেলিভিশন বা ‘বোকাবাক্স’ আমাদের গ্রাস করে ফেলছে, তা অনেক আগেই ধরা পড়েছিল ‘গৌতম রাডারে’। এই গানে তাদের নৈতিক সঙ্গীত দর্শনেরও উদাহরণ আছে। এই অ্যালবামের সাথে প্রকাশিত বুকলেটে গৌতম লিখেছিলেন,
‘‘এই আকাশফোড়া টিভি-এন্টেনা, এই স্যাটেলাইট, এই ক্যাবল, এই বোকাবাক্সে বন্দী ছোট পৃথিবীতে কী গান গাবো আমি? কি শোনাবো? তোমার আমার ফারাকের এই নয়াফন্দিতে শোনাবো কোন গান?’’
গানে গানে যে মহীনের ঘোড়াগুলি বা গৌতম চট্টোপাধ্যায় অনেক কথা বলেছেন, তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক- আড্ডায় খালি হয়েছে অনেক চায়ের কাপ। যেমন এ গানটির কথাই যদি বলি,
‘‘ আশায় আশায় বসে আছি
ওরে আমার মন
কখন তোমার আসবে টেলিফোন।
কালা যখন তখন করো ডায়াল
বুঝি না ছাই তোমার খেয়াল
তোমার আমার এই যে দেয়াল
ভাঙবে রে তখন,
তখন ভাবি আসবে টেলিফোন।’’
‘কালা যখন তখন করো ডায়াল’ এই লাইনে ‘কালা’ শব্দটি কেন ব্যবহার করেছিলেন গৌতম? তিনি কি টেলিফোনকে একালের কৃষ্ণের বাশি হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন? নাকি অন্যকিছু। এ নিয়ে কলকাতার শ্রোতা সমাজে বাক্যবিনিময় হয়েছে দীর্ঘদিন।
অর্থাৎ বলা যায়, লাখো ভক্ত-শ্রোতার মনিকোঠায় পৌঁছানোর যথোপযুক্ত অসংখ্য কারণ রেখে গেছে মহীনের ঘোড়াগুলি। তাদের গানগুলো এমন কোন ইন্দ্রিয়-তে আচড় কাটে, যা আপনি মনে রাখতে বাধ্য। কোন গান যদি হৃদয় গ্রাসের ‘নয়াফন্দি’ আটতেই থাকে, থাক না। ক্ষতি কী?
যমুনা অনলাইন: এমএইচ/টিএফ
আগের পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুন:
Leave a reply