মঞ্জুরুল ইকরাম:
গরীব এই দেশে হতাশার বর্তমান ও আশার ভবিষ্যত আমাদের সাধারণ জীবনেই একত্রে আসতে পারে ইচ্ছে পূরণের আমেজের মধ্যে। হিমুর কাজ আদতে তাই। এই সিরিজটা ইচ্ছাপূরণের গল্প। হিমুর কথা ও কাজ সবই কমিক। যৌক্তিক কারণ ছাড়াই ইচ্ছেপূরণ ঘটে এই সিরিজে। বিভিন্ন গল্পে যেমন মহাপুরুষদের আধ্যাত্মিক ক্ষমতাবলে অনেক কিছু ঘটে যায় তেমনি আমাদের পরিচিত ঢাকা শহরের অতুলনীয় পরিচয় দেয়া এই সিরিজে তাই ঘটে। হিমু ছাড়া ঢাকার এমন বিস্তৃত জীবন্ত বর্ণনা আর কারো সাথে কোথাও হেঁটেই পাওয়া যায়নি বোধহয়। হিমু কোনো অস্বাভাবিক চরিত্র না। অসংসারী মানুষের প্রতি সংসারী মানুষের স্মরণাতীতকাল থেকে যে আকর্ষণ, হিমুর জন্য আমরা তাই বোধ করি। হিমুর প্রধান গুণ তার আসক্তিহীনতা। সংসারের মায়া এড়িয়ে, আরো বৃহৎ সংসারে জুটে গিয়ে সংসারলিপ্ত মানুষের হাঁড়ির খবর, নাড়ির খবর পাওয়া সম্ভব। সেও তাই নিয়ে আসে। হিমুর এই বৃহৎ সংসারে ফকির, মাদকাসক্ত, পুলিশ, সরকারি কর্মচারি, কোর্টকাছারি, বড়লোক ও শীর্ষ সন্ত্রাসী সবই আছে। আছে নিষ্পাপ মানুষ বলতে কী বোঝায়- এর মতো জটিল প্রশ্নের নতুন সংজ্ঞায়ন।
মনে পড়ে, ‘হলুদ হিমু কালো র্যাব’ রচিত ও প্রকাশিত হয়েছিল বাংলাদেশের এক রাজনৈতিক সঙ্কটের মুহূর্তে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের আধিপত্যে যখন মুখ খোলাই দায় তখন সমাধান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল ‘হাসি’। বাখতিনের মতো তাত্ত্বিকেরা দেখিয়েছেন, ক্ষমতার জমাট স্তুপ যখন নিপীড়নের ভয়াবহতায় বিপুল জনতাকে স্তব্ধ করে দেয় তখন হাসি আবির্ভূত হতে পারে মারণাস্ত্রের মতো। হয়তো এর আবেদন সাময়িক, কিন্তু একবার এ ধরনের তরলীকরণ সম্পন্ন হলে ক্ষমতার অন্ধকারকে আগের দশায় ফিরিয়ে নেয়া কঠিন হয়ে যায়। যে কর্মকাণ্ডকে অনেকেই বলে থাকেন ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস’ সেটিকে হাস্যকর কায়কারবারের সমষ্টি হিসেবে দেখিয়ে এবং সংশ্লিষ্ট এজেন্টদের লাফিং স্টক বানিয়ে হিমুর হাত দিয়ে হুমায়ূন আহমেদ পালন করেছেন রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। এই বইটিকে বাংলা স্যাটায়ার সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত লিস্টে অনায়াসে আনা যায়। হুমায়ূন আহমেদের বই বলে তেমন কেউ ভাবেনি সম্ভবত। তাছাড়া হুমায়ূন সজ্ঞানে কখনোই বিপ্লবীর ভূমিকা পালন করেননি। কেবল র্যাব সমর্থক মধ্যবিত্তকে ঠাট্টার বিষয় বানিয়েছেন। পাশাপাশি লুকিয়ে থাকা অপরাধী ধরার ক্ষেত্রে র্যাবের সাফল্য বয়ান করে পালন করেছেন চিরাচরিত লিবারেল ভূমিকা।
হুমায়ূনের এই উদারনৈতিকতাই হিমুর ভিত্তি। আমরা দেখি, হিমুর অবস্থান তাবৎ মৌলবাদিতার বিরোধী। যার কাজ সামাজিক জীবনযাপনের সকল লজিককে বিপর্যস্ত করে দেয়। মধ্যবিত্তের যাপনকে করে হাস্যকর। তাই হিমু যেন হুমায়ূনের লেখকসত্ত্বার অ্যান্টিথিসিস। তবে ভারি ভারি কথা যাই বলা হোক না কেন, হুমায়ূনের গুরুত্বপূর্ণ ও সিরিয়াস সকল রচনাই পড়া হতে পারে স্রেফ কাহিনী হিসেবেই। দুর্দান্ত কাহিনিকার হিসেবে তিনি কাহিনীর অনুসরণে কোনো বাধা তো দেনই না, উল্টো প্রলুব্ধ করেন সেই পথ ধরেই এগুতে। তাই প্লট, ইমেজ বা গভীর চিন্তায় না ঢুকেই আরাম করে পড়া হয়ে যায় তার রচনা। জাতীয়তাবাদ, পশ্চিমা দর্শন, আধুনিকতা, মার্ক্সবাদ, নারীবাদ, গরীবের অবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি ম্যানুয়াল বর্গগুলো আগে থেকে নিয়ে কোনো কারবার হুমায়ূন করেননি। কলোনিয়াল মনস্তত্ত্বের প্রভাবে আমাদের শিক্ষিত পাঠকেরা সাহিত্যে নিজের চেহারা দেখার চেয়ে এ ধরনের উঁচু ভাব দেখতেই পছন্দ করেন। এসব নেই মানে সেই টেক্সট সিরিয়াস কোনো ব্যাপার না।
লোকে ফ্যান্টাসি পছন্দ করে। কারণ তাদের মনোভূমিতে বিদ্যমান ফ্যান্টাসিকে তারা লেখায় দেখতে চায়, লেখার সাথে নিজের ফ্যান্টাসি মেলাতে চায় এবং ফ্যান্টাসির নতুন উপাদান খুঁজে পেয়ে তাতে বুঁদ হয়। হুমায়ূন অনন্য। তিনি এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্যমান সাধারণ বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করে তার অনুকূলে ফ্যান্টাসি রচনা করেছেন। সাহিত্যিক হিসেবে সেই রহস্যগাঁথার দিয়েছেন নতুন কাঠামো। যেমন, শার্লক হোমসের লেখক আনকোরা নতুন ছক নিয়ে এসেছিলেন বলেই তিনি বড় লেখক। তার অনুকরণে সত্যজিৎ রায় ফেলুদা বানিয়েছেন। সেই হিসাবে সত্যজিৎ এই ঘরানায় মাইনর লেখক। আর হুমায়ূন করেছেন এখানে বড় লেখকের কাজ। জনগোষ্ঠীর সাইকি আবিষ্কারের চেয়েও, সম্পূর্ণ নতুন রূপকল্প নির্মাণে। মিসির আলি, হিমু, সাইফাই, ফ্যান্টাসি- হুমায়ূনের ক্ষেত্রে উদাহরণের শেষ নাই।
হুমায়ূনের ধরনটা মূলত এইসব দিনরাত্রির গল্পটাই। এমন বহু রচনাই ঢাকার মধ্যবিত্ত শ্রেণির দিনরাত্রির ইতিবৃত্ত। নিজ অস্তিত্বের সম্প্রসারণ হিসেবে নাগরিক শিক্ষিত মধ্যবিত্তের দৈনন্দিনতাকে আবিষ্কার করতে পারার বিপুল সাফল্যই হুমায়ূনের নজিরবিহীন জনপ্রিয়তার কারণ। এর মধ্যে তৈরি করেন আবেগঘন মায়ার জগত। সামাজিক সম্পর্কের নিরাসক্ত লেনদেনের অবজেকটিভিটি থেকে এক হেঁচকা টানে সবাইকে নিয়ে ফেলেন প্রচণ্ড তরল আবেগী ভূমিতে। সেই ন্যারেটিভ আবেগধর্মী, তবে আবেগসর্বস্ব না। হুমায়ূনের কাছে আবেগ শুধু মানুষের নিয়ন্ত্রক শক্তিই না বরং ক্ষুধা ও যৌনতার মতো প্রতিষ্ঠিত বর্গগুলোর তুলনায় রীতিমতো শক্তিশালী। ‘অন্যদিন’ উপন্যাসে মেসবাড়িতে যারা থাকেন তাদের মধ্যে বিচিত্র টানাপোড়েন আর ঝগড়া বিবাদ ছিল। বিশুদ্ধ এক পারিবারিক আবহ ছিল। বারবার বলা হয়েছে, এখানে শিকড় গজিয়ে গেছে। তাই কেউ না খেতে পেয়ে চলে যাচ্ছে, কিন্তু যেতে সায় দিচ্ছে না মন। কেউ সরকারি বাসা পেয়ে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে কিন্তু অনুভব করছে পিছুটান। ব্যক্তিগত ঝগড়াবিবাদ ভুলে মেস মেম্বারের সমর্থনে রীতিমতো ঝগড়া করছে তারা ম্যানেজারের বিরুদ্ধে। এই সম্পর্ক বিনিময়নির্ভর না। পুরোটাই আবেগনির্ভর। এভাবে ছোট ছোট চরিত্রকে একাকার করে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করেন হুমায়ূন, যাতে জীবনটাকে তুলনামূলক সহনীয় মনে হয়।
এই মনোচর লেখককে নিয়ে অধ্যাপক মোহাম্মদ আজমের বইটি পড়ে মনে হওয়া স্বাভাবিক, একজন সাহিত্যিকের মূল্য নিরূপণ তার পাঠকের উপরও নির্ভর করে। দৈনন্দিনতার ভাঁজে ভাঁজে যে মানুষ নিত্য আবিষ্কার করে চলে ফ্যান্টাসির জগত, তাকে পাঠ করার জন্য পুরনো বর্গগুলো অপ্রাসঙ্গিক। পাঠকের জন্য তার অধিকাংশ রচনাই আসলে ফ্যান্টাসির নিমন্ত্রণ। তিনি নিজে অবশ্য ম্যাজিক বলতে ভালোবাসতেন। ‘বল পয়েন্টে’ বলেছিলেন, তিনি বাস করেন ম্যাজিকের জগতে। ছোট্ট নিষাদ যখন হাসে, সেই হাসিতে ম্যাজিক। যখন তার মা গান করে, সেখানেও ম্যাজিক। তিনি যখন চরিত্র আঁকেন, সেখানেও ম্যাজিক। কথা তাই সর্বৈব সত্য। ফ্যান্টাসি আর জীবন যেখানে সমরূপ হয়ে যায়, সেখানে সৃষ্টি হয় অনিন্দ্য সুন্দরের। তাই গরীব ও নৈরাজ্যের এই জনপদে ইচ্ছেপূরণের ম্যাজিক হাতে হুমায়ূনের মতো আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন কোনো হিমু আর কখনোই আসেনি।
তথ্যসূত্র: হুমায়ূন আহমেদ: পাঠপদ্ধতি ও তাৎপর্য (মোহাম্মদ আজম)
Leave a reply