দুর্ধর্ষ পাচারকারীদের বিষয়ে যে রোমহর্ষক তথ্য দিলেন পালিয়ে আসা জাহাঙ্গীর

|

জাহাঙ্গীরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী রাজধানীর পল্লবী ও উত্তরা এলাকা থেকে মানবপাচার চক্রের মূল ৩ জনকে গ্রেফতার করে র‍্যাব।

সোমবার মধ্যরাতে অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রেরণের কথা বলে পার্শ্ববর্তী দেশ বিশেষত ভারতে মানব পাচার করে আসছিল এমন একটি মানবপাচারকারী চক্রের অন্যতম তিন হোতাকে গ্রেফতার করেছে র‍্যাব-৪ এর একটি চৌকস আভিযানিক দল।

এর আগে, গত বছরের নভেম্বর মাসে অস্ট্রেলিয়া পাঠানোর কথা বলে জনৈক জাহাঙ্গীরকে ভারতে পাচার করে দেয়া হয়। পাচার হয়ে যাওয়ার পর বেশ কিছুদিন ভারতের কলকাতায় আটক থাকেন জাহাঙ্গীর। আটক অবস্থায় কলকাতার টর্চার সেলে জাহাঙ্গীরকে শারিরীক-মানসিক নির্যাতন ও মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে দেশে থাকা তার পরিবারকে চাপ প্রয়োগ করে অর্থ আদায়ের চেষ্টা করে উক্ত পাচারকারী চক্র।

পরে, দেশে এসে ভিকটিম জাহাঙ্গীর র‍্যাব-৪ এর অধিনায়ক বরাবর ওই মানবপাচার চক্রের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগে, মানবপাচার চক্রের ফাঁদে পড়ে পাচার হওয়া, আটকাবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন এবং শেষ পর্যস্ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কৌশলে দেশে ফিরে আসাসহ মানবপাচার চক্রটি সম্পর্কে চ্যাঞ্চল্যকর তথ্যাদি উল্লেখ করেন।

প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পায় র‍্যাব। প্রাপ্ত তথ্য যাচাই, গোপন তদন্ত ও স্থানীয় সোর্স থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে র‍্যাব-৪ এর একটি চৌকস আভিযানিক দল গতরাতে রাজধানীর মিরপুর পল্লবী ও উত্তরা এলাকায় অভিযান চালিয়ে মানবপাচার চক্রের মূল ৩ জনকে গ্রেফতার করতে সমর্থ হয়। গ্রেফতারকৃত ৩ পাচারকারী হলেন, সেলিম (৬২), মো. বুলবুল আহমেদ মল্লিক (৫৫), ও নিরঞ্জন পাল (৫১)। অভিযানে ভুয়া পাসপোর্ট, পাসপোর্টের কপি, নকল ভিসা আবেদনপত্র, বায়োডাটা, ছবি, মোবাইল, সিমকার্ড এবং নগদ টাকাসহ মানবপাচার সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ নথি জব্দ করা হয়।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ভারতে মানব পাচারকারী চক্রের মূলহোতা গ্রেফতারকৃত সেলিম (৬২), তার সহযোগী বুলবুল আহমেদ মল্লিক (৫৫) এবং নিরঞ্জন পাল (৫১)। চক্রে তাদের সহযোগী হিসেবে আরও ৫-৭ জন সদস্য রয়েছে। এছাড়া ভারতেও তাদের বেশ কয়েকজন সহযোগী রয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে কলকাতার রাজিব খান, মানিক এবং দিল্লির রবিন সিং প্রমুখের নাম পাওয়া যায়।

জানা গেছে, গত কয়েক বছর ধরেই চক্রটি সক্রিয়ভাবে ভারতে মানবপাচার করে আসছে। চক্রটি সাধারণত বিদেশ গমনে প্রত্যাশী নিরীহ মানুষকে টার্গেট করে। তাদেরকে অস্ট্রেলিয়া, পর্তুগাল, নেদারল্যান্ড, রোমানিয়া, গ্রিস, ফ্রান্স এবং মাল্টায় উচ্চ বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে তাদেরকে বাংলাদেশ থেকে প্রেরণের কথা বলে ভারতে পাচার করে দিতো। সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের ভারত থেকে ভিসা পাওয়া সহজ এই কথা বুঝিয়ে তাদেরকে প্রতারিত করে এই চক্রটি ভিকটিমকে অবৈধভাবে পাচার করে দিতো।

কিন্তু, ভারত থেকে তাদের সংশ্লিষ্ট দেশে না পাঠিয়ে, তারা ভিকটিমদেরকে ভারতে আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনসহ মেরে ফেলার হুমকি দেখিয়ে সেটি ভিডিও করে তাদের পরিবারের সদস্যদের দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ মুক্তিপণ হিসেবে আদায় করে আসছিল বলে স্বীকার করেছে।

জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা গেছে, চক্রটি রাজাধানীসহ দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় সক্রিয় রয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা আরও জানায়, ভিকটিমদেরকে ইউরোপে উন্নত চাকরি দেয়ার নামে অবৈধ পথে ভারতে পাচার করে। ভারতে অবস্থানরত চক্রের অন্য সদস্যরা ভিকটিমদের ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করতো।

জানা গেছে, ভারতে পাচারকারী চক্রের সদস্য রাজিব খান ও মানিক কলকাতায় এবং রবিন সিং দিল্লিতে টর্চার সেলে ভিকটিমদের আটক রাখার মূল দায়িত্ব পালন করতো। সেখানে চক্রের অজ্ঞাতনামা আরও ২-৩ জন সদস্য রয়েছে। এ চক্রটি এ পর্যন্ত শতাধিক ভিকটিমকে অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রেরণের নামে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করেছে বলে জানা যায়। চক্রটি অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপে চাকরি দেয়ার নামে প্রথমে ১২-১৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত গ্রহণ করে।

ভারতে পাচারের পর দিল্লি ও কলকাতার টর্চার সেলে আটক রেখে ভিকটিমকে নির্যাতন করে আবারও মুক্তিপণ হিসেবে ১৫ থেকে ২০ লক্ষ টাকা আদায় করতো।

অভিযোগকারী ভিকটিম জাহাঙ্গীর এরকম প্রতারণা ও পাচারের শিকার হয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। গত ২০১৯ সালে মল্লিক রেজাউল হক সেলিম ও বুলবুল আহমেদ মল্লিকদের সাথে পরিচয় হয়। উক্ত রেজাউল হক সেলিম এবং বুলবুল আহমেদ ভিকটিম জাহাঙ্গীরকে অস্ট্রেলিয়া এবং জাহাঙ্গীরের ভাগিনা আকাশকে নেদারল্যান্ডে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে ৩৪ লক্ষ টাকা দাবি করে। গত ১০ অক্টোবর ২০১৯ সালে উক্ত পাচারকারী চক্রের মূলহোতা রেজাউলের নিকট ভিকটিম নগদ ৮ লক্ষ টাকা এবং এর কিছুদিন পর আরও ৬ লক্ষ টাকা প্রদান করে। বিভিন্ন ছলচাতুরি করে নকল ভিসার মাধ্যমে পাচারকারী চক্রটি ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে জাহাঙ্গীর ও তার ভাগিনা আকাশ’কে ভারতে পাচার করে দেয়।

পাচারের পরপরই ভিকটিম জাহাঙ্গীর ও আকাশ উভয়েই পাচারকারী চক্রের সদস্যদের কাছে নজরবন্দী ও আটক ছিল। আটক অবস্থায় মানবেতর জীবন-যাপন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ও মৃত্যুভয়ে দিন কাটে ভুক্তভোগীদের। বন্দি থাকা অবস্থায় ভিকটিমদের পরিবারের কাছ থেকে আরো ৯ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ হিসেবে আদায় করে চক্রটি। আটক থাকা অবস্থায় ভিকটিম জাহাঙ্গীর কৌশলে পালিয়ে অনেক কষ্ট করে দেশে ফিরে আসেন। অপর ভিকটিম আকাশ এখনও ভারতে আটক আছেন বলে জানা যায়।

পাচারকারী চক্রের অন্যতম সদস্য নিরঞ্জন পাল ২০২০ সালে বাংলাদেশ হতে পর্তুগাল ও মালটা পাঠানোর নামে নবাবগঞ্জের তিনজন যথাক্রমে বিল্লাল হোসেন, রবিন হোসেন ও শাহীন খান’কে ভারতে পাচার করেছে। তারা টর্চার সেলে অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করে মুক্তিপন প্রদান করে ৬ মাস পর দেশে ফেরত আসেন। তারাও গ্রেফতারকৃত আসামিদের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

/এসএইচ


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply