কাওসার আহমেদ চৌধুরী: বসন্তেই সীমান্ত পেরিয়ে যাওয়া গীতিকারের গল্প

|

কাওসার আহমেদ চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা পপ, রক ও আধুনিক গানের একজন বরেণ্য গীতিকার কাওসার আহমেদ চৌধুরী। বর্ণাঢ্য জীবনে চমৎকার কিছু গান লেখে গিয়েছেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। সেই সাথে বুদ্ধিদীপ্ত কৌতুক ও ভাষার প্রয়োগে রাশিফলকে করে তুলেছেন তিনি দারুণ জনপ্রিয়।

তবে শৈশব থেকেই কবিতা আর জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রতি অনুরাগ জন্মে কাওসার আহমেদ চৌধুরীর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে ভর্তির পর চিত্রশিল্পী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন তিনি। তবে সেই স্বপ্ন ডালপালা মেলার আগেই চিত্রনির্মাতা হওয়ার ঝোঁক চেপে বসে তার মাথায়। প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের সাথে পরিচয়ের সুবাদে অভিনয়ের সুযোগও পেয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীতে ভিসা সংক্রান্ত জটিলতায় আর কাজটি করা হয়ে ওঠেনি তার। তবে স্মৃতিপটে চিরস্থায়ী আসন অধিকার করার মতো অনবদ্য কিছু গান লিখেছেন কাওসার আহমেদ চৌধুরী।

বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি ব্যান্ড ও সঙ্গীতশিল্পীর দারুণ শ্রোতাপ্রিয় কিছু গানের স্রষ্টা এই জনপ্রিয় রাশিফল লেখক। লাকী আখান্দ, এলআরবি, নগরবাউল, ফিডব্যাক, সুবীর নন্দী, সামিনা চৌধুরী, নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী, শুভ্র দেবের কণ্ঠে গাওয়া বেশকিছু গানের গীতিকার তিনি। তবে শৈশব থেকেই কবি হওয়ার অনুরাগ যার, এসব শ্রোতাপ্রিয় গানের অনেক আগে থেকেই গান লিখে গেছেন তিনি। সিলেট বেতারে কাওসার আহমেদের লেখা প্রথম গান প্রচারিত হয়। তবে অনেক গান তারও পূর্বে লিখেছিলেন তিনি সেই গানটি প্রচারিত হওয়ার আগেই। কেবল বয়স কম হওয়ার কারণে সেসব প্রচারিত হতো বেনামে।

এরপর টেলিভিশনে তালিকাভুক্ত হন কাওসার আহমেদ চৌধুরী। তবে লাকী আখান্দের সাথে পরিচয় হওয়াটা ছিল তার জন্য বিশেষ এক পর্ব। ১৯৭২ সালের দিকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ঘটে এই সংযোগ, যার প্রতি ঋণী থাকতে পারে অগণিত সঙ্গীতপ্রেমী। এরপর গান লেখার প্রতি ঝোঁক বেড়ে যায় কাওসার আহমেদের। প্রথম পরিচয়েই লাকী আখান্দ কিছু গান চেয়ে বসলেন তার কাছে। আর গানগুলোতে অসাধারণ সুরারোপ করলেন লাকী আখান্দ। ফলশ্রুতিতে, দুজনের মধ্যে তৈরি হয় বন্ধুত্ব। জেমসের গাওয়া বিখ্যাত গান ‘লিখতে পারি না কোনো গান আজ তুমি ছাড়া’ লিখেছেন কাওসার আহমেদ চৌধুরী; আর সুর দিয়েছেন লাকী আখান্দ। শোনা যায়, লাকী আখান্দ ছাড়া অনেক লম্বা সময় আর কাউকে গান দিতেন না তিনি। আর লাকীর কথা ছিল, কাওসার আহমেদের জন্মই হয়েছে গান লেখার জন্যে। লাকী আখান্দের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অটুট ছিল তাদের বন্ধুত্ব।

কাওসার আহমেদ চৌধুরীর লেখা জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে আইয়ুব বাচ্চুর কণ্ঠে ‘এই রুপালি গিটার ফেলে’, লাকী আখান্দের কণ্ঠে ‘আমায় ডেকো না ফেরানো যাবে না’, কুমার বিশ্বজিতের কণ্ঠে ‘যেখানে সীমান্ত তোমার সেখানেই বসন্ত আমার’, সামিনা চৌধুরীর কণ্ঠে ‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে রাতের নির্জনে’, নিয়াজ মোহাম্মদের কণ্ঠে ‘আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে’, ফিডব্যাকের মাকসুদের কণ্ঠে ‘মৌসুমি কারে ভালোবাসো তুমি’, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে প্রচারিত নাফিস কামালের কণ্ঠে ‘এই দেশে এক শহর ছিল’।

কবিবন্ধু নির্মলেন্দু গুণের অনুরোধে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রেমাংশের রক্ত চাই’-এর প্রচ্ছদের নকশা করেন কাওসার আহমেদ চৌধুরী। বেশ কিছু টিভি নাটক রচনা ও পরিচালনাও করেছেন এই বহু গুণে গুণান্বিত মানুষ। শ্রীমঙ্গলের এক পাহাড়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার পর অতর্কীতে হাজারও জোনাকি পরিবেষ্টিত হয়ে ‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে’র মতো কালজয়ী গানের এই স্রষ্টা সীমান্ত পেরিয়ে বিদায় নিলেন বসন্তে, রাতের নির্জনে।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply