বিতর্কিতরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ছাত্রলীগের কমিটিতে, ব্যাপক সমালোচনা

|

ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া জেলা ছাত্রলীগের কমিটিতে স্থান পাওয়া মেহেদী মিশু ও আলমগীর হোসেন উভয়েই বিবাহিত।


স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া:


মেয়াদ শেষ হওয়ার প্রায় ৩৩ মাস পর গঠন করা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে ঠাঁই পেয়েছেন সাম্প্রদায়িক হামলা-মামলা, মাদক ও অস্ত্র মামলার আসামিরাও। বিষয়টি নিয়ে জেলা জুড়ে চলছে তুমুল আলোচনা ও সমালোচনা। অভিযোগ উঠেছে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে আসামিদের পদ দেয়া হয়েছে।

জেলা ছাত্রলীগের বিতর্কিত কমিটি সংশোধনের দাবিতে বিক্ষোভ করেছে পদবঞ্চিত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। পাশপাশি তারা ৭ দিনের আল্টিমেটামও প্রদান করেছে। অভিযোগ উঠেছে, জেলা ছাত্রলীগের কমিটিতে বিভিন্ন মামলার আসামি, বিবাহিত ও অছাত্রদের পদ দেয়া হয়েছে।

২০১৬ সালের অক্টোবরে নাসিরনগরের আলোচিত সাম্প্রদায়িক হামলার মামলার আসামি ফারদিন তাহের রাহুল পেয়েছেন উপ-ত্রাণ ও দুর্যোগ বিষয়ক সম্পাদকের পদ, এ মামলায় গ্রেফতারও হয়েছিলেন রাহুল। পরবর্তীতে জামিনে কারামুক্ত হয়ে বিদেশে পাড়ি জমান তিনি। গত মাস দুয়েক আগে দেশে ফিরেন তিনি। কমিটিতে সহ-সভাপতি পদ পাওয়া সহ-সভাপতি আসিফুল ইসলাম অন্তু গত বছরের ১১ এপ্রিল আখাউড়া থানা পুলিশের হাতে মাদকসহ গ্রেফতার হন। একই বছরের ৩১ আগস্ট ওই মাদক মামলার দাখিলকৃত চার্জশিটেও তাদের নাম রয়েছে।

বিবাহিত হয়েও আলমগীর হোসেন ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া জেলা ছাত্রলীগ কমিটির সহ-সভাপতির পদ পেয়েছেন।

এছাড়া, ২০১৮ সালের জুন মাসে অস্ত্র ও গুলিসহ গ্রেফতার হওয়া রবিউল আলমকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ দেয়া হয়েছে। বিবাহিত মেহেদী মিশু পেয়েছেন পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদকের পদ। ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনের চা বিক্রেতা সাইফুল ইসলাম উজ্জল পেয়েছেন উপ-অর্থ বিষয়ক সম্পাদক।

বিবাহিত মেহেদি মিশু পেয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ছাত্রলীগের পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদকের পদ।


২০১৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের পর ১১ ফেব্রুয়ারি রবিউল হোসেন রুবেলকে সভাপতি ও শাহাদাৎ হোসেন শোভনকে সাধারণ সম্পাদক করে ৭ সদস্য বিশিষ্ট আংশিক কমিটি অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এক বছর মেয়াদী ওই কমিটির মেয়াদ শেষে প্রায় ৩৩ মাস পর গত ৩০ অক্টোবর ৩৪৯ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটির অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এই কমিটি ঘোষণায় ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের নিয়মও মানা হয়নি। ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের ১০’র ‘ক’ ধারায় বলা আছে, জেলা কমিটি ১৫১ সদস্যের নির্বাহী সংসদ গঠিত হবে। সেখানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ছাত্রলীগের কমিটি হয়েছে ৩৪৯ সদস্য বিশিষ্ট।

ছাত্রদল নেতা আবির হোসেন সোহাগ সদস্য হিসেবে স্থান পেয়েছেন ছাত্রলীগের জেলা কমিটিতে।

কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষরে অনুমোদিত কমিটিতে আরও দেখা যায়, সেখানে শয়ন আহমেদ শিখনকে সহ-সম্পাদক করা হয়েছে। স্কুলের গণ্ডি পার না হওয়া এই যুবক শহরের পীরবাড়ি এলাকার একটি জুতার কারখানায় কারিগর হিসেবে কাজ করেন। গঠনতন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে ৩০১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়েও বড় ৩৪৯ সদস্যের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কমিটিতে ঠাঁই পেয়েছেন ইয়াবা ব্যবসায়ী, ছাত্রদল নেতা, হেফাজতের জ্বালাও-পোড়াও মামলার আসামি, অছাত্র, বিবাহিত, সন্তানের জনক, প্রবাসী, সহোদর ভাই, ফটোকপির দোকানের কর্মচারী, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, স্কুলের গণ্ডি পার না হওয়া, ত্রিশের অধিক বয়সী, এসএসসি ফেল এবং মাদক, চুরি ও ছিনতাই মামলার আসামি।

(লাল বৃত্তে) ছাত্রদলের মিছিলে নাজমুল হাসান, সাংগঠনিক সম্পাদক ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ছাত্রলীগ।

অনুমোদিত কমিটির তালিকা ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে অন্তত ২ শতাধিক লোককে স্থান দেয়া হয়েছে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে। অনুমোদিত কমিটিতে ১৩৬ জনকে উপ-সম্পাদক, ৯০ জনকে সহ-সভাপতি, ৫৯ জনকে সহ-সম্পাদক, ৪০ জনকে সদস্য, ১১ জনকে যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও ১১ জনকে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে। ছাত্রলীগের ইতিহাসে কোনো জেলা কমিটিতে একই পদে এত বেশি সংখ্যক লোককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

পেশায় ফটোকপির দোকানের কর্মচারী, কিন্তু পদাধিকারে জেলা ছাত্রলীগের সম্পাদক!

অনুমোদিত কমিটির ১৩ পৃষ্ঠার তালিকা ঘেঁটে আরও দেখা যায়, জেলার কসবা উপজেলার পশ্চিম ইউনিয়ন শাখা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আবির মো. সোহাগকে জেলা ছাত্রলীগের সদস্য করা হয়েছে। ছাত্রদল নেতা মো. শাফী আলম এবং ছাত্রদল কর্মী মো. জাহিদ হাসানকে সহ-সভাপতি করা হয়েছে। স্কুলের গণ্ডি পার না হওয়া এবং ছিনতাইসহ একাধিক মামলার আসামি মো. মোজাম্মেল হককে সহ-সম্পাদক করা হয়েছে। সাইফুল ইসলাম উজ্জ্বল এবং শিশির আলমকে একই কমিটিতে ২ পদে রাখা হয়েছে। সরাইলের প্রত্যন্ত রাজাপুর গ্রামের বাসিন্দা আলমগীর হোসেন রেজা ও তার ভাই আফজাল হোসেনকে কমিটিতে পদ দেয়া হয়েছে। বিবাহিত এই সহোদরের মধ্যে আলমগীর হোসেনকে সহ-সভাপতি এবং আফজাল হোসেনকে উপ-মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক করা হয়েছে।

এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সদ্য ঘোষিত জেলা ছাত্রলীগের ৩৪৯ সদস্যের কমিটি সংশোধনের দাবিতে ৭ দিনের আল্টিমেটাম দিয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে পদবঞ্চিত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। গতকাল মঙ্গলবার (২ নভেম্বর) সন্ধ্যায় বিক্ষোভ মিছিলটি শহরের প্রধান ভাদুঘর, কাউতলী, কলেজপাড়া, কালীবাড়ি মোড়, টিএরোড ও হাসপাতাল মোড় প্রদক্ষিণ শেষে ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবের সামনে গিয়ে শেষ হয়। সেখানে পদবঞ্ছিত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সমাবেশ করেন।

সেখানে ছাত্রলীগের সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আমিনুল ইসলাম জুয়েল ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক লাভলু চৌধুরী বক্তব্য রাখেন। বিক্ষোভ সমাবেশে পদবঞ্চিত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বলেন, ওয়ান পাস, টু পাস ও যারা এসএসসি পাস করেনি, যাদের বয়স ৩০এর বেশি, বিবাহিত, অছাত্র, মাদক ব্যবসায়ী, বিভিন্ন মামলা-হামলার সঙ্গে জড়িত ও বিএনপি-ছাত্রদলের বিভিন্ন কমিটিতে ছিল- এমন নেতাকর্মীদের জেলা ছাত্রলীগের এ কমিটিতে রাখা হয়েছে। বিভিন্ন দায়িত্ব প্রাপ্ত সাংগঠনিক নেতা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ছাত্রলীগের কিছু বর্তমান ও সাবেক নেতাদের সমর্থন ও ইন্ধনে এমনটা হয়েছে। আমরা চাই জেলা ছাত্রলীগ একটি পরিচ্ছন্ন ও ছাত্র জনতার কমিটি হউক। যারা রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে, যারা রাজপথে বিএনপির আগুন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মাঠে ছিল তাদের এ কমিটিতে মূল্যায়ন করা হয়নি। ছাত্রলীগের কমিটি সংশোধন করে বিবাহিত, অছাত্র, মাদক ব্যবসায়ীদের কমিটি থেকে বিলুপ্ত করতে হবে। যদি আগামী সাতদিনের মধ্যে জেলা ছাত্রলীগের এই কমিটি সংশােধন করা না হয়, তাহলে আমরা এর চেয়ে বড় দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলব। বিবাহিত, অছাত্র, মাদক ব্যবসায়ী, মাদক মামলা জড়িত এমন ১০০জন এ কমিটিতে রয়েছে। রয়েছে চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী ১০-১২জন, ২০-২৫ জন বিবাহিত, ৮-১০ অছাত্র, ছাত্রদল থেকে এই কমিটিতে এসেছে এমন ৫-৭জন রয়েছে। 

এ ব্যাপারে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রবিউল হোসেন বলেন, আমরা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কাছে এত বড় কমিটি জমা দেইনি। তবে কমিটিতে পদ পাওয়া যে কোনো ছাত্রলীগের সদস্যের বিরুদ্ধে কেউ যদি সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দেখাতে পারেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply