গেল দশ বছরের ব্যাংকিংখাতে ঋণ বেড়েছে ৩১২ শতাংশ। অথচ খেলাপী ঋণ বেড়েছে ৪১৭ শতাংশ । গড়ে প্রতি বছর প্রায় ৯ হাজার ৪’শ কোটি টাকা করে খেলাপী ঋণ বেড়েছে। ট্রান্সপারেন্সী ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি গবেষণায় এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
ব্যাংকিং খাতের খেলাপী ঋণ নিয়ন্ত্রণসহ সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে বলেও জানায় টিআইবি। ২০০৯ সালে ব্যাংকিংখাতে খেলাপী ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে বেড়ে তা হয় ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। ঋণ বৃদ্ধির চেয়ে খেলাপী ঋণ বৃদ্ধি আশংকাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় খাদের কিনারায় ব্যাংক খাত। ব্যাংকের তথাকথিত মালিকরা নিজেদের নামে ঋণের কৌশলে ঋণ নিয়েছে। এই লুণ্ঠনকারীদের চাপে বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না বলেও জানান টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে ২০০৯ সালের শুরু থেকে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়কালে বছরে গড়ে নয় হাজার ৩৮০ কোটি টাকা ঋণখেলাপি হয়েছে। অর্থাৎ এই সময়কালে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় ৪১৭ শতাংশ। ঋণখেলাপিদের অনুকূলে বার বার আইন সংশোধন ও নীতি প্রণয়ন ব্যাংকিং খাতকে ঋণখেলাপি বান্ধব করেছে এবং খেলাপি ঋণকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছে, যা নিয়মিত ঋণ গ্রহীতাকেও খেলাপি হতে উৎসাহিত করছে।
সংবাদ সম্মেলনে ঋণখেলাপি হওয়া এবং তা আদায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বল তদারকি ব্যবস্থার সমালোচনা করে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে সুস্থ ও নিরাপদ ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় ১০ দফা সুপারিশ প্রদান করে টিআইবি।
আইনিভাবেও ব্যবসায়ী ও ব্যাংক স্বার্থসংশ্লিষ্ট ক্ষমতাধর ব্যক্তিবর্গের প্রভাবে ব্যবসায়ীদের অনুকূলে আইন পরিবর্তন এবং নানাভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীন নীতি ও বিধি-বিধান প্রণয়নে হস্তক্ষেপ করা হয়। যেমন: ব্যাংক কোম্পানি আইন- ১৯৯১ এর ধারা সংশোধনের মাধ্যমে একই পরিবার থেকে দুই জনের পরিবর্তে চার জন পর্যন্ত পরিচালক রাখার বিধান করা হয় এবং পরিচালকের মেয়াদ পরপর দুইবারে সর্বোচ্চ ছয় বছরের পরিবর্তে পরপর তিনবারে সর্বোচ্চ নয় বছর থাকার বিধান কিছু পরিবারের হাতে ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাবে চেয়ারম্যান বা পরিচালনা পর্ষদ নিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করা হয় এবং অনুগত প্রধান নির্বাহী নিয়োগ দেওয়া হয়। এছাড়া, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী নিয়োগেও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শ উপেক্ষা করা হয়। এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলোর দৃষ্টান্ত উপেক্ষা করে বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্ষদে তিনজন সরকারি কর্মকর্তা এবং দুইজন সাবেক আমলা রাখা হয়েছে- যা পরিচালনা পর্ষদের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরোপের ঝুঁকি সৃষ্টি করে।
গবেষণায় প্রাপ্ত পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে সুস্থ ও নিরাপদ ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় ১০ দফা সুপারিশ করেছে টিআইবি।
উল্লেখযোগ্য সুপারিশগুলো হলো- ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ ও ব্যাপক অনিয়মে জর্জরিত ব্যাংকিং খাত সংস্কারের জন্য এ খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন করতে হবে, ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬ ও ৪৭ ধারা সংশোধন করে বাংলাদেশ ব্যাংককে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির পূর্ণ ক্ষমতা দিতে হবে, নিয়োগ অনুসন্ধান কমিটির গঠন, দায়িত্ব-কর্তব্য ও নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনাসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সদস্য, গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ ও অপসারণ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট লিখিত নীতিমালা করতে হবে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে তিনজন সরকারি কর্মকর্তার স্থলে বেসরকারি প্রতিনিধির সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে, ব্যাংক সংশ্লিষ্ট আইনসমূহে আমানতকারীর স্বার্থ পরিপন্থী ও ব্যাংকিং খাতে পরিবারতন্ত্র কায়েমে সহায়ক সকল ধারা সংশোধন/বাতিল করতে হবে, রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকসহ সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগে অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে একটি প্যানেল গঠন করে সেখান থেকেই বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগের বিধান করতে হবে, রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তিদের ব্যাংক পরিচালক হওয়া থেকে বিরত রাখার বিধান করতে হবে এবং ব্যাংক পরিচালকদের ঋণ বাংলাদেশ ব্যাংকের সরাসরি নজরদারির মাধ্যমে অনুমোদনের ব্যবস্থা রাখতে হবে, ব্যাংক পরিদর্শনের সংখ্যা ও সময়কাল বৃদ্ধি, প্রত্যক্ষভাবে পরিদর্শন কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভাগসমূহের শূন্য পদসমূহ অবিলম্বে পূরণ, পরিদর্শন প্রতিবেদন যুক্তিসংগত সময়ের মধ্যে সমাপ্ত ও এর সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে এবং পরিদর্শনে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা পরিদর্শন দলকে দিতে হবে, তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি ও বাস্তবায়নে সংঘটিত অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে ইত্যাদি।
Leave a reply