মুজিবুর রহমান ‘দেবদাস’: এক ‘জীবন্ত শহীদ’র গল্প

|

মুজিবুর রহমান 'দেবদাস'। ছবি: সংগৃহীত

মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের কথা আমরা জানি। কিন্তু জীবন্ত শহীদদের কথা আসেনি কোনো পরিসংখ্যানে। পরাধীন বাংলাদেশ যাদের অসম সাহসিকতার মাধ্যমে পেয়েছে পরম আরাধ্য স্বাধীনতা, স্বাধীন দেশেই হয়ে গেলেন তারা ঠিকানাহীন। মৃত্যু আসেনি বলেই তাদের কথা আমাদের জানা নেই, সরকারি খাতায় আসেনি তাদের নাম। পথে পথে ঘুরে বেড়ানো এমনই এক জীবন্ত শহীদের কথা জানবো আজ।

১৯৭১ সালের মার্চ মাসে শুরু হয় অপারেশন সার্চ লাইট। নির্বিচারে হত্যা করা হয় শিশু থেকে বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ সবাইকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো রাঢ়বঙ্গের প্রধান বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও চলে পাকিস্তানি বাহিনীর পাশবিক নির্যাতন ও গণহত্যা। কিন্তু এর বিপক্ষে প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করেননি তৎকালীন অধিকাংশ শিক্ষক। বরং, সম্মিলিত বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষকমণ্ডলী প্রকাশ করেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা স্বাভাবিক এবং সুষ্ঠুভাবেই সেখানে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এরইমধ্যে মে মাসের ১২ তারিখে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে শুরু হয় এক অভূতপূর্ব চাঞ্চল্য। গণিত বিভাগের এক অধ্যাপক, নাম মুজিবুর রহমান, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর এক প্রতিবাদ লিপি পাঠান। তীব্র ভাষায় লেখা সেই লিপিতে বিশ্ববিদ্যালয়কে সেনানিবাসে পরিণত করার ব্যাপারে প্রতিবাদ জানান। এমনকি সে সময়কে গণহত্যা এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কাল বলেও উল্লেখ করেছেন মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ২৯ এপ্রিল লেখা সেই চিঠিতে লেখা ছিল,

“..This is to inform the authorities that I am going to leave the campus since the university campus has, at the moment, been degraded to the state of a military camp. I may come to the campus when the university regains its status and sanctity, and starts functioning as an university in true sense.

I hope to be kept informed about situation here in the address noted below. Where I hope to spend these days of calamity, genocide and freedom movement.

Please note the change of my name and from now this name should be used in future communications.

Sd/Devadas

previous name: Mujibur Rahman

Senior Lecturer, Mathematics

Village: Maharul

P.O: Parbatipur,

Bogura

(সৌজন্য The Wave 29.04.1972)

ঘটনার এখানেই শেষ নয়। তথাকথিত মুসলমান পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যায় বিক্ষুব্ধ প্রফেসর মুজিবুর রহমান যে তার মুসলমান পরিচয়কে ত্যাগ করেছিলেন সেটিই নয়। বরং, এমন একটি প্রতিবাদলিপি পাঠিয়েও নিশ্চিন্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে অবস্থান করছিলেন তিনি। অনেকেই ধারণা করেছেন, তিনি সম্পূর্ণ পাগল হয়ে গিয়েছেন। চারদিকে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, নির্যাতনে তার মানসিক সুস্থতা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়েছে। আর সেটিই তো স্বাভাবিক। যেকোনো বিবেক ও মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষেরই তো এমন নির্যাতন প্রত্যক্ষ করে উন্মাদ হয়ে যাওয়ার কথা। যারা মানুষ হিসেবেই পনেরো আনা, তাদের তো নানা ঘাটতি থাকতেই পারে। জীবন মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্যজ্ঞান করে প্রাণ বিহঙ্গকে শকুনির থাবার নিচে ছুঁড়ে ফেলা অনেক কঠিন বলেই নীরব দর্শকের ভিড়ে, সরব প্রতিবাদীর সংখ্যা সব সময়ই কম। তেমনই একজন সম্পূর্ণ মানুষ দেবদাস বা মুজিবুর রহমান।

কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে লেখা মুজিবুর রহমানের লেখা প্রতিবাদলিপি অতি দ্রুত পৌঁছে গেল সামরিক দফতরে। যেখানে নিরাপরাধ মানুষকে নির্বিচারে জবাই করা হচ্ছে, সেখানে একজন নিরীহ বুদ্ধিজীবীর এই প্রতিবাদের পরিণাম কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা কল্পনা করাও দুঃসাধ্য।

অধ্যাপক মুজিবুর রহমান তখন ছিলেন তার সহকর্মী অধ্যাপক সুব্রত মজুমদারের ফ্ল্যাটে। অকৃতদার অধ্যাপক মুজিবুর রহমান একাই ছিলেন ফ্ল্যাটে। এক সামরিক ক্যাপ্টেন গেলেন এই অধ্যাপকের খোঁজে। ক্যাপ্টেন প্রশ্ন করলেন,

“What is your name?”

“Devadas”, নির্বিকার উত্তর। অধ্যাপকের প্রতিবাদলিপিতেও এই পরিবর্তিত নামের কথা আছে। পত্রের প্রসঙ্গক্রমেই ক্যাপ্টেনের পরের প্রশ্ন,

“What do you mean by genocide?”

অধ্যাপকের সাফ জবাব, “That which you are committing these days.”

ক্যাপ্টেনের মুখের উপর ঠাস করে এমন কথা তখন যে কেউ ছুঁড়তে পারে তা ছিল সম্পূর্ণ কল্পনাতীত। ক্যাপ্টেন তাই ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেন।

“Come with me.”

“Let me have my lunch first. I am cooking now.”

অনুরোধ জানালেন অধ্যাপক রহমান। এক মুঠো চাল তিনি ফুটিয়ে নিচ্ছিলেন তখন। কিন্তু সময় দিতে অপারগ ক্যাপ্টেন বললেন,

“Oh don’t bother. I will give you better lunch.”

ক্যাপ্টেন কেমন লাঞ্চের ব্যবস্থা করেছিলেন তা বুঝতে পারা যায় অনেক পরে। রাজশাহী, পাবনা, নাটোরের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বেটার লাঞ্চ খেয়ে ৫ সেপ্টেম্বর যখন মুক্ত হলেন মুজিবুর রহমান, তখন তিনি অর্ধ উন্মাদ। তারপর চলে যান জয়পুরহাট।

এরপর দেশ স্বাধীন হলো। ক্যাম্পাসে ফিরলেন মুজিবুর রহমান ওরফে দেবদাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমও স্বাভাবিক হলো। কিন্তু গণিতের প্রফেসরের জন্য কোনোকিছুই আর স্বাভাবিক হলো না। পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনে তিনি অস্বাভাবিক হয়ে যান। ব্যাংকে অনেক টাকা ছিল তার। কিন্তু সেই অ্যাকাউন্ট তো মুজিবুর রহমানের নামে, দেবদাসের নামে যে কোনো টাকা নেই! সে টাকাও তিনি তখন তুলেননি বলে জানা যায়। ক্যাম্পাসের কোয়ার্টারে জুবেরি হাউসে তিনি ছিলেন বছর দুয়েক। তারপর একদিন কৌশলে সেখান থেকে উচ্ছেদ করা হয় অসম সাহসী এই শিক্ষককে। পাঠানো হয় হেমায়েতপুর মানসিক হাসপাতালে। সেখানে তার চিকিৎসার কোনো পরিকল্পনাই কারও ছিল না।

কিছুদিন পর মুজিবুর রহমান ওরফে দেবদাস নামলেন রাস্তায়। আবার ফিরে যান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু ততদিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটক তার জন্য বন্ধ হয়ে গেছে চিরদিনের জন্য। জুবেরি হাউসে সুস্থ ভদ্রজনদের পাশে এমন এক ব্যতিক্রমী মানুষের স্থান কীভাবে হতে পারে! পাকিস্তানি জল্লাদের হাতে শহীদ হয়ে গেলে অধ্যাপক মুজিবুর রহমানের নামে প্রতি বছর পুষ্পমাল্য অর্পণ করা যেত। তার ভরণ পোষণ বাসস্থানের ব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক নিশ্চিত করা যেত। কিন্তু গণিতের এই অধ্যাপকের দুর্ভাগ্য, তিনি যে এক জীবন্ত শহীদ! আর জীবন্ত শহীদ স্বাধীন দেশেই ঠিকানাহীন হবেন, এ আর এমনকি। সে কারণে আমরা শহীদদের সংখ্যা জানি। কিন্তু জীবন্ত শহীদদের কোনো তালিকা জানি না। তাদের কোনো নাম থাকে না। এমনকি সংখ্যাভিত্তিক কোনো পরিচয়ও জোটে না দেশের এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের।

তথ্যসূত্র: নাজিম মাহমুদ, যখন কৃতদাস: স্মৃতি ৭১


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply